শকুন্তলা মানেই, নরম, স্নিগ্ধ, কোমলমতি? অবাক করবে 'আসল' শকুন্তলার কাহিনি
Shakuntala: ব্যাসদেবের শকুন্তলা! তাই প্রথমে ভদ্রতার খাতিরে একটু চুপ থাকলেও আসল রূপ প্রকাশ করতেই হয়েছে।
শকুন্তলা। এই নামটির সঙ্গে আমাদের অধিকাংশেরই হয়তো প্রথম পরিচয় ঘটেছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনির মধ্য দিয়ে। রাজা দুষ্ম্যন্ত আর শকুন্তলার অমর কাহিনির সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় অবনীন্দ্রনাথের জাদু লেখনী। তবে অবনীন্দ্রনাথ যে দুষ্ম্যন্ত আর শকুন্তলার কাহিনি লিখেছেন, তার সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয় মহাকবি কালিদাস। তাঁর অনুপম রচনা অভিজ্ঞানশকুন্তলম থেকেই এসেছে এই দু'টি কালজয়ী চরিত্র। তাহলে শকুন্তলা ও দুষ্ম্যন্ত কি মহাকবি কালিদাসেরই সৃষ্টি? না! আসলে শিশুকালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বইয়ের পাতায় পড়া শকুন্তলার আসল রচয়িতা হলেন মহামুনি বেদব্যাস, অর্থাৎ মহাভারত মহাকাব্যের নানা ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে দুষ্ম্যন্ত শকুন্তলার ঘটনাও এক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। যে শকুন্তলা এত চর্চিত চরিত্র, যাকে নিয়ে মহাকবি কালিদাস লিখেছেন অভিজ্ঞানশকুন্তলম, বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন প্রবন্ধ, মধুসূদন লিখেছেন পত্রকাব্য, সেই শকুন্তলার বীজ নিহিত আছে ব্যাসকৃত মহাভারতে। তবে মহাভারতে এর বীজ নিহিত আছে বটে, কিন্তু দুষ্ম্যন্ত আর শকুন্তলার প্রেমকাহিনি মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন আর এতটাই প্রাচীন যে প্রায় সবক'টি মুখ্য পুরাণেই এর উল্লেখ আছে। মহাভারতেও আছে আর কালিদাস সেই মহাভারতেরই সাহায্য নিয়েছেন।
এই প্রণয়কাহিনি যে অতি প্রাচীন তা বোঝা যায় একটু অদ্ভুতভাবে। পাঠকমাত্রেই জানেন, শকুন্তলাকে বিবাহ করে রাজ্যে ফিরে আসার পর দুষ্ম্যন্ত (মতান্তরে দুষ্যন্ত) তাঁকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়েছিলেন আর পরবর্তীকালে শকুন্তলার সঙ্গে নিজের সন্তানকে দেখেও চিনতে পারেননি। সেই পুত্রের নাম ছিল ভরত। ভরতের নাম পূর্বে ভরত ছিল না, ছিল সর্বদমন। সর্বদমনের নাম ভরত কেন হলো, সেই প্রসঙ্গেই ঘুরেফিরে এসেছে একটি দৈববাণী আর তার সঙ্গে জড়িত দু'টি শ্লোক। সেই শ্লোক দু'টির তর্জমা করলে মোটামুটি যা দাঁড়ায় তা হলো, দুষ্যন্ত, তুমি পুত্রের ভরণপোষণ করো, শকুন্তলাকে অনর্থক অপমান করো না। তুমিই এই পুত্রের কারণ আর শকুন্তলা সঠিকই বলেছে (…ভরস্ব পুত্রং দুষ্যন্তে মাবমংস্থাঃ শকুন্তলাম্/তঞ্চাস্য ধাতা গর্ভস্য সত্যমাহ শকুন্তলা…)। এই কাহিনির মূল বীজ নিহিত আছে ওই দু'টি শ্লোকেই। রহস্যগল্পের সূত্রের মতো কথকেরা এই শ্লোকদু'টিকে শ্রোতাদের মাঝে ফেলে দিয়ে কাহিনির সূত্রপাত করতেন। বিভিন্ন বিখ্যাত পুরাণে এই শ্লোক আর এই প্রসঙ্গেই কাহিনিটি আছে আর মহাভারতেও তার অন্যথা হয়নি।
আরও পড়ুন- দেবতাদের প্রিয় মদ! জানেন, উত্তরভারতের কোথায় লুকিয়ে আছে সোমরস তৈরির উপকরণ?
শকুন্তলা আর দুষ্ম্যন্তর উৎস তো জানা গেল, কিন্তু দুষ্ম্যন্ত শকুন্তলার কাহিনি বলতে আমরা বরাবরই মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলমের কাহিনিই জেনে এসেছি। ঋষি বিশ্বামিত্র ও অপ্সরা মেনকার পরিত্যক্ত সন্তান শকুন্তলাকে আশ্রমে এনে মানুষ করেছেন মহর্ষি কণ্ব। পরবর্তীকালে বনচারিণী শকুন্তলার সঙ্গে সসাগরা পৃথিবীপতি দুষ্ম্যন্তের পরিচয়, প্রেম ও পরিণয় তারপর গর্ভবতী অবস্থায় শকুন্তলার দুষ্ম্যন্তের নিকটে যাত্রা এবং নানারকম নাটকীয় উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে তাঁদের মিলন ঘটে। মহাকবি কালিদাসের হাতের জাদুকরী ছোঁয়ায় যে স্নিগ্ধ, কাব্যিক শকুন্তলাকে পাঠক পান, 'আসল' শকুন্তলা, অর্থাৎ বেদব্যাসের শকুন্তলা কি ঠিক তেমনই ছিল? মজার বিষয় হলো, একেবারেই না! কালিদাস যদি মহাভারতের শকুন্তলা-দুষ্ম্যন্তের কাহিনি নিয়ে অভিজ্ঞানশকুন্তলম না লিখতেন, তাহলে এই চিত্তাকর্ষক প্রেমকাহিনি হয়তো পাঠকের চিত্ত অতটাও আকর্ষণ করতে পারত না। কাহিনির মূল নায়িকা শকুন্তলার চরিত্রের পুরো আকাশ-পাতাল তফাত ঘটে গেছে কালিদাস আর বেদব্যাসে। ঘটারই কথা, কারণ মহাভারতকার জ্ঞানবৃদ্ধ বেদব্যাস আর নাগরিক কবি কালিদাসের কবিদৃষ্টি তো সমান নয়! তাহলে দেখা যাক, কেমন ছিলেন আমাদের প্রকৃত শকুন্তলা?
মহাভারতের শকুন্তলা কিন্তু অনেক বেশি ব্যক্তিত্বময়ী, যাকে হালফিলে বলে স্মার্ট! কালিদাসের শকুন্তলার অনসূয়া আর প্রিয়ম্বদা নামে দুই সখী আছে, ব্যাসদেবের শকুন্তলার তাও নেই। কালিদাসের শকুন্তলা, অতিরিক্ত লজ্জাশীলা একটি মেয়ে হলেও ব্যাসদেবের শকুন্তলা সখিহীনা, স্মার্ট, ব্যক্তিত্বময়ী। কালিদাসের রচনায় প্রথমাঙ্ক জুড়ে শকুন্তলা কোনও কথাই বলেনি। অথচ ব্যাসদেবের শকুন্তলা দুষ্ম্যন্তকে প্রথম দেখাতেই সব বলে গেছেন। এমনকী মহর্ষি বিশ্বামিত্র কীভাবে অপ্সরা মেনকার প্রতি আকৃষ্ট হন আর তাঁদের সন্তান হিসেবে শকুন্তলার জন্ম হয়, সবটুকুই অসংকোচে বলে গেছেন তিনি। সহজেই অনুমেয়, শকুন্তলা স্পষ্টবাদিনী ছিলেন। তবে একটা কথা ভুললে চলবে না। শকুন্তলাও পরিবর্তিত হয়েছেন আর সেই সঙ্গে রাজা দুষ্ম্যন্তও। কালিদাসের দুষ্ম্যন্ত যদি চঞ্চলমতি হন, মহাভারতের দুষ্ম্যন্ত একেবারে দুষ্টচরিত্রই বলা যায়। কেন? ক্রমশ প্রকাশ্য।
রাজা দুষ্ম্যন্ত শকুন্তলার রূপে মোহিত হয়ে হঠাৎ করে বিবাহপ্রস্তাব দিয়ে বসেন। যে সে বিবাহ নয়, একেবারে গান্ধর্ব বিবাহ। এখানেই আবার ব্যাসের শকুন্তলা আর কালিদাসের শকুন্তলা আলাদা হয়ে যান। ব্যাসের শকুন্তলা শুধু স্মার্টই নন, বুদ্ধিমতীও। অপরিচিত রাজার এই আকস্মিক প্রস্তাবে তিনি ঠান্ডামাথায় একটি শর্ত করিয়ে নিলেন যে, তাঁদের সন্তানই যেন রাজা হয়। রাজা যে একপত্নীক হবেন না সেটুকু জ্ঞান এই শকুন্তলার ছিল। এদিকে কালিদাসের কোমলমতি শকুন্তলা অত কিছুই ভাবেননি। এইবারেই হলো আসল ব্যাপারের সূত্রপাত। কালিদাস না হয় দুর্বাসার শাপকে দায়ী করেছিলেন দুষ্ম্যন্তের শকুন্তলা-বিস্মৃতির জন্য, দুষ্ম্যন্তের হাত দিয়ে একটি আংটিও শকুন্তলাকে দিয়েছিলেন আর এই শাপের কারণে রাজা চঞ্চলমতিও ছিলেন না কিন্তু ব্যাসের দুষ্ম্যন্ত মোটেই তা নন (আগেই বলা হয়েছে)। তিনি কণ্বমুনির প্রতিক্রিয়ার ভয়ে স্রেফ পালিয়ে এসেছিলেন আর আশ্রমবাসিনী শকুন্তলাকে স্রেফ ইচ্ছে করেই ভুলে গিয়েছিলেন। আংটির গল্প তো সেখানে নেই-ই।
আরও পড়ুন- বাল্মীকির দায়সারা চরিত্র! যেভাবে রামের হাতে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল অনার্য মারীচ
এবার আসা যাক আসল গল্পে। অভিজ্ঞানশকুন্তলমে শকুন্তলা গর্ভবতী অবস্থায় দুষ্ম্যন্তের রাজসভায় গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। আর মহাভারতে পুত্র সর্বদমনের জন্মের পরই তিনি যাচ্ছেন সেখানে আর সেখানেই পাঠক দেখতে পাচ্ছেন আসল দুষ্ম্যন্ত আর আসল শকুন্তলার আসল রূপ তথা বাগবিতণ্ডা। দুষ্ম্যন্ত সেখানে শকুন্তলাকে সর্বসমক্ষে কী অপমানটাই না করেছেন। স্বামীর পরিচয় তো বটেই, পিতৃত্বের দায়ও স্রেফ অস্বীকার করে গেছেন। তবে, এই শকুন্তলা তো ব্যাসদেবের শকুন্তলা! তাই প্রথমে ভদ্রতার খাতিরে একটু চুপ থাকলেও আসল রূপ প্রকাশ করতেই হয়েছে। কালিদাসের শকুন্তলা অত কথা বলতেই পারেননি, অল্প প্রতিবাদ করেই অপমানে জর্জরিত হয়ে রাজসভা ছেড়েছিলেন। হে পাঠক, ব্যাসদেবের মহাভারত আর অভিজ্ঞানশকুন্তলম্–এ চোখ বোলালে এই ফারাক স্পষ্টই দেখতে পাবেন। এর পরেই শুরু হয়েছে তুমুল বাগবিতণ্ডা। মহাভারতের শকুন্তলাকাহিনি জুড়ে এই বাগবিতণ্ডাই আছে। শকুন্তলা প্রথমে ধর্মশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে শুরু করলেও শেষে দুষ্ম্যন্তের জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও ভয়ানক কটুকথা বর্ষণ করতে আরম্ভ করেন। দুষ্ম্যন্তের মুখেও শকুন্তলার ভয়ানক নিন্দা শুনে আশ্চর্য লাগে, তাহলে আকরিক অবস্থায় এই কি ছিল এই কালজয়ী নায়ক-নায়িকার বাক্যালাপ! যাকে কালিদাস অত সুন্দর, বিদগ্ধ, নাটকীয় আর পরিশীলিত করে পেশ করেছেন, তার আসল রূপ তবে এতই কদর্য! যাইহোক, মহাভারতে এই তুমুল বাগবিতণ্ডা সামাল দিয়েছিল পূর্বোক্ত সেই দু'টি শ্লোকসম্বলিত দৈববাণী! আর কালিদাসে সামাল দিয়েছিল শকুন্তলার কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া দুষ্ম্যন্তের সেই আংটি।
আসলে, মহাভারত থেকে শুধু কাহিনিটুকুই নিয়েছেন কালিদাস। তাই অভিজ্ঞানশকুন্তলমের চরিত্র ও কাহিনিবিন্যাস একেবারেই কালিদাসের মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁর হাতে পড়ে শকুন্তলা, মহাভারতের শকুন্তলার চেয়ে অনেক বেশি পরিশীলিত, ‘সফিস্টিকেটেড’ হয়ে গেছেন, বলাই যায়। তা নাহলে আমরা কালজয়ী অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ পেতাম না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যে, মহাভারতে আমরা পাই একেবারে আসল শকুন্তলাকে। মহাভারত ও অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ পাঠককে দিয়েছে দুই ভিন্ন স্বাদের শকুন্তলা চরিত্রের ছোঁয়া। মহাভারতে প্রাধান্য পেয়েছে ‘মা’ শকুন্তলা, আর অভিজ্ঞানশকুন্তলমে হৃদয় জয় করেছে ‘প্রেমিকা’ শকুন্তলা। কিন্তু আসল শকুন্তলা যেমনই হোন, শকুন্তলা-দুষ্ম্যন্তের প্রেমকাহিনি চির অমলিন হয়েই থাকবে।