বারবার বিজেপির হাতছাড়া রাজধানী! কোন চালে কিস্তিমাত আপ-এর?

Delhi MCD Elections: কেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ওপর ভরসা রাখলেন দিল্লির পুর এলাকার বাসিন্দারা?

একদিকে গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনের বুথ ফেরত সমীক্ষায় স্বস্তি। অন্যদিকে দিল্লি নিয়ে অস্বস্তি! বুধবার নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের (Narendra Modi, Amit Shah) লোকসভার সেমিফাইনালের আবহ তৈরি হল এমনভাবেই।

দিল্লির পুরসভা নির্বাচনে (Municipal Corporation of Delhi) হারল বিজেপি। বহু বছর পর রাজধানীর পুর এলাকা গেরুয়া-ঘর থেকে ছিনিয়ে নিল আম আদমি পার্টি (AAP)। অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের (Arvind Kejriwal) দিকেই অবশেষে ঝুঁকলেন পুর এলাকার প্রায় ৮০ লক্ষ ভোটার!

৭ ডিসেম্বর দিল্লির পুর নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। ওই ফলে দেখা গিয়েছে মোট ২৫০টি ওয়ার্ডের পুরসভায়, ১৩৪টি ওয়ার্ডে জয় পেয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি দল। ১০৪ আসনে জিতেছে বিজেপি। এই পৌরসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে প্রয়োজন ১২৬টি ওয়ার্ডে জয়লাভ। যা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গিয়েছে আপ। কংগ্রেস জয় পেয়েছে মাত্র ৭টি আসনে। যদিও বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষায় আগে থেকেই ছিল এই আভাস। এবার যে বিজেপি-র হাত থেকে দিল্লির পুরসভা ছিনিয়ে নেবে আপ, এই ইঙ্গিত ছিল একাধিক সংস্থার করা ওই বুথ ফেরত (Exit Poll) সমীক্ষায়। ডিসেম্বরের ৪ তারিখের নির্বাচনে গত পুর নির্বাচনের তুলনায় ভোটের হারও বৃদ্ধি পায়। প্রায় ৫০.৪৮ শতাংশ ভোট পড়ে এই নির্বাচনে। দিল্লির মোট ১ কোটি ৪৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে এই পুর নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল ৭৩ লক্ষ জনতার। যা দিল্লির রাজনীতি তো বটেই দেশের রাজনীতির পক্ষেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক কারবারিদের একাংশ।

আরও পড়ুন: মোদি ম্যাজিক না কি শাহি-শ্রম? কোন মন্ত্রে গুজরাতে ফের পদ্ম-হাতছানি

এই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে দিল্লি-দাঙ্গা। নির্বাচন কমিশনের তথ্যে জানা যায়, ২০২০-র দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ভোটের হার আগের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকী, একাধিক বস্তি এলাকায় ভোটের হার বৃদ্ধির তথ্যও উঠে আসে কমিশনের ওই পরিসংখ্যানে।

দিল্লির নির্বাচনের প্রচারেই বিজেপি-র হারের আঁচ ছিল। তেমন কোনও বড়মাপের বিজেপি নেতাকে এর প্রচার করতে দেখা যায়নি। যদিও পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিলীপ ঘোষের মতো নেতাকে কাজে লাগানো হয় ওই অঞ্চলের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় ভোটের প্রচারে। দিল্লিতে কয়েক লক্ষ বাঙালি ভোটারের মধ্যে এই নির্বাচনেও ভোট দেন বহু। যদিও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার এবং এই পুরসভায় অবশেষে আম আদমি দলের জয়, স্বস্তির আবহ সৃষ্টি করেছে অরবিন্দ-মণীশ শিশোদিয়াদের মধ্যে। একদিকে পাঞ্জাবে বিপুল নির্বাচনী সাফল্য এবং এর পরেই ফের দিল্লিতে এই বিরাট জয়, গুজরাত আবহেও মোদি-বিরোধী মুখ হিসেবে তুলে ধরেছে আপ-প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে।

যদিও এই নির্বাচনেও বারবার উঠে এসেছে বিজেপি পরিচালিত পুরসভার উন্নয়নের কাজে বাধার কথাও। প্রসঙ্গত, এর আগে দিল্লির ওই পুর এলাকা ছিল মোট ২৭২টি ওয়ার্ডের সমন্বয়ে। পরে একাধিক পরিবর্তনের পর ওয়ার্ড কমে হয় ২৫০। যদিও গত নির্বাচনে প্রায় ১৮০-র বেশি ওয়ার্ডে বিপুল জয় পায় বিজেপি। রাজ্যে আম আদমি দলের সরকার থাকলেও দিল্লির পুরসভায় এতদিন ছিল বিজেপি-রাজ।

কেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ওপর ভরসা রাখলেন দিল্লির পুর এলাকার বাসিন্দারা? কেন এই জয়? আম আদমি দলের পক্ষে দিল্লির পুর এলাকার মানুষের ভরসার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।

অনুন্নয়ন এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা
রাজ্যে আপ। পুরসভায় বিজেপি। রাজ্যের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একাধিক উন্নয়নের ক্ষেত্র নিয়ে সমন্বয়ের অভাবের অভিযোগ ওঠে বারবার। অন্যদিকে রাজ্যের সরকার এবং বিপুল প্রচারে কেজরিওয়াল উদ্যোগের প্রচারে খানিকটা কোণঠাসা হয়ে যায় বিজেপি। অনেকেই বলেন, ওয়ার্ডের মানুষ দেখছেন উন্নয়নে হাত রয়েছে কেজরিওয়াল সরকারের। তাহলে বিজেপি কেন! দুই জায়গায় ভিন্ন নয়, উন্নয়নের জন্য, বাধা দূরের জন্য পুরসভায় আম আদমি দলের প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই মূলত ভোট হয় ওই এলাকায়।

আবার রাজ্যের ক্ষমতায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল থাকলেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাজকর্মে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছিল ওই এলাকায়। শহুরে এবং পরিযায়ী শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় সার্বিকভাবে কেন্দ্র সরকারের একাধিক নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বারবার। যার প্রভাব পড়েছে একাধিক ক্ষেত্রে।

'বিচ্ছিন্ন জনপ্রতিনিধি'
প্রায় ১৮৪ ওয়ার্ডের বিজেপি জনপ্রতিনিধির কাছ থেকেই নানা অভিযোগ উঠত বারবার। বস্তি থেকে শুরু করে দরিদ্র শ্রেণির জনতার সঙ্গে দুর্ব্যবহার থেকে শুরু করে একাধিক ক্ষেত্রে শংসাপত্র দেওয়া নিয়েও গড়িমসি। অভিযোগ উঠত বারবার। একেবারে তৃণমূলের স্তরের ইস্যু নিয়ে হওয়া এই নির্বাচনে তাই এই বিষয়টিও উল্ল্যেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। যা আপের কাছে হয়ে দাঁড়ায় অন্যতম নির্বাচনী ইস্যু।

কেজরিওয়াল-ফ্যাক্ট
দিল্লির পুর নির্বাচনের আম আদমি দলের বিপুল জয়ে সর্বাধিক ভূমিকা নিয়েছে 'মাফলার ম্যান' ক্রেজ। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একাধিক নীতি, সরকারের উদ্যোগ প্রভাবিত করেছে পুরসভা এলাকার মানুষকে।

মহল্লা ক্লিনিক
২০১৫ সালে দ্বিতীয়বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর আসন লাভের পরেই স্বাস্থ্য পরিষেবায় নজিরবিহীন উদ্যোগ নেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। রাজ্যের স্বাস্থ্য বিষয়ক উন্নতি সাধনে একের পর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। শুরু করেন 'মহল্লা ক্লিনিক'। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, মহল্লায় মহল্লায় সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খোলা হয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র। যেখানে ন‍্যূনতম পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সরকার। যেখানে একেবারে তৃণমূল স্তরের মানুষের স্বাস্থ্যের নূন্যতম পরিষেবা দিতে সচেষ্ট হন অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা। দিল্লি জুড়ে ক্রমেই তৈরি হয় কয়েক হাজার মহল্লা ক্লিনিক।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র
দিল্লির স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিপ্লব আনে ২০১৯ সাল। তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার আগের বছরেই কেজরিওয়ালের উদ্যোগে রাজধানীতে চালু হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। যা ১৯৪৬-র 'ভোরা কমিটি'র রিপোর্ট অনুযায়ী তৈরি করে দিল্লির সরকার। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবেও নজির গড়েন অরবিন্দ। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা থেকে প্রসব, ছোটখাটো অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে ভর্তি রাখার ব্যবস্থা। সর্বক্ষণ চিকিৎসক। সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে আসে এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র। মেডিক্যাল কলেজ অথবা বড় হাসপাতাল নয়, প্রাথমিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে হয়ে ওঠে কেজরিওয়ালের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

বিনামূল্যে বিদ্যুৎ
আপ সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়, মাসিক ২০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ না ব্যয় করলে বিনামূল্যে পরিষেবা পাবেন জনতা। অর্থাৎ ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ফ্রি, ঘোষণা করে দিল্লি সরকার।

শিক্ষা
সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার রূপায়ণে নয়া নজির সৃষ্টি করেন কেজরিওয়াল। দিকে দিকে তৈরি হয় মডেল স্কুল। দরিদ্র শ্রেণীর শিশুদের জন্য শিক্ষার মডেল স্থাপন করে আপ সরকার।

বিনামূল্যে জল
প্রতি পরিবারের জন্য বিনুলির পানীয় জলের ব্যবস্থাও করে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার। প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার লিটার জলের বন্দোবস্ত হয় দিল্লিজুড়ে।

বিনামূল্যে বাস
মহিলাদের জন্য বিনামূল্যে বাস পরিষেবার কথা ঘোষণা করে দিল্লি সরকার। দেশের মধ্যে একাধিক নজির স্থাপনের মতোই এই ক্ষেত্রেই ইতিহাস সৃষ্টি করেন কেজরিওয়াল। গোলাপি টিকিটের ব্যবস্থা হয় মহিলাদের জন্য। যা বিনামূল্যে চড়াবে বাস।

নারী নিরাপত্তা
দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের ভয়ানক স্মৃতি কাঁপিয়ে দিয়েছিল দেশ। সেই স্মৃতিকে মলিন করেই আপ সরকার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নজর দিতে শুরু করে প্রথম থেকেই। গণপরিবহনে সিসিটিভি নজরদারি থেকে শুরু করে একাধিক ঘটনায় তড়িঘড়ি ব্যবস্থা। রাজ্যের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

শ্রমিক-দরদি কেজরিওয়াল
লকডাউন থেকে শুরু করে করোনাকাল। সাম্প্রতিক বায়ুদূষণে নির্মাণকাজ বন্ধ হওয়ার সময়ও বারবার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বায়ু দূষণে নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণ শ্রমিকদের ৫ হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেন তিনি।

একাধিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের জনদরদী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং তার প্রভাব থেকে বাদ যায়নি পুর এলাকা। আর সেই সূত্রেই কেজরিওয়ালে মজেছেন জনতা। আর তার প্রভাবই পড়েছে এই নির্বাচনে। যদিও পুর নির্বাচনে গত ২০১৭-র তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ ভোট বেড়েছে বিজেপি-র। যা-ও আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে আপের।

২০১৩ নাগাদ প্রথমবার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নতুন দল ক্ষমতায় বসে দিল্লির। বাইরে থেকে কংগ্রেসের সমর্থনে ক্ষমতা লাভের কিছুদিনের মধ্যেই মোহভঙ্গ হয়। মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন আপ-প্রধান। ভেঙে যায় দিল্লির সরকার। সমস্যা তৈরি হয় 'জন লোকপাল বিল' নিয়েও। ফের ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় নির্বাচন হয় ২০১৫ সালে। প্রায় ৬৭ আসনে জিতে ঝড় তোলেন কেজরিওয়াল। লোকসভার মোদি ঝড় থেমে যায় দিল্লিতে। ক্ষমতায় এসে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন কেজরিওয়াল। ফের ২০২০ সাল। ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় ৬২ আসনে জিতে আবার ক্ষমতায় আসেন কেজরিওয়াল। হন মুখ্যমন্ত্রী। এদিকে একাধিক রাজ্যেও শক্তি বাড়ায় আপ। পাঞ্জাবে ক্ষমতায় আসে আম আদমি দল।

ক্রমশ দেশজুড়ে বিস্তার লাভ করছে আপ। একাধিক আঞ্চলিক দলের আবহেও মোদিবিরোধী মুখ হিসেবে উঠে আসছে তাঁর নাম। আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে পুর এলাকায় এই জয় আবার প্রথমবার গুজরাত বিধানসভায় প্রার্থী দিয়েই কয়েকটি আসন ছিনিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া অরবিন্দের জন্য ভালো খবর বলেই বলছেন অনেকেই। যদিও কেউ কেউ বলছেন, এসব ফ্রি পলিটিক্স অর্থাৎ পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির ফল। জনতাকে বশে রাখতে দেওয়ার রাজনীতি বলেই মনে করেন অনেকেই। যদিও আপের দাবি, ''উন্নয়ন শেষ কথা। সেটা ঠিকঠাক হলেই মোক্ষম লক্ষ্যপূরণ সম্ভব সহজেই।"

More Articles