চিনের যুদ্ধে হারের শোকে নেহরুর মৃত্যু! বাবার মৃত্যুর পর কোন কৌশলে নির্বাচনে জিতলেন ইন্দিরা?
Indira Gandhi Lok Sabha Election: ১৯৬৭ সালে ভুবনেশ্বরে একটি প্রচার অভিযানে অংশ নেওয়ার সময় ইটের আঘাতে রক্তাক্তও হতে হয়েছিল ইন্দিরাকে।
ভারত-চিন সীমান্ত সংলগ্ন ডোকালাম অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ১৯৬২ সালে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিল ভারত এবং চিন। বর্তমানে অঞ্চলটি ভারতের অন্তর্গত হলেও, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। আর সেই যুদ্ধে হারের পরেই, অনুশোচনায় দগ্ধে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরোগকে চিহ্নিত করা হলেও, আসল মৃত্যুর কারণ ছিল কিন্তু ভিন্ন। চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা নেহরু যখন দেখলেন, চিন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তা নেহরুকে একেবারে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। নেহরুর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে একাধিক, তবে নেহরুর মৃত্যুই ভারতের রাজনীতিকে নিয়ে গিয়েছিল এক অন্য দিকে। নেহরুর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে উত্থান ঘটেছিল তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধির।
১৯৬৪ সালের মে মাসে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর, কংগ্রেস তখন একেবারে দোটানায় পড়ে। নেহরুর দুর্দান্ত ক্ষমতা ছিল দলের সর্বস্তরের নেতাদের ধরে রাখার। নেহরু চিরকালই ছিলেন কংগ্রেস দলের প্রধান প্রাণপুরুষ। ফলে, তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নেহরুর গুণগুলি থাকাও ছিল স্বাভাবিক। উত্তরাধিকারের দৌড়ে ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেসের অন্যতম দুই মুখ, পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ মোরারজি দেশাই এবং অপেক্ষাকৃত নবীন, কৌশলী ও মৃদুভাষী লালবাহাদুর শাস্ত্রী।
হিসেব মতো, সেই সময় মোরারজি দেশাইয়ের হাতেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব যাওয়ার কথা ছিল, তবে যেহেতু অতুল্য কুমার ঘোষ এবং কে কামরাজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না, তাই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হস্তান্তরিত হলো লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর হাতে। ভালোভাবেই ভারতের রাজ্যপাট সামলাচ্ছিলেন তিনি। জয় জওয়ান জয় কিষাণ স্লোগানে সারা ভারতকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলার কাজও ভালোভাবেই করেছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। কিন্তু ১৯৬৬ সালে তাসখন্দে তাঁর রহস্য মৃত্যু ভারতের ভবিষ্যৎকে আরও একবার প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দেয়। আবারও উঠে আসে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। তবে সেবার, শুধুমাত্র মোরারজি দেশাই নন, উত্তরাধিকারের দৌড়ে নাম লেখান পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরাও। সেই লড়াইতেও মোরারজি দেশাইকে হারিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন ইন্দিরা গান্ধি। ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই কংগ্রেসের রাজনৈতিক গঠন পরিবর্তন করে ফেলেন ইন্দিরা। তাঁর হাত ধরেই, কংগ্রেসে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে যা পরবর্তীতে ভারতের রূপরেখা পরিবর্তনেও প্রধান ভূমিকা পালন করে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির প্রথম নির্বাচন কেমন ছিল?
১৯৬৭ সালের নির্বাচন ছিল কংগ্রেস এবং ইন্দিরা গান্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচন। হতাশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে সেই সময় প্রবল দুর্দিন ভারতের। অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি থেকে শুরু করে, মুদ্রাস্ফীতি, বিহারে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সহ ১৯৬৬-৬৭ সালের খরা সেই সময় ভারতের আর্থিক পরিস্থিতি একেবারেই দুর্বল করে দিয়েছিল। বেশ কিছু রাজ্যে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করে ১৯৬৬-এর শেষের দিক থেকে। ১৯৬৬-৬৭ অর্থবর্ষে ভারতকে কুড়ি মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছিল অন্য দেশ থেকে। ৪ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ভারত সরকারের উপর। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা সেই সময় ভারতের আর্থিক পরিস্থিতিকে কঠোর হাতে সামলানোর পরিকল্পনা করলেন। আর সেটাই হয়ে ওঠে ১৯৬৭ সালের ভারতের সবুজ বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ। এই পরিবেশে, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রেখে, সহিংস আন্দোলন দমন করে ১৯৬৭ সালে নির্বাচন পরিচালনা করা ছিল ভারত সরকারের পক্ষেও এক বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ।
ষাটের দশকের শেষ দিকের ভারত অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটাই উত্তাল। একের পর এক হিংসার ঘটনায় নির্বাচনী প্রচার অভিযান ব্যাহত হতে শুরু করেছিল সেই সময়। এমনকী, ১৯৬৭ সালে ভুবনেশ্বরে একটি প্রচার অভিযানে অংশ নেওয়ার সময় ইটের আঘাতে রক্তাক্তও হতে হয়েছিল ইন্দিরাকে। পরবর্তীতে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে, কোনওভাবে সেই ক্ষত মুছে ফেলেন ইন্দিরা। বিপরীতে, সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা মধু লিমাইকে রাস্তায় ফেলে মারধর করে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস কর্মীরা। এখানেই শেষ নয়, কংগ্রেস এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত রাজনৈতিক দলগুলির উপরে নেমে আসে একাধিক আক্রমণ। কংগ্রেস নেতা কে কামরাজের উপরেও একাধিক বার হামলা হয়। ১৯৬৭ সালের নির্বাচন ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছেও ক্রমেই কঠিন হয়ে ওঠে।
সারা ভারতে তখন ৫২০টির মধ্যে ২৮৪টি আসনে জয়লাভ করে কংগ্রেস দল ১৯৬৭ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে। তবে ১৯৬২ সালের ৩৬০ টি আসনের তুলনায় তা ছিল অনেকটাই কম। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং কেরলের বহু জেতা আসনে পরাজিত হয় কংগ্রেস। বাংলায় সেই সময় বাম রাজনীতির উত্থান ঘটছিল তীব্র গতিতে। অতুল্য ঘোষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় প্রদেশ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা কংগ্রেস গঠন করেছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। ১৯৬৭ সালে সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় সংখ্যক আসন হারায় কংগ্রেস। বিহার, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, পঞ্জাবে চরম দুর্ভিক্ষের কারণে অনেকেই কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে ঘরে-বাইরে সেই সময় নিদারুণ সমস্যায় ইন্দিরা গান্ধি। কংগ্রেসের দীর্ঘ ২ দশকের একচেটিয়া রাজত্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে।
সারা ভারতে সেই সময় তৈরি হয় কংগ্রেস বিরোধী বড় হাওয়া। আর সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়েনি কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও। বিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দল একসঙ্গে জোট করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যৌথ সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আসে। বিপদে পড়ে কংগ্রেস। কংগ্রেসের বিপরীত আদর্শের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল সেই সময় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। কংগ্রেস বিরোধী বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের উত্থান সেই সময় ছিল চোখে পড়ার মতো। এগুলোর মধ্যে অন্যতম জনসংঘ, স্বতন্ত্রতা পার্টি, সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টি, দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম ওরফে DMK, প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং বামপন্থী কিছু রাজনৈতিক দল। হরিয়ানাতে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জনসংঘ। মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশেও জনসংঘের উত্থান ঘটে একেবারে ঝড়ের গতিতে। কংগ্রেসকে হারিয়ে ওড়িশা বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে স্বতন্ত্রতা পার্টি। কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা বেরিয়ে যাওয়ার পুরো দায়ভার গিয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার কাঁধে।
আরও পড়ুন- ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, ইন্দিরার হাতেই শেষও হয়ে যান! কে ছিলেন কামরাজ?
লোকসভায় ৫৬ শতাংশ আসন কংগ্রেসের হাতে থাকলেও, কংগ্রেসের বড় মুখরা একে একে পরাজিত হতে শুরু করেন তাঁদের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে। পশ্চিমবঙ্গে অতুল্য ঘোষ, অর্থমন্ত্রী শচীন চৌধুরী, তথ্য সম্প্রচার দপ্তরের মন্ত্রী রাজ বাহাদুর, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ এম থমাস, সবাই পরাজিত হন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে। এমনকী, ক্ষমতাচ্যুত হন কংগ্রেসের তিনজন মুখ্যমন্ত্রীও। বিহারের কেবি সহায়, পশ্চিমবঙ্গের প্রফুল্ল চন্দ্র সেন এবং তামিলনাড়ুর এম বখতাবৎসালাম পরাজিত হন নিজেদের বিধানসভা কেন্দ্রে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, তামিলনাড়ুতে তারপর থেকে আর কোনওদিনও বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেনি কংগ্রেস। হিন্দি বিরোধী প্রচার করে তৎকালীন তামিল ছবির সব থেকে জনপ্রিয় নায়ক এম জি রামচন্দ্রনকে নিয়ে তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে সহজ জয়লাভ করে DMK।
লোকসভায় সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে, সরকার টিকিয়ে রাখতে পারলেও কংগ্রেসের সমস্যা মেটেনি। বিশেষত মোরারজি দেশাই এবং ইন্দিরা গান্ধির দ্বন্দ্বের কারণে, পরবর্তীতে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল কংগ্রেস। কংগ্রেসের কিং মেকার কে কামরাজের ক্ষমতাও কমেছিল অনেকাংশে। পরে, দেশাই এবং ইন্দিরার বোঝাপড়া হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কংগ্রেস ভেঙে যাওয়ার পর, মোরারজি দেশাই আরও একবার লোকসভায় জয়লাভ করেন। সেই সময় সহকারী প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা সামলেছিলেন দেশাই। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধি। তবে কিছুদিন পরেই, ১৯৬৯ সালে মোরারজি দেশাইয়ের হাত থেকে দু'টি মন্ত্রকের ক্ষমতাই কেড়ে নেন ইন্দিরা। ফলে, বাধ্য হয়ে দল ছাড়তে হয় দেশাইকে। এই ঘটনার ৮ বছরের মাথায় তিনিই ইন্দিরাকে হারিয়ে হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী।
১৯৬৭ সালের এই নির্বাচন ইন্দিরা গান্ধির জন্য এক বিরাট মাইলস্টোন হিসেবে থেকে যায়। পাশাপাশি, তা কংগ্রেসের ভবিষ্যতকেও অনেকটাই পাল্টে দেয়। ১৯৬৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে ইন্দিরার দূরত্ব কংগ্রেসের বিভাজন ডেকে আনে। দু'টি দলে বিভক্ত হয় জাতীয় কংগ্রেস। ২০০ জন সাংসদের সমর্থন নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইন্দিরার। অন্যদিকে, মোরারজি দেশাই তাঁর সমর্থকদের নিয়ে গঠন করেন অর্গানাইজেশন কংগ্রেস। একেবারে ছোট রাজনৈতিক দলের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ইন্দিরা। অগত্যা নিজের কার্যকালের ১ বছর বাকি থাকতে না থাকতেই আবারও নির্বাচনের ঘোষণা করেন তিনি। সেই সুযোগ ভালোভাবেই কাজে লাগায় বিরোধী দলগুলি। কংগ্রেস বিরোধী জোট তৈরি করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয় বিরোধীরা। সরকার গঠন সম্ভব না হলেও, ভালোই সাফল্য ঝুলিতে আসে। ১৯৭১ সালের সেই নির্বাচনে আবারও জয়লাভ করেন মোরারজি দেশাই। তবে এবারে দেশাই কংগ্রেসের নযন। তিনি হয়ে ওঠেন বিরোধী দলনেতা, যা আবারও সমস্যায় ফেলে দেয় ইন্দিরা গান্ধিকে।