রাহুলের অভিযোগে কমিশনের অস্বীকার! জনগণ কাকে বিশ্বাস করবে?
Commission denies Rahul's allegations: রাহুল গান্ধী আগের সাংবাদিক সম্মেলনেও অভিযোগ করেছিলেন, তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে মেশিন পড়তে পারে এমন ভোটার তালিকা চাওয়া সত্ত্বেও তা তাঁকে দেওয়া হয়নি।
'ভোট চুরি' নিয়ে নির্বাচন কমিশনের উপর আরও চাপ বাড়িয়ে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী আবার সরাসরি অভিযোগ করেছেন, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার সচেতনভাবে এই ভোট চুরিতে মদত দিচ্ছেন। গতকাল দিল্লির ইন্দিরা ভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এই কথা বলেন। রাহুল বলেন, তাঁর কাছে এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ আছে এবং তিনি তাঁর দেশ ও সংবিধানকে শ্রদ্ধা করেন, ফলে প্রমাণ ছাড়া কোনো সাংবিধানিক সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কথা নয়। প্রথমে ইংরেজি ও পরে হিন্দিতে তিনি কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রের দু-টি বিধানসভায় কীভাবে বিরোধী ভোটারদের বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে, তা একটি পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে দেখান। ৪০ মিনিটের ওই সাংবাদিক সম্মেলনের পরে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, রাহুল গান্ধীর অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুয়ো, ভিত্তিহীন। শাসকদলের পক্ষ থেকে সাংসদ ও প্রাক্তন মন্ত্রী অনুরুাগ ঠাকুর একটি পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন যে রাহুল গান্ধী ভারতীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে চাইছেন।
শাসকদল বা নির্বাচন কমিশন যতই অস্বীকার করুক, রাহুল গান্ধীর সাংবাদিক সম্মেলনটি আবার নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আগামীতে ভারতীয় রাজনীতি এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি সাধারণ মানুষের সন্দেহ যে বাড়বে তা স্পষ্ট। গতকাল থেকে রাহুলের ওই সাংবাদিক সম্মেলনের নানা ছোট ছোট ক্লিপ মানুষদের মোবাইলে ঘুরছে। প্রত্যেকটি ক্লিপ ও রিল ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশন এবং শাসকদলের মাথাব্যথার কারণ হবে— এটা যে কোনো শিশু যেমন বুঝতে পারছে, তেমনই বিজেপির বিভিন্ন স্তরের নেতারাও আন্দাজ করতে পারছেন।
বিহারে ভোটার অধিকার যাত্রার শেষ দিনে রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, “অপেক্ষা করুন, এবার ভোট চুরি সংক্রান্ত আরও বড় কিছু আসছে।” তিনি বলেন, গত সাংবাদিক সম্মেলনটি যদি পরমাণু বোমা হয়, তাহলে পরেরটি হবে হাইড্রোজেন বোমা। সেই মতো ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় সময় দেওয়া হয় দিল্লির ইন্দিরা ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য। সাংবাদিকদের সকাল সাড়ে ন'টার মধ্যে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। সম্মেলনের প্রথমেই রাহুল বলেন— এটি হাইড্রোজেন বোমা নয়, তার প্রস্তুতি এখনও শেষ হয়নি এবং কোনো প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করা ঠিক নয়। তিনি জানান, গতবার তিনি ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটার অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ করেছিলেন; এবার প্রমাণ নিয়ে এসেছেন, কীভাবে বেছে বেছে বিরোধী ভোটারদের বাদ দেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তির সাহায্যে। তিনি আরও বলেছিলেন— নির্বাচন কমিশন জানে কোন জাতি, কোন ধর্মের মানুষ বিজেপিকে ভোট দেয় না। যে কথা তিনি বলেননি, তা হল এই বিষয়টা জানা যায় কী করে এবং কার কাছে এই তথ্য থাকলে কার সুবিধা হতে পারে?
আরও পড়ুন- মুছে ফেলা হচ্ছে বিরোধী ভোটারদের নাম! প্রমাণ সামনে আনলেন রাহুল গান্ধী
ভোটার অন্তর্ভুক্তির জন্য ফর্ম-৬, ভোটার বাদ দেওয়ার অভিযোগের জন্য ফর্ম-৭ এবং কোন বুথে কত ভোট পড়েছে তা জানতে ফর্ম-১৭সি দরকার। এবার ফর্ম-১৭সি দেখে যদি হিসাব করে বিরোধী ভোটারদের বাদ দেওয়া যায়, তাহলে বুথ দখল বা মারপিটের দরকারই পড়বে না। ঠিক এই অভিযোগটাই রাহুল করেছেন, এবং সেটি প্রমাণ-সহ দেখিয়েওছেন। সাংবাদিক সম্মেলনের মঞ্চে বেশ কিছু মানুষকে হাজির করে তিনি দেখিয়েছেন— কেউ কেউ নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে দাবি করেছেন, তাঁদের নামে ভুয়ো ফর্ম-৭ দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এবং তাঁদের নাম তালিকা থেকে কেটে ফেলা হয়েছে; তাঁরা বলছেন এটা প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হয়েছে। কিছু মানুষ স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁদের অজান্তেই এই কাজটি করা হয়েছে। রাহুল বারংবার বলেন যে যেসব মোবাইল ফোনে এই কাজ করা হয়েছে, সেগুলি কার— কর্নাটকের সিআইডি তা জানতে অন্তত ১৮টি চিঠি পাঠায় নির্বাচন কমিশনকে। তবে নির্বাচন কমিশন সে তথ্য দেয়নি। রাহুল সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, “মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কি সমস্ত কিছু জেনে বুঝে কাউকে আড়াল করতে চাইছেন? যদি তাই হয়, তবে কেন?”
রাহুলের এই মারাত্মক অভিযোগের পর নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক: তারা বলেছে, রাহুলের অভিযোগ ভুল ও ভিত্তিহীন; কোনো জনসাধারণের দ্বারা অনলাইনে ভোট মুছে ফেলা যাবে না; সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শুনানির সুযোগ না দিয়ে কোনো ভোটারের নাম মুছে ফেলা যাবে না; ২০২৩ সালে আলন্দ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার কিছু ব্যর্থ প্রচেষ্টা করা হয়েছিল এবং বিষয়টি তদন্তের জন্য নির্বাচন কমিশন নিজে একটি এফআইআর দায়ের করেছিল; রেকর্ডে দেখা যায় ২০১৮ সালে আলন্দে সুভাষ গুট্টেদার (বিজেপি) এবং ২০২৩ সালে বিআর পাটিল (কংগ্রেস) জয়ী হন।
তবে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্বাচন কমিশন দেয়নি, সেগুলোও রয়েছে—
১। যদি লুকোনোর কিছু নাই থাকে— তাহলে কেন কর্নাটকের সিআইডির ১৮টি চিঠিতে সাড়া দেয়নি, কোনো তথ্য নির্বাচন কমিশন সরবরাহ করেনি?
২। কীভাবে নির্দিষ্ট ব্যক্তিরাই সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করতে পারলেন যে তাঁদের নাম অজান্তে ব্যবহার করে অন্যদের নাম ভোটার তালিকা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে— তাঁরা কি মিথ্যা বলছেন?
৩। নির্বাচন কমিশন কেন সময়সীমা বেঁধে তদন্তের নির্দেশ না দিয়ে বিষয়টি স্থায়ীভাবে নিষ্পত্তি করছে না?
৪। নির্বাচন কমিশন কেন কর্নাটক পুলিশকে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে রেকর্ড করা 'নির্দিষ্ট আইপি অ্যাড্রেস' সরবরাহ করছে না?
রাহুল গান্ধী আগের সাংবাদিক সম্মেলনেও অভিযোগ করেছিলেন, তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে মেশিন পড়তে পারে এমন ভোটার তালিকা চাওয়া সত্ত্বেও তা তাঁকে দেওয়া হয়নি। তখন জ্ঞানেশ কুমার বলেছিলেন, মেশিন পড়তে পারে এমন ভোটার তালিকা দিলে যে কেউ নামগুলো সরিয়ে দিতে পারে। এবার আবার বলা হয়েছে, কেউ নাকি অনলাইনে এই তালিকায় পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে কোনটা সঠিক ?
আরও পড়ুন- কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ভোট জালিয়াতির অভিযোগ ভিত্তিহীন: নির্বাচন কমিশন
রাহুলের এই সাংবাদিক সম্মেলন কিন্তু বহু কথা সামনে নিয়ে আসছে। প্রথমত গোটা দশ বছর বিজেপি শাসনকালে এই প্রথমবার বিজেপি-বিরোধী একটি ভাষ্য তৈরি হচ্ছে, যা বিজেপিরবিতৈরি করা ভাষ্যের উপর নির্ভরশীল নয়। খুব সচেতনভাবে এই কাজটা করছেন রাহুল গান্ধী এবং তাঁর টিম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কংগ্রেস দলের অনেকেই বিষয়টা জানেন না এবং ঠারেঠোরে বলছেন এই ভোট চুরি দেখিয়ে কি নির্বাচনে কংগ্রেস জিততে পারবে? নির্বাচন কমিশন তো নিজেদের হিসেব মতো বিশেষ নিবিড় সংশোধনী করার নাম করে আইন করেই বিরোধী ভোটারদের বাদ দিচ্ছে বিহারে সেই অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। তাহলে কি লাভ হবে? আপাতভাবে মনে হতে পারে লাভ হবে না, কিন্তু লাভ হবে সেটার ইঙ্গিত কিন্তু ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। যখন গত নির্বাচনে, রাহুল গান্ধী বলেছিলেন সংবিধান বাঁচানোর কথা, তখন অনেকেই নাক সিঁটকে ছিলেন, এটা কোনোদিন নির্বাচনী ইস্যু হতে পারেনা। সিএসডিএস- এর সঞ্জয় কুমার অবধি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রাহুল ভুল বিষয়কে ধরে নির্বাচন জিততে চাইছেন, পরে তিনিই স্বীকার করেছিলেন তিনি বুঝতে পারেননি বিষয়টা এবং সংবিধান যে লড়াইয়ের হাতিয়ার হতে পারে, তা রাহুল দেখিয়ে দিয়েছেন এবং সেইজন্যেই বিজেপিকে ২৪০ আসনে আটকানো গেছে।
গণতন্ত্র এবং সংবিধান, এই দুটো শব্দই বেশ জটিল। কাজেই সংবিধান বাঁচানোর লড়াইটা সমস্ত মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক নাও মনে হতে পারে। কিন্তু, সেটাই এখন হচ্ছে। তার কারণ, সংবিধান এবং গণতন্ত্র আসলে বাঁচার অস্ত্র সেটা রাহুল প্রমাণ করছেন রোজ। এই সংবিধানে হয়ত অনেক বিষয় আছে যার সঙ্গে দৈনন্দিন লড়াইকে মেলানো আপাতভাবে কঠিন, কিন্তু রাহুল সেটাই করতে পেরেছেন। সংবিধান কী? এই প্রশ্নের এক কথায় অনেকেই উত্তর দেবেন ওঁ তো একটা নিয়মের বই, ও তো দৈনন্দিন কাজে লাগে না। কিন্তু কেউ যদি দেখাতে পারেন সংবিধান পিছিয়ে পড়া দলিত কিংবা মুসলমান মানুষের জন্য সংরক্ষণ করা এবং বাঁচার হাতিয়ার তখন মানুষ তাতে সাড়া দেবেন। ওই সাংবাদিক সম্মেলনটি ভালভাবে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাবে রাহুল গান্ধী বলতে চেয়েছেন, যে সমস্ত কমিউনিটির মধ্যে কংগ্রেসের সমর্থন বেশি, তাঁদের ভোট মুছে দেওয়া হচ্ছে। বলে দিতে হয় না, কংগ্রেসের বড় অংশের ভোটব্যাঙ্কের বড় অংশ দলিত-মুসলমান-আদিবাসী। অতএব গণতন্ত্র মুছে দেওয়া আসলে দলিত-আদিবাসী-মুসলমানের অধিকার মুছে দেওয়া। এই মিলিয়ে দেওয়ার কাজটি রাহুল গান্ধী করে ফেলেছেন গত ৫ বছর ধরে আর এটাই রাহুলের ভাবমূর্তির আমূল পরিবর্তন। এটাকেই বলে তত্ত্বের ফলিত প্রয়োগ, আর সেটাই রাহুল করে ফেলেছেন বলেই দেশের মানুষ নিজের অধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে দেশ বাঁচানোর লড়াইকে মিলিয়ে দিতে পারছেন, সেইজন্যেই এখন মোবাইলে মোবাইলে সাংবাদিক সম্মেলনের রিল ভাইরাল হচ্ছে।
রাহুল জানেন, তাঁকে যুব সমাজ পছন্দ করছে। তাই তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করছেন যুবকদের, ‘বলুন তো ৩৬ সেকেন্ডে কেউ অনলাইনে দুটো ফর্ম ৭ ভরে দিতে পারেন, তাও আবার ভোর ৪টে তে?’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন দেশের সমস্ত যুবসমাজের সঙ্গে। তবে রাহুলের এই লড়াইটা শুধু বিজেপি বা আরএসএস-এর বিরুদ্ধে নয়, কংগ্রেসের অন্দরেও রাহুলকে লড়াইটা দিতে হচ্ছে এবং সেটা খুব সহজ ও নয়। আসলে গত ১১ বছর পরে যে ভাষ্যটা রাহুল গান্ধী প্রায় একক প্রচেষ্টায় দাঁড় করাতে পেরেছেন তা বিজেপিকে বেশ বেগ দেবে তা বোঝা যাচ্ছে। কখনও কখনও এই রাহুলকে একা মনে হতে পারে কিন্তু তাঁর পাশে অদৃশ্য হয়ে পথ হাঁটছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁরাই আসলে রাহুলের শক্তি। তাঁরাই আসল কংগ্রেসের মানুষ। রাহুল গান্ধীর দেশ বাঁচানোর এই লড়াইয়ে তাঁরাই আসল সঙ্গী এবং এই লড়াই মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাহুল জিতবেন, এটা নিশ্চিত।

Whatsapp
