'ভোট চুরি' বা এসআইআর! নির্বাচন কমিশনের সেম-সাইড গোল?

Rahul Gandhi Likens 'Vote Chori': মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক হোক বা আগামীতে হরিয়ানা — ভোটার তালিকা বা কোথাও ইভিএম-এর কারচুপির অভিযোগ উঠলে সেটি যথাযোগ্য ভাবে খণ্ডন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

সাংবাদিক জীবনের শুরুতে প্রধান সম্পাদক একটি বাণী দিয়েছিলেন — একজন রিপোর্টারের কাছে দু'টি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এক) বাইলাইন অর্থাৎ প্রতিবেদনের সঙ্গে রিপোর্টারের নাম আর দুই) আডেন্টিটি কার্ড বা সংবাদ সংস্থার পরিচিতি পত্র। এই দুটি না থাকলে বা হারিয়ে গেলে বা অন্য কেউ কেড়ে নিলে সাংবাদিকের জীবনে অশেষ সংকট দেখা দেয়। ধীরে ধীরে এই কথার গভীর তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলাম। সাংবাদিক হোন বা অসাংবাদিক, ভিটে মাটির মতো একটি সর্বজনগ্রাহ্য পরিচিতি পত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেটি যখন কেউ কেড়ে নেয়, তখন সত্যিই সংকট তৈরি হয় যে কোনও ব্যক্তির জীবনে।

আধার কার্ড আসার আগে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্রই সর্বজনগ্রাহ্য একটি নাগরিকত্বের পরিচয় ছিল এই ভারতে। সরকারি অফিসে হোক বা বিমানবন্দর বা ট্রেনে যাত্রার সময় এটি নিজের পরিচয় প্রমাণের একটি উপায় ছিল। তার কারণ, ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে। ভোটার তালিকায় কারচুপি রুখতে স্বনামধন্য প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষনের নেতৃত্বে সচিত্র পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজটি শুরু করে কমিশন। সেই পরিচয়পত্র সবার কাছেই মান্যতা পায়।

কিন্তু ধীরে ধীরে আধারের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভোটার কার্ডের গুরুত্ব কমে গেল। এখন আধার একটি সর্বজনগ্রাহ্য পরিচয়পত্র। কিন্তু সেটি ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নয়।

বিহারের বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন করতে গিয়ে নিজেদের দেওয়া ভোটার কার্ডকেও কোনও ধর্তব্যের মধ্যে আনছে না নির্বাচন কমিশন। কারণ এই ভোটার কার্ড ইস্যু করার ক্ষেত্রেও প্রচুর জল মেশানো হয়েছে বলে প্রকান্তরে স্বীকার করছে কমিশন। তাই তো ভোটার তালিকা সংশোধনের এই বিশেষ অভিযান। নতুন করে যাচাই করতে হচ্ছে কে ভোটার বা কে ভোটার নয়।

এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের দৌলতে দু'বার ভাবতে হচ্ছে যে, যাঁদের পাসপোর্ট নেই, তাঁরা নিজেকে ভারতের নাগরিক বলে কী দিয়ে প্রমাণ করবেন! কারণ সুপ্রিম কোর্টে নির্বাচন কমিশন বলে দিয়েছে (যা একপ্রকার সত্যি) যে, আধার কার্ড ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নয়। আর ২০০৩ সালের পর যাদের নাম ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছে, তাদের যে সব নথি দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম টিকিয়ে রাখতে হবে, সেই নথি দেওয়ার ক্ষেত্রেও যে জল মেশানো হয়নি তার প্রমাণ কোথায়?

আরও পড়ুন- মোদিকে সিংহাসনে রাখতেই জাল ভোটার তালিকা?

অথচ ভোটার তালিকা সংশোধনের এই নিবিড় অভিযানের প্রক্রিয়া এক দিক থেকে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ নেওয়ার প্রক্রিয়া। কারণ, সুপ্রিম কোর্টেই ভারতের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩২৬ নম্বর ধারায় লেখা রয়েছে যে, শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকেরাই ভোটার হিসেবে তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে পারেন। এই ধারার বলেই তারা নথিভুক্ত ভোটারদের থেকে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইছেন। যে নথির তালিকা তাঁরা দিয়েছিলেন নিজেদের নির্দেশিকার সঙ্গে (যার সঙ্গে পরে সুপ্রিম কোর্ট আধার কার্ডও জুড়ে দিয়েছে)।

ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কাজে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৬৫ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। তার মানে আপাতত এই ৬৫ লক্ষ সাবেক ভোটার নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি। তাহলে কী তাঁরা আর ভারতীয় রইলেন না!

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বিহারে এই প্রক্রিয়ায় অনেক জীবিত ভোটারকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আবার অনেকের হাতে ভোটার কার্ড থাকলেও এবং তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হলেও, তাঁদের নামও বাদ পড়ে গেছে। এই নিবিড় সংশোধনীর কাজটি করার জন্য নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতিনিধিদের প্রত্যেকটি বাড়িতে বাড়িতে যেতে বলেছিল। সেখানে গিয়ে ফর্ম বিলি করার কথা ছিল প্রতিনিধিদের। সেখানেই এক প্রকার যাচাই করে নেওয়ার কথা ছিল যে, কে সত্যিকারের ভোটার বকলমে ভারতীয় নাগরিক। জনগনণার সময়েই সাধারণত এই ধরনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণনার কাজ হয় (যে জনগনণা অবশ্য ২০১১ সালের পর আর হয়নি)। অনেকেই কর্মসূত্রে হয়ত বাড়িতেই নেই, আর তাদের বন্ধ বাড়ি দেখে অনেক জায়গায় সঠিক তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আবার কেউ হয়ত এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র, কিন্তু সেই এলাকার ভোটার তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দিয়ে বর্তমান বাসস্থানের ঠিকানায় ভোটার তালিকায় নাম তোলেননি। তাদের নামও বাদ গেছে এই প্রক্রিয়ায়। উল্টোদিকে এই সংশোধনীর কাজ এত দ্রুত করতে হয়েছে, যে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি অফিসারদের নাভিশ্বাস উঠেছে। তাড়াহুড়ো করার ফলেও যে ভুল থেকে যায়নি খসড়া ভোটার তালিকায় তাই বা কে বলতে পারে!

কিন্তু মোদ্দা কথা হল, এই ধরনের ভুলচুকের কারণে কত বৈধ নাগরিকের 'নাগরিকত্ব' নিয়েই তো প্রশ্ন উঠে গেল। তাঁদের এখন অস্তিত্বের সংকট! তাঁদের কী ঝক্কিই না পোহাতে হবে এটা প্রমাণ করতে যে, তাঁরা বৈধ ভারতীয় নাগরিক। একেই ভোটার কার্ডকে নির্বাচন কমিশনই বৈধতা দিচ্ছে না, তার উপর ভোটার তালিকা থেকেই নাম চলে গেল। আর আধার কার্ড তো ভারতীয় নাগরিকত্বের পরিচয়পত্রই নয়। অন্য কোনও নথি যদি না থাকে বা বন্যার জলে সত্যিই ভেসে যায়, তাহলে তাঁদের কী হবে?

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে যাঁরা বৈধ ভোটার কিন্তু নাম বাদ চলে গেল, তাঁরা আবার আবেদন করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য কখনই বৈধ ভারতীয় ভোটারদের ভোটদান থেকে বঞ্চিত করা হতে পারে না। বরং বছরের পর বছর যাতে ভোটাধিকারের বয়স পেরোলেই নতুন ভোটাররা নাম নথিভুক্ত করতে পারে, তার উদ্যোগই নিয়ে এসেছে নির্বাচন কমিশন। আজ তারাই নিজেদের দেওয়া পরিচয়পত্র যেটা দেখিয়ে এতগুলো ভোট দিয়ে এলেন ভোটাররা, সেটাই একপ্রকার 'বাতিল' করে দিল। তাহলে কী নিজেদের গুরুত্ব নিজেরাই খাটো করে দিল না এই সাংবিধানিক সংস্থা?

একটি রব তোলা হয়েছে যে এই নিবিড় সংশোধনীর প্রয়োজন নাকি হয়েছে যে বিহারে অবৈধ ভাবে প্রচুর বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। তারা নাকি ভোটার তালিকায় নামও তুলে ফেলেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই যে বাদ পড়া ভোটারদের মধ্যে কতজন অবৈধ বাংলাদেশী বা রোহিঙ্গা। কিন্তু সন্দেহের বাতাবরণে বাদ পড়া ভোটারদের অনেককেই অকারণেই বাংলাদেশী বা রোহিঙ্গা বলা হতে পারে। বিশেষত সেই নাগরিক যদি মুসলমান সম্প্রদায়ের হন এবং তার নামটি ভোটার তালিকা থেকে ভুল বশত বাদ পড়ে গিয়ে থাকে, তবে তো কথাই নেই। এই বিভাজনের দায় কে নেবে?

শুধু তো বিহার নয়, এর পর পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হওয়ার কথা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর কাজ। এ রাজ্যে এই বিভাজন মারাত্মক আকার নিতে পারে। যদিও নির্বাচন কমিশনের কাজ ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া নয়, কিন্তু তারা এক প্রকার সেই কাজটিই করছে। তবে কি ভোটের রাজনীতিতে ভারতের নির্বাচন কমিশনও জড়িয়ে গেল!

আরও পড়ুন- ভোটার অধিকার যাত্রা বুঝিয়ে দিল মোদি বিরোধিতার প্রধান মুখ রাহুলই

ইতিমধ্য়েই লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই যে ভোট চুরির অভিযোগ করেছেন এবং তাঁর অভিযোগের পক্ষে যে তথ্য তুলে ধরেছেন, নির্বাচন কমিশন কিন্তু সরাসরি সেই অভিযোগের জবাব দেয়নি। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক হোক বা আগামীতে হরিয়ানা — ভোটার তালিকা বা কোথাও ইভিএম-এর কারচুপির অভিযোগ উঠলে সেটি যথাযোগ্য ভাবে খণ্ডন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তারা কখনই রাজনৈতিক নেতাদের মতো প্রতি-আক্রমণের রাস্তায় হাঁটতে পারেন না। অথচ মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সাংবাদিক সম্মেলনে সেই সুরই শোনা গেছে।

আমরা জানি যে, নির্বাচন কমিশনার বেছে নেওয়ার জন্য যে কমিটি রয়েছে, সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে এবং সরকারি প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে এই সরকার নির্বাচন কমিশনকে সন্দেহের আওতায় এনে ফেলেছে এই সরকার।

বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে সত্য়িই ভুয়ো ভোটার বের করা যাক বা না যাক, অতি সামান্য বাংলাদেশী বা রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা যাক বা না যাক, নির্বাচন কমিশন যে কাজে হাত দিয়েছে এবং সমস্ত অভিযোগের মোকাবিলা যে ভাবে করছে তাতে একটি সাংবিধানিক সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে কমে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ভারতীয় গণতন্ত্র — যা নিয়ে আমরা গর্ব করি — তার অন্যতম রক্ষাকর্তা নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সেই সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই যদি প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ভারতের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। এর দায় শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলির দিকে ঠেলে দিলে হবে না। কমিশনের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখা বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে।

নিজেদের দেওয়া ভোটার কার্ডকেই প্রামাণ্য নথি হিসেবে গণ্য করতে অস্বীকার করে ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশন সেম-সাইড গোল করে বসে রয়েছে। 'ভোট-চুরি'র অভিযোগকেও রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা না করে, একটি সাংবিধানিক সংস্থার মতো করে দেখলেই ভাল।

নয়ত, আগামী দিনে ভারতের গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুখবর অপেক্ষা করে নেই। বরং দেশের মধ্যে আরও বিভাজন বাড়বে। অরাজকতা সৃষ্টি হবে।

More Articles