"খরচ জোটাতে টোটোও চালিয়েছি" : কথাবার্তায় উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় আবু সামা
HS Second Abu Sama Interview: হেরে যাওয়ার কথা ভেবেছি। বহুবার নিজেকে শেষ করার কথাও ভেবেছি! পারব না আমি- একথাও মাথায় এসেছে মাঝে মাঝেই!
এভাবেও ফিরে আসা যায়! হেরে যেতে যেতেও বাঁচা যায় নতুন করে! লড়াই করে যুদ্ধজয় হয় নিরন্তর! এবছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী আবু সামাকে নিয়ে বারবার অনুরণিত হতে পারে এই কথাই! উত্তর দিনাজপুরের নিজামপুরের নিশিন্দ্রা আবু সামা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পেয়েছেন মোট ৪৯৫ নম্বর। শতকরা ৯৯ শতাংশ নম্বরসহ রাজ্যে যুগ্মভাবে দ্বিতীয় হয়েছেন তিনি। কিন্তু এই মেধাবীর নাম প্রকাশ্যে আসতেই তোলপাড় হয়েছে সোশ্যাল দুনিয়া। মুহূর্তেই তাঁর বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। আবুর কয়েকটি কথা ছড়িয়ে পড়েছে ঝড়ের বেগে। তবুও শত শত টিউশনের ভিড়েও মৌলিক এই পরীক্ষার্থী! নুন আনতে পান্তা ফুরনো দিন, আধপেটা খাওয়া থেকে শুরু করে সংসার চালাতে চরম লড়াই- সবকিছু ছাড়িয়ে আবু হয়ে উঠেছেন মৌলিক, এক অনন্য ব্যক্তিত্বও! আবু সামার সঙ্গে কথা বলল ইনস্ক্রিপ্ট। প্রথম আলাপচারিতায় উঠে এল তাঁর ইচ্ছা, সোশ্যাল দুনিয়ার না-জানা একাধিক লড়াইয়ের কথা! প্রকাশ্যে প্রথম তিনি জানালেন তাঁর জীবনের অন্য কথাও।
পরীক্ষায় এত ভালো ফলের জন্য শুভেচ্ছা। কিন্তু মেধাতালিকায় এত জনের মধ্যেও আপনিই ভাইরাল! কেন জানেন?
আবু- (খানিকটা বিস্ময় প্রকাশ করে) হ্যাঁ দেখেছি। জানেন তো, আমি ভীষণ অবাক হয়েছি এসব দেখে! কী বলেছি, আর কী ব্যাখ্যা হলো আমার কথার! আমি প্রতিবাদী সত্তার প্রকাশ করতেও চাইনি, আবার অহংকার দেখাতেও চাইনি। শুধু আমার মনের কথাটুকু বলেছি।
সেদিন কী বলেছিলেন আদতে?
আবু- আসলে আমাকে বারবার প্রশ্ন করা হচ্ছিল। সামনে একাধিক সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা। আমার পিছনে সেদিন অনেকেই ছিলেন যাঁরা জীবনেও আমার খোঁজ নেননি! ওই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলি, ভেবেছি কী করব। কিন্তু এখনই বলতে চাই না!
কারণ?
আবু- কারণ, আমি চাইনি আমাকে নিয়ে আবার সমালোচনা হোক। আমার মনের কষ্ট বাড়ুক। আমি ফের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হই, কখনও চাইনি এমন!
কেন বলছেন একথা? কীসের সমালোচনা?
আবু- আমি উত্তর দিনাজপুরের যে অঞ্চলে থাকি, এখানে শিক্ষার লেশমাত্র নেই। কখনও নিজের এগিয়ে যাওয়ার পথেও কারও দ্বারা অনুপ্রাণিত হইনি। বরং, অনেকেই বলেছেন, এসব করে আর কী হবে! হেসেছেন বহু মানুষ! সেই হাসির খোরাক আর হতে চাইনি। সমালোচনার শিকার হতে চাইনি!
তাহলে?
আবু- আমি উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিয়েছি গোপনে। কাউকে বলিনি কখনও। পরবর্তীকালে কী হবে, সেটাও বলিনি। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াচ্ছি; একথা শুনতে চাইনি আর যা বারবার আমাকে ঠেলে দিয়েছে মনের অন্ধকার দিকে!
আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী হিসেবে মোক্ষম জবাব সমাজকে, আলাপচারিতায় উচ্চমাধ্যমিকে সপ্তম স্মরণ্যা ঘোষ
এত প্রতিবন্ধকতা ছিল জীবনে, বলছেন সেকথা। তবুও এই আত্মবিশ্বাস পেলেন কীভাবে? কীভাবে করলেন অসাধ্যসাধন?
আবু- আপনি জানেন, আমার ঘরের দেওয়ালে এখনও একটি কাগজ লাগানো রয়েছে। সেখানে লেখা, আমি বোর্ডের সেরা হব। আর সেটা করে দেখাবই!
হ্যাঁ, ওই ছবিও ছড়িয়েছে। এই আত্মবিশ্বাস এল কীভাবে?
আবু- আমার ইচ্ছা। কিছু একটা করতেই হবে। করবই! আমি করে দেখাব। যতদিন না সেটা পারছি আমার ঘুম নেই! স্বপ্ন দেখিনি শুধু। স্বপ্নপূরণের জন্য চেষ্টাও করে চলেছি। তাই এই আত্মবিশ্বাস।
জীবনে আপনার বাবা-মায়ের সহযোগিতা তো ছিলই! কিন্তু বাকিরা, আপনার আত্মীয়, প্রতিবেশী?
আবু- বাবা বছর দুয়েক হল অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না আর। দাদা টুকটাক চাষবাস করেন। কী খাব রোজ, তারই ঠিক থাকে না আমাদের! আর গরিব ঘরের ছেলে হয়ে এত বড় স্বপ্ন দেখব? কেউ ছিলেন না পাশে!
তাহলে পড়াশোনার খরচ?
আবু- আমি প্রথমত বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, আমাদের এই বাড়িটি বিক্রি করে দেবেন, তবুও আমাকে পড়াবেন! আমি করতে দিইনি। আর্টস নিয়েছি। পরে বুঝেছি আমার স্বপ্নপূরণের জন্য আর্টস নিলেই হবে। সায়েন্স লাগবে না!
যখন এই প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন, কেউ কোনও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি?
আবু- না! স্কুলে বরাবর প্রথম হতাম আমি। কাছাকাছি সায়েন্সের জন্য তেমন কোনও ভালো স্কুলও ছিল না। শিক্ষকরা এমনি পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহায্য করেছেন। কিন্তু সেইভাবে কারও কাছ থেকেই কোনও আর্থিক সাহায্য পাইনি যা আমার ভীষণ প্রয়োজন ছিল বা এখনও রয়েছে।
এখন এই সাফল্যের পর কোনও পরিবর্তন?
আবু- (হেসে) আমার বাবা, মা, পরিবার ফলাফল প্রকাশের পরে বুঝতেই পারেননি আমি রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছি! এবার বুঝে দেখুন, আমার গ্রামেও এর কোনও বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই! তাই যা করতে হবে আমাকে নিজেকেই!
তাহলে আগামীর আইপিএস আবু সামা?
আবু- আশীর্বাদ করুন। ইচ্ছার কথা যখন জানিয়েছি, পুলিশের সর্বোচ্চ পদে বসব। এই স্বপ্নও পূরণ করব। হ্যাঁ আমি আইপিএস হব! লড়াই চালিয়ে যাব শেষ পর্যন্ত।
কেন এই ইচ্ছা?
আবু- আমার লক্ষ্য সামাজিক সম্মান, মর্যাদালাভ আর সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করা!
কেন? সম্মান, মর্যাদার কোনও ঘাটতি আছে?
আবু- মারাত্মক! আপনি জানেন না, গরিব বলে যে কী অসহায়তা গ্রাস করত মাঝে মাঝে। স্বপ্ন দেখতেও ভয় লাগত! পারব তো? অসম্মান, সমালোচনা, একজন অতি সাধারণ ঘরের ছেলে হয়ে উচুঁতে উঠতে নেই; সব পেয়েছি এতদিন!
তবুও লড়াই করছেন! কীভাবে সম্ভব হয়েছে সবটা?
আবু- আপনাদের প্রথম বলছি। জানেন, আমি বহুদিন আগে থেকেই টোটো চালিয়েছি মাঝে মাঝেই। পড়াশোনার সঙ্গে এই কাজটাও করেছি। আমার এক জামাইবাবুর কাছ থেকে টোটো নিয়ে কাজ করেছি। আয় করে নিজের পড়াশোনার পিছনে ব্যয় করেছি! চাষের কাজেও কখনও অংশ নিয়েছি। অন্যান্য কাজও করতে হয়েছে। শুধুই পড়তে পারিনি!
মেধাবী ছাত্র। এত স্বপ্ন! তবুও এই পরিস্থিতি কেন হলো?
আবু- অর্থের চরম অভাব! ঠিক করে খেতেও আমাদের কষ্ট হতো। জুটত না তেমন কিছুই। তবুও লড়েছি। কিন্তু জানেন তো...
কী?
আবু- এরপরেও হেরে যাওয়ার কথা ভেবেছি। বহুবার নিজেকে শেষ করার কথাও ভেবেছি! পারব না আমি- একথাও মাথায় এসেছে মাঝে মাঝেই!
কী বলছেন? আপনি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা! আর আপনিও হেরে যাওয়ার কথা বলছেন?
আবু- এখন ওইসব ভাবি না। কিন্তু একটা সময় এমন ভাবনাও এসেছিল। করিনি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও এগিয়েছি আবার!
লড়াইয়ে ফেরা?
আবু- একাদশে আমার কয়েকদিন টিউশন ছিল। অর্থের অভাবে আর পারিনি। বাবাকেও চাপ দিইনি। নিজে নিজেই পড়েছি বাড়িতে। কিন্তু ভাবুন, আমার কিন্তু মনের জোর ছিল রাজ্যে প্রথম আমি হবই হব! আর এই মনের জোরকে সম্বল করেই লড়াইয়ে ফিরেছি।
লড়াই তো জিতেছেন! রাজ্যে কলা বিভাগে আপনিই সম্ভবত সেরার সেরা। প্রথম হয়েছেন!
আবু- হ্যাঁ। আমার ইতিহাস, ভূগোল, বাংলাসহ বাকি সব বিষয়ের প্রতিই ঝোঁক ছিল। শুধু চাইতাম, যা যা বাধা আছে সব দূরে সরিয়ে রেখে চেষ্টা আমি করবই। তারপর যা হওয়ার হবে! তবুও...
তবুও?
আবু- আমার বহু সহপাঠীদের অনেক টিউশন ছিল। ভয় লাগত। আমার নেই, পারব তো! তবুও চেষ্টা করতাম। জানি না, পড়াশোনাকে অস্ত্র করেই নিশ্চিত ছিলাম রাজ্যে স্থান আমার হবেই। প্রথম হইনি, একটু ভুল হয়তো ছিলই!
এই সাফল্যের পর কিছু বদলেছে? কোনও সাহায্যের আশ্বাস? চিন্তা কমেছে একটু?
আবু- না একটুও কমেনি। এখনও কিছু হয়নি। অনেকেই বলেছেন, তাঁদেরকে অসুবিধার কথা জানাতে। কিন্তু কী জানাব! আমার সব অসুবিধা তো প্রকাশ্যেই!
আরও পড়ুন- WBCS: স্বপ্ন দেখেন অনেকেই, জানেন না প্রস্তুতির এই প্রথম ধাপটুকুও
এরপর যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দেখা পান সরাসরি, কী বলবেন?
আবু- অবশ্যই বলব। অনেক কিছু জানানোর আছে। তাঁকে বলতে চাই, আমাকে লড়াইয়ে থাকতে সাহায্য করুন। সরকার আমার স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্রে সমস্ত বাধা কাটিয়ে দিক। আর্থিক সাহায্যের কথাও বলতে চাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে। আমি পড়াশোনা করতে চাই। হারতে চাই না।
বলছেন, আইপিএস হবেন। দায়িত্ব বাড়বে। অনেক কাজ আসবে তখন! দেশের জন্য বিশেষ কিছু করতে চাইছেন?
আবু- প্রথমেই শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকে, আমি অবশ্যই এই কাজটি করার চেষ্টা করব। আমার গ্রামের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবেই! নইলে অন্ধকার আরও ঘনিয়ে আসবে ক্রমশ!
কিন্তু শিক্ষার প্রতি আগ্রহের অভাব, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনীহা- একাধিক অভিযোগ তো আছে। আর প্রশাসনের সদিচ্ছা! সেক্ষেত্রে?
আবু- আমি বলছি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হোক অথবা অন্যান্য। সব ক্ষেত্রেই জাতপাত, ধর্ম নির্বিশেষে শিক্ষার অগ্রগতি প্রয়োজন। প্রশাসনের তরফে ব্যবস্থা করতে হবে যাতে একশো শতাংশ মানুষ শিক্ষিত হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, মানুষ হওয়ার শিক্ষা লাগবেই! তাহলে দাঙ্গা বলুন আর অসচেতনতা, জাতপাত-অশান্তি সব বন্ধ হবে। অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথেই শুধু হাঁটবে এই সমাজ।
তবে শিক্ষা বলুন আর না পারার কষ্ট- বহু মানুষ তো অল্পতেই হেরে যান। পারেন না। আবুর মতো আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে পাবেন ওঁরা?
আবু- এই যে, জেতার আগেই হেরে যাব, পারব না- এটা ভাবা যাবে না! যা বুঝেছি লড়াই করতে করতে, এমনটা আর করা যাবে না। সাহসী হতে হবে। জীবনে ঝড় এলেও থেমে যাওয়ার অপেক্ষা করতেই হবে। একদিনে সাফল্য পাওয়া যাবে না কিন্তু একদিন তো যাবেই!
তার মানে একদিন তো আইপিএস হচ্ছেন আপনিও?
আবু- অবশ্যই। খাওয়ার অভাব, পড়ার অভাব, কাজ, লড়াই সব ছাড়িয়েও আমার লক্ষ্য সেই একটি জায়গাতেই। আমি বিশ্বাস করি, লড়াই আমাকে করতে হবে এবং সেই লড়াইয়ে জিতবই! তার জন্য আমি প্রস্তুত।
নতুন শুরু তাহলে?
আবু- হ্যাঁ! মাটিতে পা রেখেই আকাশ ছুঁয়ে দেখতে চাই। পড়াশোনা চলবে, প্রস্তুতি নেব। সরকারের সাহায্য পেলে আরও সুবিধা হবে আমার এগিয়ে যেতে। চাইছি। লড়ছি। বিশ্বাস আছে, একদিন জিতবই!
ভালো থাকবেন...
আবু- একদম। আপনিও ভালো থাকবেন!