কেন শাঁখা-পলা খুলে টেট পরীক্ষা? বিতর্কের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে আসল যে কারণ

Primary TET Exam 2022: অভিযোগ, টেট দিতে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশের মুহূর্তেই বিবাহিত মহিলাদের হাত থেকে শাঁখা-পলা খুলে নেওয়া হয়। পরীক্ষায় নিরাপত্তার অজুহাতে কানের দুল থেকে মাথার ক্লিপ, সব কিছু খুলে ফেলা হয় প্রবেশের সময়...

টেট নিয়ে বিপত্তি! প্রশ্ন ফাঁস? ফের দুর্নীতি? নাকি ব্যবস্থাপনায় গলদ! গত ১১ ডিসেম্বর, রবিবার অনুষ্ঠিত বহু প্রতীক্ষিত প্রাথমিক টেট (Primary TET) পরীক্ষা নিয়ে, একাধিক প্রশ্নের মধ্যেই ফের শুরু হয়েছে বিতর্ক। বাংলার পরীক্ষা-ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করে এবার বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে শাঁখা-পলা! প্রশ্ন ভুল থেকে নিরাপত্তা, সবকিছু মোটের উপর ঠিক থাকলেও শীতের ডিসেম্বরকে উষ্ণ করেছে এই শাঁখা-পলা। শুধু উষ্ণই নয়, প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের ভূমিকা, টেট পরীক্ষা নিয়ে একাধিক প্রশ্নের আবহেই শাঁখা-পলা ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়েছে বঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। কী ঘটেছে আসলে?

শাঁখা-পলায় না?

রবিবারের টেট পরীক্ষায় বসেন প্রায় ৬ লক্ষ ৯০ হাজার পরীক্ষার্থী। তার মধ্যে মহিলা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধেক। অভিযোগ, টেট দিতে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশের মুহূর্তেই বিবাহিত মহিলাদের হাত থেকে শাঁখা-পলা খুলে নেওয়া হয়। পরীক্ষায় নিরাপত্তার অজুহাতে কানের দুল থেকে মাথার ক্লিপ, সব কিছু খুলে ফেলা হয় প্রবেশের সময়। এমনকী আঙুলে থাকা আংটিও নাকি খুলে দিতে বলে বিভিন্ন বিদ্যালয় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ। শুধু মহিলারা নন, অভিযোগ, ছেলেদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ব্যবহার করা হয়। খুচরো পয়সা থেকে শুরু করে কোমরের বেল্ট, সবটা খুলে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে। অভিযোগ, কাউকে কাউকে শীতের পোশাকও খুলে প্রবেশ করতে বলা হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে। এখানেই শুরু হয় বিতর্ক। অভিযোগ ওঠে, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের। দাবি করা হয়, হিন্দুধর্মে বিবাহিত মহিলাদের হাতের শাঁখা-পলা খুলিয়ে নেওয়া চূড়ান্ত অসম্মানের! কেউ কেউ তো বলতে শুরু করেন, অন্য ধর্মের উপর নিয়মের কোনও কাঁটা না থাকলেও হিন্দুদের বেলায় এমন কেন! বোরখা বা হিজাব পরতে বারণ না থাকলেও শাঁখা-পলায় নিষেধ কেন, এই প্রশ্নও তোলেন একাধিক। সোশ্যাল মিডিয়াও উত্তাল হয় শাঁখা-পলা কাণ্ডে।

ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন?

শাঁখা-পলা বিতর্ক খতিয়ে দেখতে ইনস্ক্রিপ্ট খোঁজ নিয়েছিল রাজ্যের একাধিক প্রান্তে। আর সেই সূত্রেই আমরা কথা বলি, ওই দিন টেট পরীক্ষায় বসেছিলেন এমন পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে। উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙায় বাস অমৃতা মণ্ডলের (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল বনগাঁর হেলেঞ্চা এলাকার একটি কলেজে। বিবাহিত ওই পরীক্ষার্থী ইনস্ক্রিপ্টকে জানালেন, "আমাদের বারবার বলা হচ্ছিল কোনও ধাতব জিনিস থাকলে, সেটি খুলে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করার জন্য। সেটা সোনা, রুপো বা লোহার কিছু হলে। আমরা অনেকেই সোনার দুল খুলে দিই। এর সঙ্গে হাতের আঙুলে থাকা সোনার আংটিও খুলি। কিন্তু আমার হাতে এমনি শাঁখা ছিল। সেটি সোনার নয়। সাধারণ শাখা। তাই খুলতে হয়নি।" নিউটাউনের বাসিন্দা এক মহিলা পরীক্ষার্থীর দাবি, "আমার হাতে সোনা বাঁধানো শাখা ছিল। সেটি ধাতব। তাই নির্দেশ মেনে সেটা খুলে দিই। যদিও আগে থেকেই পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডে বলা ছিল, ধাতব কিছু ব্যবহার করা যাবে না পরীক্ষায়।" প্রায় একই কথা বলছেন বারাসতের এক টেট পরীক্ষার্থী। তাঁর কথায়, "এমনি শাঁখা-পলা রয়েছে তাতে কোনও সোনা নেই, এই ক্ষেত্রে তো কাউকে খুলতে দেখিনি। আমার হাতের পলায় সোনা ছিল। সেটা খুলে দিয়েছিলাম। কানের দুল খুলেছিলাম। সকলকে সেটাই করতে দেখেছিলাম। কিন্তু সাধারণ শাঁখা বা এমন কিছু খুলতে হচ্ছে, এমন কিছু আমার সেন্টারে দেখিনি।"

আরও পড়ুন- এবার অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখেও মমতা-স্তুতি!পালটে গেলেন বিচারপতি?

ঠিক কী অভিজ্ঞতা হুগলি জেলার পরীক্ষার্থীদের? হুগলির শ্রীরামপুরের বাসিন্দা এক মহিলা পরীক্ষার্থীর দাবি, "আমি আগেও টেট দিয়েছি। বিবাহিত অবস্থায় পরীক্ষায় বসেছি। নিরাপত্তার এত কড়াকড়ি সত্যিই দেখিনি। তবে অন্যান্য পরীক্ষায় এই মেটাল-জিনিস ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। সেখানে দাঁড়িয়ে সোনা বাঁধানো শাঁখা-পলা থাকলে সেটা তো আমরা নিজেরাই খুলে ঢুকব অথবা খুলে রেখে যাব বাড়িতে। আমি এমনি শাঁখা পরে যাই, কেউ আটকাননি।" এই প্রসঙ্গে কী বলছেন পুরুষ পরীক্ষার্থীরা? হৃদয়পুর এলাকার বাসিন্দা এক পরীক্ষার্থী রঞ্জন দাসের (নাম পরিবর্তিত) দাবি, "কোমরের বেল্ট খুলেছি। মেয়েদের দেখছিলাম কানের দুল পর্যন্ত খুলতে হচ্ছে। অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সোনা ছাড়াও শাঁখা-পলা খুলে নেওয়া হয়েছে, এটা দেখিনি।"

শাঁখা-পলা নিয়ে কী নির্দেশ ছিল সংসদের?

শাঁখা-পলা নয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে ধাতব কিছু অর্থাৎ মেটাল কোনও দ্রব্য নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সংসদ। সোনা, রুপো অথবা লোহার মতো ধাতুতে নিষেধ ছিল আগে থেকেই। এমনকী অন্যান্য পরীক্ষার মতোই বৈদ্যুতিন বা ব্যাটারিচালিত কোনও বস্তু নিয়েও পরীক্ষা দেওয়া যাবে না, বলা হয় একথাও। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্র অর্থাৎ অ্যাডমিট কার্ডে এই বিষয়টি প্রথমেই স্পষ্ট করে দেয় সংসদ। কী কী নেওয়া যাবে, কী কী নেওয়া যাবে না। এবং কোথায় কোথায় নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে, একাধিক বিষয় ওই প্রবেশপত্রেই প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। শিক্ষা সংসদের একটি সূত্রের দাবি, "ওই ধাতব জিনিসে নিষেধাজ্ঞা নিয়েই এই বিতর্ক তৈরি হয়েছে।" রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের ওই সূত্রের দাবি, "শাঁখা-পলায় আসলে আপত্তি নেই, আপত্তি ছিল ধাতুতে। লোহার মতোই সোনাও ধাতব বস্তু। বহু মহিলা পরীক্ষার্থী শাঁখা-পলায় সোনা রয়েছে এমন জিনিস পরে গিয়েছেন। মেটাল ডিটেক্টরে সেখানে বাধা এসেছে। আর সেই কারণেই কাউকে কাউকে খুলতে হয়েছে শাঁখা-পলা। যা নিছকই ধাতব বলে। এখানে অন্য কিছুই নেই।"

বিতর্কে শাঁখা-পলা

ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে শুরু করে রাজ্য সরকারের হিন্দু-বিরোধী নীতি নিয়ে অবধি অভিযোগ উঠে গিয়েছে! অভিযোগ উঠেছে, একটি ধর্মের ভাবাবেগের উপর ইচ্ছাকৃত আঘাতের। আর এই সূত্রেই, কেউ কেউ শাঁখা-পলা খোলানোকে 'অপরাধ' বলে নিজস্ব যুক্তিও দিয়েছেন। কিন্তু অন্য অংশের দাবি, "এখানে ধর্মের কোনও প্রভাব নেই। ধর্মীয় ভাবাবেগ আসলে তৈরি করে নেওয়া। টেট পরীক্ষা নিয়ে অন্যান্য বিতর্কের মধ্যে ধর্মীয় কোনও কারণ নেই এই ক্ষেত্রেও। ধাতব বিষয় খোলার নিয়মকে অন্যভাবে প্রতিফলিত করা হচ্ছে এই রাজ্যে।"

শাঁখা-পলা প্রশ্ন!

আধুনিক যুগের অস্তিত্ব ছাড়িয়েও সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের একটা বড় অংশের কাছে শাঁখা-পলার গুরুত্ব রয়েছে আজও। অনেকেই বলেন, মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে শাঁখা-পলা শুভ। স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুরের পাশাপাশি স্ত্রীর দু'হাতে শাঁখা-পলা থাকাও নাকি মঙ্গলের। স্বামীর মৃত্যুর পরে যা খুলতে হয় এখনও! আবার অবাঙালিদের মধ্যে গলায় মঙ্গলসূত্র পরার প্রচলন রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আদিকালের এই রীতি নিয়ে বিতর্কও রয়েছে বিস্তর। অনেকেই বলেন, এই রীতি-রেওয়াজ আসলে পুরুষতান্ত্রিকতারই ফসল। স্ত্রী, স্বামীর মঙ্গলকামনায় শাঁখা-পলা সিঁদুর পরেন, কিন্তু স্বামীরা স্ত্রীদের মঙ্গলকামনায় কী পরেন! কেন বিবাহিত মহিলারাই শাঁখা-পলা পরেন? কোথা থেকে এল এই রীতি? 

আরও পড়ুন- চাকরি গেছে লাখ লাখ শিক্ষকের! কেন এমন বেহাল দশা ভারতের শিক্ষাব‍্যবস্থার

শাঁখা-পলা মাহাত্ম্য

পুরাণে শাঁখা-পলা পরিধান নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো, সনাতন ধর্মে বিয়ে হয় মূলত আটটি মতে। ব্রাক্ষ্ম, দৈব, অর্শ, প্রজাপাত্য, অসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস, পৈশাচ। এই আট মতের বিবাহের মধ্যে 'রাক্ষস' বিবাহ-রীতিতে শাঁখা-পলা পরার রীতির উৎপত্তি হয়েছে। বলা হয়, 'রাক্ষস' রীতিতে এক রাজ্য থেকে মেয়েদের ধরে অন্য রাজ্যে আনা হত। জোর করে বিয়ে করা হত তারপর। আর এই বন্দি-দশার জন্য, সেই মেয়েদের হাতে-পায়ে লোহার শিকল বেঁধে দেওয়া হত। ওই লোহার শিকল যুগের নিয়মে পরবর্তিত হয়ে শাঁখা-পলার রূপ ধারণ করেছে বলে দাবি করা হয়।

আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হচ্ছে, মহাভারতের সময় থেকে শাঁখার ব্যবহার শুরু হয়। যার উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। জানা যায়, সেই সময়ে শঙ্খাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ওঠে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল। দেবতারা অসুরের অত্যাচারে ফের বিপর্যস্ত হন। মারত্মক বিপদ থেকে বাঁচতে অবশেষে সকল দেবতা শরণাপন্ন হন বিষ্ণুর। রক্ষাকর্তা বিষ্ণুর আক্রমণে বিদ্ধ হয় শঙ্খাসুর। মৃত্যু হয় তাঁর। রক্ষা পান দেবতারা।

যদিও ওই অসুরের স্ত্রী ছিলেন তুলসী, যিনি ধর্মপরায়ণা। তুলসী, তাঁর স্বামীকে ফেরত পাওয়ার জন্য ধ্যান শুরু করেন। তাঁর প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে নারায়ণ সাড়া দেন। কিন্তু শঙ্খাসুরকে ফিরিয়ে দেওয়ার তুলসী-মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারেননি তিনি। যদিও নারায়ণ তুলসীর স্বামীর প্রতীক হিসাবে শঙ্খাসুরেরই শরীরের হাড় দিয়ে শাঁখা তৈরি করে, তাঁর স্ত্রী তুলসীকে দান করেন। বলা হয়, সেই থেকেই হিন্দু বিবাহিত মহিলারা স্বামীর মঙ্গল কামনায় শাঁখা ধারণ করেন হাতে।

শাঁখা নিয়ে পুরাণে একাধিক কথকতা থাকলেও পলা সম্পর্কে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে যুগ যুগ ধরে পলাও শাঁখার পাশে গুরুত্ব পায়। জানা যায়, প্রাচীনকালে মহিলাদের ঋতুচক্র শুরুর মুহূর্তে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। ঠিক সেই সময়ে বয়সের হিসেব রাখার তাগিদে তাদের হাতে লাল রঙের বালা পরিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বলা হয়, সেই থেকেই মহিলাদের বিবাহের পরে পলা ধারণের রীতি চলছে।

বঙ্গের রাজনীতিতে এবার সেই শাঁখা-পলাই দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ রাজ্য সরকারের শিক্ষক নিয়োগ পর্বে নতুন উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে। একাধিক বিতর্ক, জল্পনা আর ধর্ম-ধর্ম আবহে টেটের 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ' হয়ে উঠেছে এই গয়না। যা তৈরি করেছে একাধিক প্রশ্নও।

 

More Articles