১১ সদ্যোজাতের মৃত্যু! ভারতে শিশু হাসপাতালগুলিতে কেন বারবার অগ্নিকাণ্ড?
Jhansi hospital newborn deaths: মহারানি লক্ষ্মীবাঈ মেডিক্যাল কলেজের নিকু বিভাগে নাকি আগুন নেভানোর স্প্রিঙ্কলারের (ছাদ থেকে জল ছেটানোর পদ্ধতি) কোনও ব্যবস্থা ছিল না।
গত শুক্রবার উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসিতে মহারানি লক্ষ্মীবাঈ মেডিক্যাল কলেজের অগ্নিকাণ্ডে ১১ জন সদ্যোজাতের মৃত্যু হয়েছিল। এটি একটি সরকারি হাসপাতাল। সেদিন রাত ১১টা নাগাদ হাসপাতালের সদ্যোজাতদের আইসিইউ (নিকু) বিভাগে আগুন লাগে। শুক্রবারই ১০ জন সদ্যোজাতের মৃত্যু হয়। রবিবার আরও ১ শিশুর মৃত্যু হয়। উত্তরপ্রদেশ সরকার এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই কমিটিকে রিপোর্ট জমা করার কথা বলা হয়েছিল। ভারতে হাসপাতালে আগুন লেগে সদ্যোজাতর মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। আগেও একাধিকবার এই ঘটনা ঘটেছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক হাসপাতালগুলিতে এমন অগ্নিকাণ্ড রুখতে এবছর জুন মাসে সব রাজ্যের জন্য অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি নির্দেশ জারি করে কিন্তু ঝাঁসির এই ঘটনার পর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নির্দেশ কতটা কার্যকর হয়েছে সেই নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ফের কীভাবে আগুন লাগল? প্রত্যক্ষদর্শীরা কী বলছেন?
শুক্রবার রাতে ওই ওয়ার্ডে দু'জন মহিলা চিকিৎসক, ৬ জন নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ছিলেন। আগুন নেভাতে গিয়ে এক নার্সেরও কাপড়ে আগুন লেগে যায়। তাঁর পায়ের একটি অংশ পুড়ে গিয়েছে। এক প্যারামেডিক কর্মী এবং দুই স্বাস্থ্যকর্মী অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের সাহায্যে আগুন নেভানোর চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু আগুন অনেকটাই ছড়িয়ে পড়ায়, তাঁদের পক্ষে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। আগুনে ঝলসে মারা গিয়েছে ১০ সদ্যোজাত এবং আহত হয়েছে ১৬ জন সদ্যোজাত। শনিবার মৃত ৭ শিশুর দেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। বাকি শিশুর পরিবারের খোঁজ না মেলায় ময়নাতদন্ত হয়নি। কী কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল তা অনুসন্ধান করতে ঝাঁসির ডিভিশনাল কমিশনার এবং ডিআইজিকে নির্দেশ দিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রে ত্রুটি ছিল। অভিযোগ উঠেছে, দু'বছর আগেই নাকি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই যন্ত্র ঠিক করে কাজ করেনি। দুর্ঘটনার সময় নাকি 'ফায়ার অ্যালার্ম'-ও বাজেনি। প্রশ্ন উঠেছে, নার্সদের গাফিলতি নিয়েও। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। ভগবান দাস নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করছেন, এক নার্স নাকি দেশলাই জ্বালিয়ে অক্সিজেনের পাইপ জোড়া লাগাচ্ছিলেন। আগুন লাগার সময় তিনি ওই ওয়ার্ডেই ছিলেন। তাঁর সন্তানকে দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁর দাবি, দেশলাই কাঠিতে আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন লেগে গিয়েছিল ওয়ার্ডে। এখানে বলে রাখা দরকার, নিকু বিভাগে সাধারণত বেশি মাত্রাতেই অক্সিজেন রাখা হয়।
আরও পড়ুন- পাকিস্তানে ভয়াবহ স্বাস্থ্য-ঝুঁকির মুখে ১১ মিলিয়ন শিশু, শিশু-মৃত্যু ঠেকাতে পারবে পাক-সরকার?
মহারানি লক্ষ্মীবাঈ মেডিক্যাল কলেজের নিকু বিভাগে নাকি আগুন নেভানোর স্প্রিঙ্কলারের (ছাদ থেকে জল ছেটানোর পদ্ধতি) কোনও ব্যবস্থা ছিল না। চিকিৎসকদের কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, ওই বিভাগ সদ্যোজাতদের জন্য। ওদের সমস্যার কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে, তদন্তের গোড়াতেই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এনডিটিভি-র প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, সূত্র মারফত জানা গিয়েছে কমিটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, দুর্ঘটনাবশতই আগুন লেগেছিল। সুইচবোর্ডে শর্ট সার্কিটের কারণেই এই অগ্নিকাণ্ড। অনুসন্ধানে গাফিলতি বা ষড়যন্ত্রের তত্ত্বও পাওয়া যায়নি কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা অন্য অভিযোগ করেছেন
এও অভিযোগ উঠছে যে, ১৮ জনের ওয়ার্ডে প্রায় তার দ্বিগুণ সদ্যোজাতকে রাখা হয়েছিল। নিকু হলো সদ্যোজাতদের জন্য একটি বিশেষ আইসিইউ বিভাগ। ঝাঁসির এই হাসপাতালে ১৮ টি শিশুর শয্যার ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ওই ওয়ার্ডে নাকি প্রায় ৫৪ জন শিশু ভর্তি ছিল। তার মধ্যে ৪৪ জনকে উদ্ধার করা গিয়েছিল। ১০ জন শিশুই আগুনে ঝলসে মারা গিয়েছে। কানপুরের এডিজি অলোক সিং বলেছিলেন, ওই ওয়ার্ডে ৪৭ জন ভর্তি ছিল। অন্যদিকে, আবার ঝাঁসির সিনিয়র পুলিশ সুপার সুধা সিং বলেছিলেন, ওই ওয়ার্ডে ৫২-৫৪ জন শিশু ভর্তি ছিল। পুলিশের তরফেই ভর্তি শিশুর সংখ্যা নিয়ে একাধিক বক্তব্য এসেছে।
উল্লেখ্য, ঝাঁসির হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে সদ্যোজাতর মৃত্যুর পর ফের আলোচনা হচ্ছে, ভারতে বিভিন্ন হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে ঘটে যাওয়া শিশুমৃত্যুর নানা ঘটনা। এবছরই ২৫মে দিল্লির বিবেক বিহার হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেখানেও ৭ সদ্যোজাতর মৃত্যু হয়। পুলিশের তরফে জানানো হয়েছিল, ওই হাসপাতালটি নাকি অবৈধভাবে চলছিল। সেখানে শুধুমাত্র ৫জন শিশুর শয্যার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু ভর্তি রাখা হয়েছিল ১২ জন শিশুকে। হাসপাতালের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল যে, হাসপাতালটি অবৈধভাবে একটি আবাসিক ভবনে চালানো হতো। দমকল বিভাগ জানিয়েছিল, দু'মাস আগেই লাইসেন্স শেষ হয়ে গিয়েছিল। এদিনই আবার গুজরাতের রাজকোটে একটি গেমিং জোনে আগুন লাগে। এখানে ৯ জন শিশু মারা গিয়েছিল এবং ২৭ জন আহত হয়েছিল। মৃতদেহগুলি এমনই পুড়ে ঝলসে গিয়েছিল যে শনাক্ত করতে দেহগুলির ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন- জনসনের পাউডারে লুকিয়ে শিশুর বিপদ! কেন ১৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সংস্থা?
২০২১ সালের জানুয়ারিতে মহারাষ্ট্রের ভাণ্ডারা জেলা হাসপাতালের 'নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট'-এ আগুন লেগে যায়। ওই ঘটনায় ১০ জন সদ্যোজাত মারা যায়। তদন্তের পর উঠে এসেছিল, হাসপাতালটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার প্রস্তাব ঘটনাটির ১ বছর আগেই করা হয়েছিল। কিন্তু ১ বছর ধরে সেই প্রস্তাব মানা হয়নি। ওই বছরই নভেম্বরে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের কমলা নেহেরু হাসপাতালে শিশুরোগ বিভাগে আগুন লেগে যায়। সেখানে ৪ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। প্রশাসন জানায়, হাসপাতালে ৪০০ শিশুর শয্যার ব্যবস্থা ছিল। হাসপাতালটি ছিলও আটতলা কিন্তু কোনও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।
ঝাঁসির হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে ৩ সদ্যোজাতকে বাঁচিয়েছেন কুলদীপ কিন্তু নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি। ১০ দিন আগে জন্মেছিল কুলদীপের সন্তান। সন্তানের শরীর খারাপ থাকায় ঝাঁসির এই হাসপাতালের নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ) ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। কুলদীপ পৌঁছনোর আগেই তাঁর সন্তানকে যেখানে রাখা হয়েছিল সে জায়গায় আগুন লেগে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে যে নির্দেশ দিয়েছিল তা কতটা কার্যকর হলো তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসা এখনও বাকি রয়েছে। তাই এই প্রশ্নও থাকছে, কর্তৃপক্ষ সচেতন থাকলে কি দুর্ঘটনা এড়ানো যেত না? সত্যিই দেশলাই জ্বালিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাইপ জোড়া লাগাতে গিয়েই কি এই ঘটনা ঘটল?