কেন চলে যেতে হল পল্লবী দে-কে?
আমরা তো প্রত্যেকটা মানুষই সারভাইভালের দিকেই এগোচ্ছি, মৃত্যুকে সরিয়ে জীবনকে আহ্বান করছি, এটাই আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।
"আহা রে এতটুকু মিষ্টি মেয়ে! কী এমন ঘটল, যার জন্য নিজেকে এভাবে শেষ করে দিতে হল?"
"এই এখন একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে! ডিপ্রেশন! কেন? আমাদের সময় কি মনখারাপ হত না?
"এসব ইন্ডাস্ট্রিতে এসব তো ঘটতেই থাকে! জায়গাটাই তো তাই... শুনলাম ছেলেটি নাকি বিবাহিত ছিল?"
এই মুহূর্তে বাসে, ট্রেনে, চায়ের দোকানে, আড্ডার রোয়াকে এই সমস্ত কথাই উঠে আসছে জানি।
ইনস্টাগ্রামে ৭৬,০০০ , ফেসবুকে ৩০,০০০ ফলোয়ার। বছর ২৫-এর হাসিখুশি পল্লবী, যাঁর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে এই মুহূর্তে মিডিয়া তোলপাড়। পল্লবীর সঙ্গে কী হয়েছে, এই ঘটনা আত্মহত্যা না খুন, সেটা সময় বলবে। তবে আপাতভাবে ধরে নেওয়াই হচ্ছে, এই ঘটনা আত্মহত্যাই। আর এই প্রতিবেদনও সেই কারণেই লেখার সিদ্ধান্ত।
ঘন ঘন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেমিকের সঙ্গে ছবি পোস্ট করতে থাকা প্রাণবন্ত মেয়ে পল্লবী। আক্ষরিক অর্থে সুন্দর ও গ্ল্যামারাস বলতে যা বোঝায়, সেই গুণের বহনকারীও সে। 'আমি সিরাজের বেগম', 'মন মানে না', 'সরস্বতীর প্রেম'- এই সমস্ত বেশ নামকরা সিরিয়ালের অভিনেত্রী। ঘটনার দিন সন্ধেবেলায় প্রেমিকের হাত ধরে বন্ধুদের সঙ্গে মোমো, কটন ক্যান্ডি খেয়েছিল। দীর্ঘক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাক্টিভও ছিল, তবে হঠাৎ কী কারণে এই জীবনের প্রতি এতটা বিতৃষ্ণা জন্মাল তার?
আরও পড়ুন: নিজেকে অতিরিক্ত ভালবাসেন? জানেন কোন কঠিন অসুখে ভুগছেন?
আর এখানেই আসলে আমাদের জাজমেন্টের শুরু। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, একাধিক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা- ইত্যাদি কিছু বাহ্যিক ব্যবহারে আমরা আসলে ধরেই নিই, সেই মানুষ আসলে ভেতর থেকেও প্রাণবন্ত। মানতেই পারি না, কিছু মানুষ দুঃখ শুধু চোখ দিয়ে নয়, হেসেও প্রকাশ করতে পারে।
ডিপ্রেশন বড়লোকের অসুখ, নিঃসঙ্গতা মানেই একার জীবন, বন্ধুর সংখ্যা কম, ভিড়ের মাঝেও একলা একা- আমরা ধরেই নিই আসলে সেসব দুঃখবিলাসিতা, এবং অতি অবশ্যই মনোযোগ আকর্ষণ করে সহানুভূতি কুড়ানোর উপায়। তাই হয়তো জমতে থাকা যন্ত্রণা জমাট বেঁধেছে, অভিনেত্রী হতে চাওয়া পল্লবী বাস্তবেও অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন, একের পর এক টেক দিতে দিতে শিখে গেছেন কীভাবে অবসাদ, দুশ্চিন্তা আড়াল করতে হয়।
তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার, পরিবেশগত কোনও কারণ ছাড়াও ডিপ্রেশন সম্ভব। শারীরিক কিছু কারণ থাকে সেখানে, যেমন হরমোন, জিন, কেমিক্যাল কিছু বিষয়, এসব ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে বিভেদ আছে। তাই পরিবেশগত কারণ যে থাকতেই হবে, তেমনটা কিন্তু নয়। আরেকটি বিষয়ও একটু মাথায় রাখা দরকার, কয়েকদিন আগে একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, আমাদের মস্তিকের একটি অংশ, অ্যামিগডালা, যা আবেগের উৎসস্থল, তা অনেক কম বয়সেই সংগঠিত হয়ে যায়, আর মস্তিষ্কের যে অংশ যুক্তি, সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনার জন্য দায়ী, তা সংগঠিত হতে আরেকটু বয়স লাগে। তাই আমরা যে বলি, কম বয়সে রক্ত গরম, আবেগপ্রবণতা বেশি থাকা, হঠাৎ করে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা- তা আসলে এই কারণেই।
যদিও পল্লবীর বন্ধুদের থেকেই শোনা গেছে, সিরিয়ালের সেটে প্রায় দিনই শরীরে তার আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এটা ঠিক যে, সম্পর্কে তিক্ততা ছিল।আত্মহত্যার একটা বড় কারণ শুধু অবসাদ নয়, অ্যাবিউজও। তবে যন্ত্রণার প্রকাশ আর প্রকাশের যন্ত্রণা যেমন এক নয়। ঠিক তাই নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রকাশেরও বিভেদ থাকে। এই তথ্য জানা নেই, কোনও কাছের মানুষ ছিল কি না পল্লবীর কথা শোনার জন্য, যাকে ভরসা করে বলা যায় নিজের অনেক ভয়, নিরাপত্তাহীনতার কথা, যাকে মাঝরাতে ফোন করে অনায়াসে কাঁদা যায়, যাকে বলা যায় এমন কিছু কথা, যা বলতে পারা যায় না কারও কিংবা নিজের কাছেও, কারণ একথা সত্যিই, বাস্তবে মনোবিদ অনেক সময় এরাই হয়ে ওঠে। সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের মনোবিদের কাছে যাওয়া এখনো অবধি বিলাসিতাই এবং সর্বশেষ সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাও প্রশ্ন জাগে, তা বলে আত্মহত্যা? এই সামান্য কারণে? এই প্রশ্ন বেশিরভাগের মনেই উদয় হয়েছে জানি, হয়তো মনে হয়েছে, কী ভীষণ বোকা একটি মেয়ে, এর থেকে কি বেরনোর সত্যি কোনও পথ পাওয়া যেত না? আসলে ভেবে দেখবেন, বাইরে থেকে বলে দেওয়া খুব সহজ, ঠিক যেমন আপনি পড়ে গেলে শুধুমাত্র আপনিই পারবেন সেই ব্যথা অনুভব করতে, আমরা শুধু আন্দাজ করে নিতে পারব। এক্ষেত্রেও ঠিক তাইই।
আমরা তো প্রত্যেকটা মানুষই সারভাইভালের দিকেই এগোচ্ছি, মৃত্যুকে সরিয়ে জীবনকে আহ্বান করছি, এটাই আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তাও এটা মনে রাখা দরকার, আত্মহত্যা করার আগে মানুষ বাঁচতেই চায়। সুইসাইডাল হেল্পলাইন নম্বর নিয়ে অনেকেই হয়তো সচেতন নন। বহু মানুষ আত্মহত্যা করার আগে এই হেল্পলাইন নাম্বারে ফোন করেন। হয়তো অবাক হচ্ছেন, তবে সত্যি এই ঘটনা। চাইলে গুগল করে দেখতে পারেন, আর যদি সম্ভব হয় নিজের জন্য বা নিজের কাছের মানুষের জন্য ফোনে নম্বর সেভ করেও রাখতে পারেন, কারণ জীবন এই গ্যারান্টি সত্যিই দেয় না, কখন পল্লবীর মতো মানসিক অবস্থায় আপনিও পৌঁছে যাবেন।