জি২০ সামিটে চিনের ধাক্কা! বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প থেকে সরে যেতে পারে ইতালি

Belt and Road Project : প্রশ্ন হচ্ছে, চিনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পটি ঠিক কী ধরনের উদ্যোগ?

চিনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' বা সংক্ষেপে যাকে BRI প্রকল্প বলা হচ্ছে, তা থেকে কি হাত গুটিয়ে নিতে চলেছে ইতালি? জি-২০ বৈঠকে সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। যাকে আবার কূটনৈতিক মহলের একাংশ ভারতের জয় হিসেবে দেখছে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পটি ঠিক কী ধরণের উদ্যোগ? প্রকল্পটিতে চিনের কী সুবিধা? ইতালি কীভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে? আর ইতালি 'বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প' থেকে বেরিয়ে গেলে ভারতেরই বা আখেরে কী লাভ?

২০১৩ সালে চিন 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের ঘোষণা করে। তারও ৬ বছর পর, ১০১৯ সালে ইতালি গ্রুপ অফ সেভেন (G-7)জোটের একমাত্র সদস্য হিসেবে চিনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। জোটের বাকিরা অর্থাৎ কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপানের মতো দেশগুলি কেউই চিনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত নেই। ইতালির এখনকার প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি তখন অর্থাৎ ২০১৯ সালে বিরোধী শিবিরের মুখ। সে সময় চিনের সঙ্গে হাত মেলানোর সিদ্ধান্তকে 'বিগ মিসটেক' বা 'বড় ভুল' বলে মন্তব্য করেন মেলোনি।

আরও পড়ুন- জি-২০-র ডিনারে কোন টেবিলে কার পাশে মমতা, নীতীশ? জোর চর্চা ইন্ডিয়া শিবিরে

'বেল্ট অ্য়ান্ড রোড' BRI প্রকল্পকে চিন নতুন সিল্ক রুট বলে চিহ্নিত করেছে। পরিকাঠামো গত উন্নয়নের দিকটি মাথায় রেখে এই প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছে চিন। 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের মাধ্যমে চিন নিজের দেশের সঙ্গে সরাসরি মধ্য এশিয়া হয়ে ইউরোপকে জুড়তে চলেছে। শুধু তাই নয় এই প্রকল্পের হাত ধরে আফ্রিকা, ওশানিয়া এবং লাতিন আমেরিকাতেও অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি করতে চাইছে জিং পিং-এর দেশ। 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের একটি সড়ক সরাসরি চিন এবং পাকিস্তানের গ্বাদর বন্দর শহরকেও জুড়তে চলেছে। এই অংশের সড়কই পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে যাবে। যা নিয়ে আপত্তি রয়েছে ভারতের। কেননা আজও পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ভারত-পাক কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে এক বিতর্কিত বিষয়।

চিনে তখন রাজতন্ত্র। রাজা হানের শাসনকাল। যিশুর জন্মেরও ২০৬ বছর আগেকার কথা। সিল্ক রুট দিয়ে পশ্চিম দেশে বাণিজ্যিক যাতায়াত শুরু হয়। চিন, আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান হয়ে ইওরোপের সঙ্গে পণ্য আদানপ্রদান শুরু করে চিন। একইসঙ্গে জুড়ে যায় ভারত এবং পাকিস্তান। তখন অবশ্য ভারত অবিভক্ত। এই সিল্ক রুটের বাণিজ্যিক আদান প্রদানের মধ্য দিয়েই মধ্য-এশিয়া শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। যেখানে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকাচার সবকিছুরই মেলবন্ধন ঘটে। চিনা সিল্ক, মশলা, জেড পাথরের কদর বাড়ে ইওরোপে। ইওরোপ থেকে চিন নিয়ে আসে সোনা, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধাতু, আইভরি এবং কাচ। মধ্যযুগের বাইজেনটাইন সভ্য়তায়, এবং চিনে তাং রাজত্বে সিল্ক-রুট বাণিজ্য ফুলেফেঁপে ওঠে। নতুন এই সিল্ক-রুটের কী পরিকল্পনা করেছে চিন?

২০১৩। ইন্দোনেশিয়া এবং কাজাখস্তান সফরে যান চিনা প্রেসিডেন্ট ঝি জিং পিং। ওই সফরেই প্রথম বার 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পের ঘোষণা করেন চিনা প্রেসিডেন্ট। প্রকল্পের দুই ডানা। একটা স্থলপথে সিল্ক রোড বাণিজ্যিক বেল্ট, অন্যটি সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই দুই ডানাকেই এক করে এখন 'রোড অ্যান্ড বোল্ট' প্রকল্প বলা হচ্ছে। কী করতে চাইছে চিন? রেলপথের মাধ্যমে এক বড় মাপের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাইছে। যেখানে থাকবে এনার্জি পাইপলাইন, হাইওয়ে, সহজ সীমান্তপার বাণিজ্যনীতি। যে যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে উত্তরে একদা সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পাহাড় পেরিয়ে, আবার থাকবে দক্ষিণে ভারত বা পাকিস্তান এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও। চিনের লক্ষ্য, আন্তর্জাতিক স্তরে আরও বেশি করে চিনা মুদ্রা রেনমিনবির লেনদেন। চিন সেই লক্ষ্যেই হাজার হাজার এসইজেডে বিনিয়োগ করেছে। শিল্পাঞ্চল এলাকা তৈরি করেছে। কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা করেছে। চিনের বৃহৎ টেলিকমিউনিকেশন সংস্থা হুয়াওয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে প্রযুক্তিগত সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে।

আরও পড়ুন- আমিষ নয়, অতিথিদের কেন নিরামিষ খাওয়াল ভারত?

ভারতের নজর অবশ্যই চিন-পাকিস্তান বাণিজ্যিক করিডরের দিকে। চিনের কাশগর থেকে কারাকোরাম হাইওয়ে হয়ে যে সড়ক পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতর দিয়ে পাকিস্তানে ঢুকছে। শেষ হচ্ছে বালুচ প্রদেশের গ্বাদর বন্দরে। চিনের লক্ষ্য আরব সাগরে বাণিজ্য সম্ভার বৃদ্ধি। এই প্রকল্পে চিন ইতিমধ্যেই এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা সব মিলিয়ে প্রকল্পের খরচ ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎআট লক্ষ কোটি টাকা ছুঁয়ে ফেলতে পারে।

বিতর্কিত পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতর দিয়ে বাণিজ্যিক করিডর নিয়ে যাওয়ার অর্থ, কূটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেওয়া। অন্তত দখলে রাখা কাশ্মীরের জমির প্রশ্নে। চিনের এই পদক্ষেপ ভারতকে ভাবাচ্ছে। তাই গ্রুপ অফ সেভেন গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য ইতালি যদি সত্যিই শেষপর্যন্ত 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যায়, তা হলে চিন খানিকটা হলেও ধাক্কা খাবে। জি-২০-র সামিটে এই বিষয়টাকেই ভারতীয় কূটনৈতিক শিবিরের একাংশ দেশের জয় হিসেবে দেখছে।

 

More Articles