বাংলাদেশের আয়নাঘর আসলে কেমন? ছবি, ভিডিও ইনস্ক্রিপ্টের হাতে
Bangladesh Aynaghar: কখনও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত দেখিয়ে, কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আশঙ্কা দেখিয়ে গুম করে দেওয়া হয়েছে অজস্র মানুষকে।
গত অগাস্টে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। কী এই আয়নাঘর? আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা হয় কাদের? জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, বাংলাদেশে বিগত দীর্ঘ বছর ধরে গুম হয়েছেন অনেকে। রাতারাতি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গোপন ডেরায়। যে ডেরার পোশাকি নাম আয়নাঘর। অভিযোগ, এই গুম হওয়া মানুষদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিরোধী মতের মানুষ। আয়নাঘরে বন্দি রাখা হয়েছে সেনার বহু প্রাক্তন কর্মকর্তাদেরও। আয়নাঘর নিয়ে এক রহস্যের আবর্ত তৈরি করে রেখেছিল হাসিনা সরকার। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর, স্বাভাবিকভাবেই আয়নাঘর থেকে বিরোধীদের মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। বাংলাদেশের প্রশাসনের অন্দরের খবর, আয়নাঘর আসলে গোয়েন্দা সংস্থার এক গোপন বন্দিশালা। ঠিক কী ঘটে এই আয়নাঘরে? এবার সেই গুমঘরের ছবি প্রকাশ হলো বিশ্বের সামনে। ইনস্ক্রিপ্টের হাতে এসেছে আয়নাঘরের সাম্প্রতিক ছবি ও ভিডিও। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন। সঙ্গে ছিলেন আয়নাঘরে নানা সময়ে গুম করে রাখা ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ।
শেখ হাসিনার শাসনামলে রাতারাতি তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিরোধীদের। অভিযোগ, এই ব্যক্তিদের বন্দি রাখা হতো আয়নাঘরে আর অকথ্য অত্যাচার চালানো হতো। আওয়ামী সরকারের পতনের পর গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা তদন্তের অগ্রগতি জানিয়ে ইউনূসকে অনুরোধ করেছিলেন ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করার। তাতে, এতকাল ধরে গুমঘরে নির্যাতিত হওয়া ব্যক্তিরা আশ্বস্ত হবেন বলে বিশ্বাস তাঁদের। কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছিলেন, হাসিনা আমলে ছয় বছরের শিশুকেও গুম করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- হাসিনার দেশে কাদের গুম করে রাখা হতো কুঠুরিতে! কী এই রহস্যময় আয়নাঘর?
পরিদর্শন শেষে ইউনূস একটিই শব্দ উচ্চারণ করেন 'বীভৎস'! প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, "ভাবাই যায় না এ আমাদেরই সমাজ! রাস্তা থেকে সাধারণ মানুষকে তুলে এনে অত্যাচার করা হয়েছে বিনা কারণে।” ইউনূস বলছেন, মানুষের সামান্য মানবিক অধিকার থেকেও তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর সংখ্যা সতেরশোরও বেশি। এখনও অনেকেই জানেন না তাঁদের স্বজনরা কোথায়! ইউনূস বলছেন, আয়নাঘরের কক্ষের যা অবস্থা তিনি দেখেছেন, সামান্য মুরগির খাঁচাও এর চেয়ে বড় হয়। অথচ এখানেই মানুষকে আটকে রেখে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এভাবে নির্যাতন হয়েছে। ইউনূস বলেছেন, "এই অপরাধ আমাদের সকলের যে আমরা তা ঘটতে দিয়েছি। আজ আমরা মুক্ত হলাম। যেন নতুন বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারি। অবশ্য পাঠ্য হিসেবে এই আয়নাঘরের প্রতিবেদন সকলকে পড়তে হবে। যারা করেছে তাঁদের বিচার হবে।"
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, "এক কথায় যদি এর বর্ণনা দিতে হয় তবে বলতে হয় এক বীভৎস দৃশ্য। মানুষের মনুষ্যত্ব বোধ বলে যেটা আছে সেটাকে বহু গভীরে নিয়ে গেছে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। নৃশংস প্রতিটি জিনিসি। যতবারই শুনি অবিশ্বাস্য মনে হয়। বিনা কারণে জঙ্গি আখ্যায়িত করে মানুষকে তুলে এনে এসব টর্চার সেলে নির্যাতন করা হতো।" ইউনূস আরও বলেন, "এখন শুনি সারা বাংলাদেশ জুড়েই আরও সাতশ-আটশ আয়নাঘর আছে। আমার ধারণা ছিল শুধু এখানেই আছে। এগুলোর সংখ্যাও নিরূপণ করা যায় না, কতটা জানা আছে, কতটা অজানা আছে।"
শেখ হাসিনার আমলে গুম হওয়া জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী এবং দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেম আলীর ছেলে আহমেদ বিন কাশেম ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন পরিদর্শন চলাকালীন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এবং নাহিদ ইসলামও এই আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, কেবল ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্তই ৬০৫ জন গুম হয়েছেন বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১০ বছর ধরে অজ্ঞাত স্থানে আটক করে রাখা ৮৬ জনের তালিকা প্রকাশ করেছিল সেবার। গুম হওয়ার তালিকায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী ও অরাজনৈতিক মানুষদের নামও ছিল। কেউ কেউ গুম হয়েও ফিরে এসেছিলেন। তাঁদের অনেককেই জঙ্গি হিসেবে আটক করা হয়েছিল বলে দেখানো হয়। যারা ফিরেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আর সেই অন্ধকার পর্ব নিয়ে কোনও তথ্যই জানাননি।
নেত্র নিউজের তথ্য অনুযায়ী, ডিজিএফআই-এর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) এই আয়নাঘর তৈরির দায়িত্বে ছিল। ২০১৬ সালের পর থেকে চার জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা সিটিআইবির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই একই সময়ে চার জন মেজর জেনারেল ছিলেন ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশ বইমেলায় তসলিমার বই রাখা নিয়ে অশান্তি? আসলে যা ঘটেছে
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ওই ২০০৯ সালেই প্রথম কোনও বিশেষ অভিযান বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সাধারণ মানুষদের গুম করার অভিযোগ ওঠে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। কী কারণে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে বিনা প্রমাণে মানুষকে গুম করার নির্দেশ দেওয়া হলো? মূলত এর লক্ষ্য আওয়ামী লীগ শাসিত বাংলাদেশকে বিরোধীশূন্য করা। তাই কখনও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত দেখিয়ে, কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আশঙ্কা দেখিয়ে গুম করে দেওয়া হয়েছে অজস্র মানুষকে।
গত শতকে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এরকম গুম করার পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল। পরবর্তীকালে ফরাসিরা এই সংস্কৃতি দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি করে। এরপর গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর, চিলি, আর্জেন্টিনায় গণহারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বামপন্থী বিপ্লবীদের গুম করা হয়। ওই সব দেশের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা গণতন্ত্রপন্থীদের বিমানে করে নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে হাত-পা বেঁধে ফেলে দিতেন। ফরাসিরা ফেলে দিতেন ভূমধ্যসাগরে। গুম করার এই নির্মম পদ্ধতি ‘গোস্ট ফ্লাইট’ হিসাবে পরিচিত। গোস্ট ফ্লাইটের যাত্রীরা আরা কখনই ফিরে আসতেন না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে এমন গুম হওয়ার ঘটনা তাই অবাক করে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে, এই বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম করে দেওয়ার বিষয়টি সরকারি দমনপীড়ন নীতির নিষ্ঠুর পন্থা হয়ে ওঠে।