মশলাপথের দেওয়ালে মিশে থাকা ইতিহাসের ইতিবৃত্ত

New Spice Route: ভারতের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য,দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার বাণিজ্য প্রথা খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দি থেকেই প্রচলিত ছিল।

M

জি-২০ উপলক্ষে একগুচ্ছ নতুন ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ইতিমধ্যেই আলোড়ন ফেলেছে অর্থনৈতিক মহলে। তা হল, ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডর ঘোষণা। এই নতুন বাণিজ্যপথ কি বিশ্বের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল? চিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এই সিদ্ধান্ত, জল্পনা একাংশের মধ্যে।

ওল্ড স্পাইস রুট: 

স্পাইস রুট একটি সামুদ্রিক গতিপথ যা পূর্ববিশ্বের সাথে পশ্চিমের যোগাযোগ রক্ষা করত।জাপানের পশ্চিম উপকূল থেকে, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের মধ্য দিয়ে, ভারতের চারপাশে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে এই পথ প্রসারিত ছিল - এবং সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল ওল্ড স্পাইস রুট। ১৫০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল এই যাত্রাপথ। ইউনেসকো জানাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে এই যাত্রাপথের অন্তর্গত ছোট ছোট বন্দর ধরে যাতায়াত শুরু হয়েছিল। কিন্তু শতাব্দীর সাথে সাথে বাণিজ্য জাহাজ ক্রমশই দূর-দূরান্ত পাড়ি দিতে শিখেছে এই পথ ধরে। মুখ্যত এই পথ ধরে বাণিজ্যের দিগন্তই খুলে গেছিল সারা বিশ্বের সামনে। 

নিউ স্পাইস রুট: 

এ তো গেল ইতিহাসের কথা। আসা যাক বর্তমান প্রসঙ্গে। এখনও টাটকা স্মৃতি জি-২০ -এর সম্মেলন। সেখানেই ঘোষণা হয়েছে নতুন যাত্রাপথটির। ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপের বাণিজ্যিক যাতায়াতের প্রয়োজনে যে 'নিউ স্পাইস রুট'টির কথা ঘোষণা করা হয়েছে তা দুটি করিডোর নিয়ে গঠন করা হবে- 'ইস্ট ওয়েস্ট' বা পূর্ব পশ্চিম এবং 'নর্দার্ন করিডোর' অর্থাৎ উত্তরের যাত্রাপথ। প্রাথমিকভাবে জলপথে এবং ক্রমশ রেলপথে ভারতের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের যোগাযোগ তৈরি করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে যেমন চিনের 'বেল্ড এণ্ড রোড' কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। ঠিক তেমনই, পাকিস্তানের উপরও বাণিজ্যিক যাত্রাপথের জন্য নির্ভরশীল থাকতে হবেনা ভারতকে। জি-২০ -এর মঞ্চে এই অর্থনৈতিক যাত্রাপথের ঘোষণা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেছেন, এই 'করিডোর' স্থাপনের মধ্যে দিয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এক নতুন দিশা পাবে। 

আরও পড়ুন- জি২০: লাভের গুড় ঘরে তুলতে পারল ভারত?

গতিপথের রাজনীতি: 

উল্লেখ্য, এই ঘোষণার সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স এবং প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমন আল সাউদ, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডন্ট উরসুলা ভন ডার লায়েন এবং

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এই যৌথ ঘোষণা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মত রাজনীতিবিদদের। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জগতে ভারতের যাতায়াত অনেক বেশি সুগম হবে তাই নয়, বহু ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের উপর নির্ভরতাও কমে যাবে। 

কী ব্যবসা হত 'ওল্ড স্পাইস রুটে'?

সুতি, রঙ করা পাথর,মশলা,সুগন্ধী দ্রব্য,আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রভৃতি একাধিক দ্রব্য সুপ্রাচীন কাল থেকে এই যাত্রাপথের মাধ্যমে রপ্তানি করে এসেছে ভারত। প্রসঙ্গত, ভারতের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য,দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার বাণিজ্য প্রথা খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দি থেকেই প্রচলিত ছিল। বহু পরে এই বাণিজ্যপথটির নাম হয় 'সিল্ক রুট'। ভারত আয়ুর্বেদ চিকিৎসার জন্মভূমি হিসেবে ঔষদগুণ সমৃদ্ধ বহু গাছ,শিকড় সারা বিশ্বে রপ্তানি করত। খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকে মধ্য এশিয়ায় একটি বৌদ্ধ স্তূপ আবিষ্কৃত হয়। সেখানে পাওয়া এক বৌদ্ধ চিকিৎসকের নোটবইতে ভারতের প্রাচীন ভেষজ উদ্ভিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল ১২.৯.২৩ তারিখে 'Indian Express'- কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে ভারতের দারুচিনি, মুক্তো, হাতির দাঁতের চাহিদা ছিল প্রবল। 

আরও পড়ুন- ইন্ডিয়া নয়, ভারতেই জোর মোদির! জি-২০ তে স্পষ্ট হচ্ছে যেসব ইশারা

উনিশ শতকে কৃত্রিম রঙ উৎপাদনের আগে পর্যন্ত ইউরোপের কাছে ভারতই ছিল নীল রঙ এবং নীল রঙের সুতির প্রধান উৎসস্থল। ইউরোপের রেনেঁসাতেও ভারতীয় মশলা প্রায় অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। 

হারানো গৌরব ফেরাতে মরিয়া মোদি? নাকি নিছকই সারা বিশ্ব থেকে আগত প্রতিনিধিদের ঢাল করে পাকিস্তানকে কিস্তিমাত করা চাল চাললেন তিনি? চিনকে ফেলতে চাইলেন বিপাকে। সেই দিকে চোখ গোটা বিশ্বের। নতুন স্পাইস রুটে কী কী বাণিজ্য হবে? বিগত বেশ কিছু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য, সৌদি আরব, ইজরায়েলের মতো দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ কিছুটা হলেও মজবুত হয়েছে। নতুন স্পাইস রুটের মধ্যে দিয়ে পুরনো সম্পর্কই পুনর্স্থাপিত হতে চলেছে। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

More Articles