কোথায় যায় ইডি-র হাতে উদ্ধার হওয়া কালো টাকা?

বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকে এখনও পর্যন্ত ২৯ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। নানা মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এইসব উদ্ধার হওয়া কালো টাকা কোথায় যায়। আসলে এইসব টাকার ভবিষ্যৎ কী?

২২ কোটির পর ২৯ কোটি।

অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে টাকার পাহাড়। ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছিল প্রায় ২২ কোটি টাকা। এরপর বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট। এখনও পর্যন্ত ২৯ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। নানা মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এইসব উদ্ধার হওয়া কালো টাকা কোথায় যায়। আসলে এইসব টাকার ভবিষ্যৎ কী?

এনডিপিএস আইনে কী আছে
ড্রাগ পাচার কিংবা অন্য কোনও অপরাধ সংগঠিত হয় মুনাফা পাওয়ার আশায়। এইসব কালো টাকা কিংবা অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায় এনডিপিএস আইনে। এই আইনের চ‍্যাপ্টার ভিএ-তে উল্লেখ করা আছে অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কৌশল।

আরও পড়ুন: মাথা থেকে পা পচে যাওয়া, চোখে ঠুলি পরে মেনে নেওয়া আর কতদিন?

১. যে ব্যক্তি এই আইনে দোষী সাব্যস্ত হবে, তার ১০ বছর পর্যন্ত বা তার বেশি জেল হতে পারে।

২. ভারতের বাইরেও কোনও আদালত ফৌজদারি অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে।

৩. প্রিভেনশন অফ ইললিসিট ট্র্যাফিক ইন নারকোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রফিক সাবস্ট‍্যান্সেস আইন, ১৯৮৮ (১৯৮৮-এর ৪৬) অথবা জম্মু এবং কাশ্মীর প্রিভেনশন অফ ইললিসিট ট্র্যাফিক ইন নারকোটিক ড্রাগস অফ সাইকোট্রফিক সাবস্ট‍্যান্সেস আইন, ১৯৮৮-এর অধীনে কাউকে আটকের অধিকার আছে।

কৌশল
১. প্রত্যেক অফিসার এবং পুলিশ স্টেশনের অফিসার ইন-চার্জকে এই আইনের ৫৩ ধারা অনুযায়ী এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তাঁরা কোনও অবৈধ সম্পত্তি (ট্রেস অ্যান্ড আইডেন্টিফাই) চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত, করতে পারেন।

২. একজন অফিসার অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অবৈধ সম্পত্তি যদি বাজেয়াপ্ত করা না যায়, তাহলে তিনি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে নির্দেশের কপি পাঠাতে পারেন।

৩. উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে এই নির্দেশ পাওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে তা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এটা আর ভ্যালিড, অর্থাৎ কার্যকর থাকবে না।

৪. উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তকে একটি নোটিস দেয়। তার উত্তর এবং অন্যান্য রেকর্ড খতিয়ে দেখে। এরপর অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয়।

৫. যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেফতার হয়, তাহলে বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির গতি করা হবে তিনি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর।

৬. ইললিগালি অ্যাকোয়ার্ড প্রপার্টি রুল অনুযায়ী বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির গতি করেন কর্তৃপক্ষ।

ভারত সরকার এই অফিসারদের নিয়োগ করেন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসক হিসেবে।

অর্পিতার বাড়ি থেকে এত সম্পত্তি পাওয়ার পর নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো গেল কোথায়? এর আগে অভিযুক্তদের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ও সম্পত্তি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার মালখানায় রাখা হতো। মালখানার বাইরে নিযুক্ত থাকত সশস্ত্র পাহারাদার। তদন্তকারী অফিসাররা একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, পাহারা পেরিয়ে কারও পক্ষে মালখানায় ঢুকে নগদ টাকা চুরি সম্ভব নয়।

কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পর দেখা যায়, বহুসংখ্যক নোট উধাও। বেশ কিছু নোট ছেঁড়া অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু নোট খেয়ে গিয়েছে ইঁদুর। টাকার বান্ডিলে থাবার বসিয়েছে উইপোকাও। এখন আর উদ্ধার হওয়া টাকা নিজেদের জিম্মায় রাখার ঝুঁকি নিচ্ছে না সিবিআই, ইডি অথবা আয়কর দফতরের অফিসাররা। তাহলে কোথায় যায় এই সব টাকা?

সাধারণত উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা জমা রাখা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সিবিআই বা ইডির অ্যাকাউন্টে। অথবা ব্যাঙ্কে থাকা নিজস্ব ভল্টেও রাখা হয়।

অর্পিতার টাকা ভল্টে
সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে অভিযুক্ত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতার বাড়ি থেকে যে টাকার পাহাড়, বিদেশি মুদ্রা ও সোনা ইডি উদ্ধার করেছে, তা রাখা আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ভল্টে। আদালতে যদি প্রমাণ হয় শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি থেকেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ঘুরে অর্পিতার কাছে এই অর্থ এসেছে, সেক্ষেত্রে পাকাপাকিভাবে তা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষে জমা হবে। কিন্তু ইডি তা প্রমাণ করতে না-পারলে সুদসমেত ওই অর্থ ফেরত পাওয়ার কথা অর্পিতারই। কারণ খাতায়-কলমে সেসবের মালিক অর্পিতা। ২ বছর আগে একটি মামলায় আদালতের নির্দেশে ১৯৯৫ সালে আটক করা নগদ অর্থ ফেরত দিতে হয়েছে তাদের। আটক করা হয়েছিল ৭.৯৫ লক্ষ টাকা। ২৫ বছর পর সুদ-সহ ২০ লক্ষ টাকা ফেরত দিতে হয়। এক্ষেত্রে অর্পিতার দাবি উল্টো, ওই বিপুল অর্থ, গয়না কিছুই নাকি তাঁর নয়।

ইডি-র হিসেব কী বলছে?
ইডি-র হিসেব বলছে, গত কয়েক বছরে আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০২২ এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত ইডি প্রাথমিকভাবে মোট ১ লক্ষ ৪ হাজার ৭০২ কোটি টাকা নগদ সম্পত্তি আটক করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৮৬৯ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা গিয়েছে। ২০১৯-'২০ থেকে আর্থিক নয়ছয় প্রতিরোধ আইনে ইডি-র দায়ের করা মামলার সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২০-তে ৯৮১টি, ২০২১ থেকে ২০২২-এ ১১৮০টি মামলা দায়ের হয়েছে।

ইডি, সিবিআইয়ের অর্থ, বেআইনি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ইতিহাস লম্বা। গত এক বছরে এই তালিকায় এসেছে রাঘব বোয়ালদের নাম। যেমন, গত বছর রোজভ্যালি কাণ্ডে সক্রিয় হয় ইডি। কারণ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এবার এর জাল গোটাতে চাইছে। গত বছর এক অভিযান চালিয়ে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার ২৬ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। জানা গিয়েছে, রোজভ্যালির মালিকানাধীন বিভিন্ন হোটেল, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ডিমান্ড ড্রাফ্ট বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি। সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্টের অধীনে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। আইকোর কোম্পানির প্রোমোটার ডিরেক্টর ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ইডি। যার আর্থিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকার বেশি বলে জানা গিয়েছে। আইকোরের তদন্তভার হাতে নেওয়ার পর এটাই ইডির হাতে প্রথম বাজেয়াপ্তর ঘটনা।

গত বছর জুনে খাস কলকাতায় কয়লা পাচার কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত বিনয় মিশ্রর ৬ কোটির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ইডি।

আগে সিবিআই, ইডির জালে ধরা পড়েছিল অনেক রাঘব বোয়ালই। এবার খাবি খাচ্ছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। জল কোথায় গড়াবে, দেখা যাক।

More Articles