দু-দশকের লাগাতার চেষ্টা! তবু কেন কখনও পাশ হয়নি মহিলা সংরক্ষণ বিল
Women's Reservation Bill: প্রায় কয়েক দশক ধরে ফাইলে পড়ে রয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল সংক্রান্ত প্রস্তাব। এতদিন পরে কি শেষপর্যন্ত গতি হতে চলেছে সেই বিলটির?
পুরনো সংসদ ভবনের ইতিহাস-মায়া পিছনে ফেলে মোদি সরকারের নতুন কীর্তি সেন্ট্রাল ভিস্তায় উঠে এসেছে গোটা লোকসভা। এখন থেকে অধিবেশন সেখানেই। রীতিমতো তিথি নক্ষত্র দেখে গণেশ চতুর্থীর শুভ মুহুরতেই নতুন ভবনে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেন্দ্র সরকার। সোমবারই ডাকা হয়েছে সংসদের বিশেষ অধিবেশন। শুধু নতুন ভবনে পা দেওয়ার জন্য়ই কি এত তোড়জোর? নাকি বড় কোনও ঘোষণা করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সোমবার অবশ্য অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। এমনিতেও আপাতত কেন্দ্রের অ্যাজেন্ডায় রয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল-সহ একগুচ্ছ জরুরি বিল। সেসব নিয়েই কি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হবে এই বিশেষ অধিবেশনে। নাকি অন্য কিছু। এ নিয়েই দিনভর জল্পনা চলছে সোমবার থেকে। মঙ্গলবার কাটল সেই জল্পনার জাল। মহিলা সংরক্ষণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
প্রায় কয়েক দশক ধরে ফাইলে পড়ে রয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল সংক্রান্ত প্রস্তাব। এতদিন পরে কি শেষপর্যন্ত গতি হতে চলেছে সেই বিলটির! মঙ্গলবার সকালে মন্ত্রিসভার বৈঠকেই নরেন্দ্র মোদি জানিয়ে দিয়েছিলেন, সাংসদদের জন্য অগ্নিপরীক্ষার পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে। এই বিল পাশ করানোর কাজ ততটাই শক্ত বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সেই বৈঠকেই মহিলা সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিলটি অনুমোদন করেছে মোদির মন্ত্রিসভা।
আরও পড়ুন: সংবিধান সদন : নতুন যে নামে পুরনো সংসদ ভবনকে চিনতে চলেছে দেশ
কী এই মহিলা সংরক্ষণ বিল? ২০০৮ সালের ১০৮তম সংশোধনী বিল চায় লোকসভা ও বিধানসভার মোট আসনের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে। এই ৩৩ শতাংশের মধ্যে আবার তফসিলি জালি, উপজাতি ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষিত থাকবে। এই সংরক্ষিত আসনগুলো প্রতিবছর একটি রাজ্য বা এলাকা থেকে আসবে তা নয়, বরং বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে ঘুরতে থাকবে এই সুবিধা।
এই বিলের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ যে বরাবর ছিল, তা কিন্তু নয়। শুধমাত্র সংসদেই, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাতেও যে এখন মেয়েদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকে, তা-ও কিন্তু একদিনের ঘটনা নয়। ১৯৮৯ সালের মে মাসে প্রথমবার লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিলটি পাশ হয়। নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। তবে লোকসভায় পাশ করা গেলেও রাজ্যসভাগুলিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেই বিল। তবে সূচনাটুকু হয়ে গিয়েছিল অবশ্যই।
এর পর ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে ফের বিলটি আনার চেষ্টা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও। লোকসভার দুই কক্ষেই পাশ হয়েছিল সংশোধনী বিল ৭২ এবং ৭৩। তবে তা ছিল কেবলমাত্র গ্রামাঞ্চল ও শহরের বিভিন্ন সংস্থার জন্য। সেই বিলের দৌলতেই আজও দেশের পঞ্চায়েত ও মিউনিসিপ্যালিটিগুলিতে প্রায় ১৫ লক্ষ নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি রয়েছেন।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার সংসদে মহিলা সংরক্ষণ নিয়ে লোকসভায় ৮১তম সংশোধনী বিল পেশ করে দেবেগৌড়ার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার। তবে লোকসভায় অনুমোদন পায় না সেটি। পরে গীতা মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয় সেটিকে। 1996 সালের ডিসেম্বরে তার রিপোর্ট পেশ করে মুখার্জি কমিটি। তবে লোকসভা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে বিলটিও বাতিল হয়ে যায়।
তবু মহিলা সংরক্ষণের মতো ইস্যুর গুরুত্ব শেষ হয়নি। ১৯৯৮ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার ফের বিলটিকে লোকসভায় পাশ করানোর চেষ্টা করে। তবে সেবারও সমর্থনের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল মহিলা সংরক্ষণ বিল। বাজপেয়ি জমানায় এর পরে ১৯৯৯, ২০০২ এবং ২০০৩ সালে ফের চেষ্টা হয়েছিল বিলটি পাশ করানোর, তবে সাফল্য আসেনি।

২০০৪ সালে গদির মালিকানা বদলায়। এনডিএ সরে আসে ইউপিএ সরকার। মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ফের সংসদে ওঠে বিলটি। ২০০৮ সালের ৬ মে শেষপর্যন্ত পেশ করা গিয়েছিল বিলটি। ১৯৯৬ সালের গীতা মুখার্জি কমিটির সাতটি সুপারিশের মধ্যে পাঁচটি এইবারের সংস্করণে জোড়া ছিল। ওই বছরই বিলটি স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছিল। ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্থায়ী কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে অনুমোদনে স্ট্যাম্প পায় শেষমেশ বিলটি। শেষ পর্যন্ত রাজ্যসভায় পাশ হয় ভোটে। তবে লোকসভায় পাশ হওয়া আর তার হয়নি।
ফলে বুঝতেই পারছেন চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযানের সফট ল্যান্ডিংয়ের চেয়েও ঢের বেশি কঠিন মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ। কেন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী একে অগ্নিপরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করেছেন, তা-ও বুঝতে অসুবিধা হয় না। অতীতে চাইলে দেখা যাবে, প্রায় দলমত নির্বিশেষ যে যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তারাই এই বিলটি পাশ করার চেষ্টা করেছে। তবু কখনও মতানৈক্য হয়নি কেন সেটাই অবাক করা বিষয়।
আরও পড়ুন:নতুন পার্লামেন্ট গড়তে ৮৩৬ কোটি! পুরনো সংসদ ভবন তৈরি হয়েছিল কত টাকায়?
যদিও এবার মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী শোনাচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, আরও বেশি সংখ্যক মহিলা দেশের উন্নয়নের কাজে হাত লাগাক, সেটাই তিনি চান। প্রায় দু-দশকের বেশি সময় ধরে এই বিল চেয়ে আসছেন বিরোধীদল কংগ্রেস-সহ অনেকেই। ফলে মোদি সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা জয়রাম রমেশ। তবে তাঁর বক্তব্য,অধিবেশনের আগে ডাকা সর্বদল বৈঠকে এ নিয়ে ভালো ভাবে আলোচনা করা যেত। এত ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাবে কাজ করা নিয়ে তোপ দেগেছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা। এরই মধ্যে আবার মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশের দাবিতে নয়াদিল্লিতে অনশন শুরু করেছেন ভারত রাষ্ট্র সমিতির নেত্রী কে কবিতা। তাঁকে সঙ্গ দেন টিআরএস মন্ত্রী সবিতা ইন্দ্র রেড্ডি এবং সত্যবতী রাঠৌর।
সব মিলিয়ে দু-দশকের সম্ভাবনা আর আশা বুকে নিয়ে আপাতত প্রতীক্ষায় গোটা দেশ। চাঁদের মাটি ছুঁয়ে ফেলল ভারত। নতুন সংসদ ভবনে এ বারে কি পাশ হবে মহিলা সংরক্ষণ বিল? সেদিকেই তাকিয়ে দেশবাসী।

Whatsapp
