কেন দু'ঘণ্টা থমকে হোয়াটসঅ্যাপ, আপনার ব্যক্তিগত ডেটার ক্ষতি হলো না তো?
WhatsApp Down: ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো সার্ভিস অনেক বেশি মানুষ অনেক দীর্ঘ সময়ের জন্য একটানা ব্যবহার করেন। এর ফলে সমস্যার সম্ভাবনা বাড়ে।
দু'ঘণ্টার দীর্ঘ অপেক্ষার পর কোটি কোটি ব্যবহারকারীকে স্বস্তি দিয়ে পরিষেবা স্বাভাবিক হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের। মঙ্গলবার প্রায় দু'ঘণ্টা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর দুপুর ২:২০ মিনিট থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ পরিষেবা। কিন্তু মাত্র দু'ঘণ্টার এই অপেক্ষা যেন কয়েকজনের জন্য হয়ে উঠেছিল কয়েক বছরের অপেক্ষা। মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই মেসেজ পরিষেবা প্রদানকারী অ্যাপের সার্ভার। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ১১ হাজারের বেশি ব্যবহারকারী এই অ্যাপের গোলযোগের কথা জানিয়েছিলেন টুইটার এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আজকে থেকে অভিযোগ। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের নানা দেশ থেকে এই অ্যাপ বন্ধ হবার কথা জানান অনেকে। কেউ আবার বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে পাঠানো বার্তা সিঙ্গেল টিক থেকে ডাবল টিক হচ্ছে না। মেটার তরফে দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল ব্যবহারকারীদের। সূত্রের খবর, ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড পার হওয়ার পর স্বাভাবিক হয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপ পরিষেবা।
কিন্তু ততক্ষণে সামাজিক মাধ্যমে কার্যত ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা যাচ্ছে না, জানাতে তৈরি হয়ে গিয়েছে অসংখ্য ব্যঙ্গচিত্র। অনেকে আবার লিখছেন, "ফোন ছাড়া থাকা যায় কিন্তু, হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া বোধহয় থাকা যায় না"। আবার অনেকে মনে করছেন, সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমেই ডাউন করিয়ে দেওয়া হয়েছিল মেটার সার্ভার। ফলে সমস্যা হয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপে। কিন্তু, এই পুরো সমস্যার আসল কারণ কী? আদৌ কি এই কারণ পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে কোম্পানি? এই সার্ভার ডাউনের ফলে আপনার ব্যক্তিগত ডেটার ক্ষতি হলো কি? চলুন, এ ব্যাপারে জানা যাক বিস্তারিত।
শুধু কি ভারতেই হয়েছিল বিভ্রাট?
এ প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর হলো না। শুধুমাত্র ভারতে নয়, বিশ্বের একাধিক দেশে হোয়াটসঅ্যাপের এই সমস্যার খবর মিলেছে। একটা দীর্ঘ সময় যাবত টুইটারেও ট্রেন্ডিং হয়ে উঠেছিল #WhatsAppDown হ্যাশট্যাগটি। ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া এবং কিছু স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহারকারী দেশে এই সমস্যার খবর মিলেছে। অর্থাৎ শুধু ভারত নয় বিশ্বের নানা দেশে এই একই সমস্যা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
আদতে কী সমস্যা হয়েছিল?
WhatsApp কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে পরিষ্কারভাবে এই সমস্যার ব্যাপারে আলোকপাত না করা হলেও, সাইবার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনের ডিএনএস সার্ভারে হয়েছিল সমস্যা। ২০২১ সালে অক্টোবর মাসে যখন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপের সার্ভার একসঙ্গে ডাউন করেছিল, সেই সময় ওই সার্ভারের ডিএনএসে একটা বড় সমস্যা লক্ষ্য করেছিলেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। প্রায় ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় মেটার ডোমেইন নেম সিস্টেম আবারও সঠিক করতে পেরেছিলেন সংস্থার সফটওয়্যার ডেভেলপাররা।
যদি আপনার সার্ভারের DNS কাজ না করে, তাহলে আপনার কম্পিউটার অথবা স্মার্টফোনের ব্রাউজার সে নির্দিষ্ট হোস্ট অথবা ওয়েবসাইট পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনা। DNS হলে এমন একটি সিস্টেম যেটি inscript.me এর মতো ডোমেইন নেমকে ব্রাউজারের বোঝার মতো নিউমেরিক আইপি অ্যাড্রেসে পরিবর্তন করে। যদি DNS সেটিংসের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয়, তখন আপনার কম্পিউটার অথবা আপনার মোবাইলের ব্রাউজার সেই নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটটিকে অ্যাক্সেস করতে পারে না। আপনার ব্রাউজার বুঝে যায় সে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের পোস্ট ডাউন রয়েছে এবং তৎক্ষণাৎ সেই ওয়েবসাইটকে ক্লোজ করে দেয়।
আরও পড়ুন- গীতা ছুঁয়ে শপথ, ঋষি সুনককে কেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানল ব্রিটেন
তবে, এক্ষেত্রে কিন্তু সমস্যাটা DNS-এর ছিল না। এই সমস্যার প্রধান কারণ ছিল BGP রাউটিং। সহজ করে বলতে গেলে BGP বা বর্ডার গেটওয়ে প্রটোকল হলো এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক অপর একটি নেটওয়ার্কে যাওয়ার জন্য সব থেকে সহজতম রাস্তা খুঁজতে পারে। আপনি যদি ছোট কোন ওয়েবসাইট খোলেন, সেখানে সাধারণত খুব কম সংখ্যক সার্ভার থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট ওয়েবসাইটে একটি সার্ভার থাকে এবং সেই সার্ভারের মাধ্যমেই পুরো ওয়েবসাইট কাজ করে। যদি কোনওভাবে সেই সার্ভার ডাউন করে, সেক্ষেত্রে সেই একটি সার্ভার ঠিক করতে পারলেই আবারও ওয়েবসাইট পুরনো জায়গায় ফিরে আসে।
কিন্তু যখন আপনি ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম চালাচ্ছেন, সেখানে একটি নয় বরং একাধিক সার্ভার তৈরি করা থাকে যাতে কোনওরকম সমস্যা হলে একটি ব্যাকআপ সার্ভার সেই জায়গা নিতে পারে। ব্যবহারকারীদের যাতে কোন রকম কোনও সমস্যা না হয় তার জন্য এই সমস্ত বড় সোশ্যাল মিডিয়া জায়েন্টগুলি প্রস্তুত থাকে। তবে এক্ষেত্রে ঘটনাটা অন্যরকম ছিল। যেহেতু বর্ডার গেটওয়ে প্রটোকল ঠিকভাবে কাজ করেনি, ফলে একটি নেটওয়ার্কের সঠিক সার্ভার খুঁজতে সমস্যা হয়েছে। ফলত, একটি সার্ভারের উপরে সমস্ত চাপ পড়ে যাওয়ার কারণে ডাউন করেছে হোয়াটসঅ্যাপ।
মার্চ ২০২১ সালেও, এই একই কারণবশত ৪৫ মিনিটের জন্য হোয়াটসঅ্যাপের পরিষেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় শুধুমাত্র টেকনিক্যাল ইস্যু বলে কাজ চালিয়ে দেওয়া হলেও, এই সমস্যা ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের এই প্রথম নয়। বারবার এই সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যমগুলি এই বর্ডার গেটওয়ে প্রটোকলের সমস্যায় ভুগে থাকে। ২০২০ সালেও হোয়াটসঅ্যাপে চারবার সার্ভার সমস্যা দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল জানুয়ারি মাসে, যা মোটামুটি তিন ঘণ্টার জন্য স্থায়ী হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ঘটেছিল এপ্রিল মাসে, যেটি দু'ঘণ্টার জন্য স্থায়ী হয়েছিল, তৃতীয়টি হয়েছিল জুলাই মাসে এবং সেটিও ছিল দু'ঘণ্টার জন্য। সবশেষে চতুর্থটি ঘটেছিল ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। তবে সে সময়ে বেশিক্ষণ এই সমস্যা স্থায়ী হয়নি।
কেন বারবার ঘটে এই সমস্যা?
এই মুহূর্তে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুক বিশ্বের সবথেকে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। এই মুহূর্তে হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ বিলিয়ন এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ বিলিয়ন। এত বেশি সংখ্যক ব্যবহারকারীকে একসঙ্গে সামলাতে রীতিমতো সমস্যায় পড়ে থাকে এই দু'টি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের সার্ভার। প্রত্যেকটি সার্ভারের একটি নির্দিষ্ট লিমিট থাকে। যদি কোনও নির্দিষ্ট সময়ে, অনলাইন ব্যবহারকারীর সংখ্যা, মেসেজ পাঠক অথবা প্রাপকদের সংখ্যা সেই সীমা অতিক্রম করে ফেলে, তখনই শুরু হয় এই বর্ডার গেটওয়ে প্রটোকলের সমস্যা। ফলে সঠিক সার্ভার খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রেও শুরু হয় সমস্যা এবং ডাউন করে সেই নির্দিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম।
এত বড় আকারের কোনও একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম চালাতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ডেটা সেন্টার তৈরি করতে হয় সেই সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্মকে। তবে এবারের গেটওয়ে সমস্যাটি হয়েছিল ভারতের ডেটা সেন্টার থেকে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মঙ্গলবার যেহেতু দীপাবলি ছিল, সেই কারণে দুপুর ১২ টা নাগাদ একটা বড় সংখ্যক মানুষ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে একে অপরকে 'দিওয়ালি শুভেচ্ছা' জানাতে মেসেজ করেছিলেন। একটা ছোট সময়ের ব্যবধানে এতগুলি মেসেজ চলে আসার কারণে সার্ভার পরিবর্তনের সময়টুকু পায়নি হোয়াটসঅ্যাপের DNS। ফলে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে যায় এই মেসেজিং সার্ভিস অ্যাপ্লিকেশন।
আরও পড়ুন- মানুষের ভাষা ভাঙছে সোশ্যাল মিডিয়া, তলিয়ে যাচ্ছে মুখোমুখি আলাপের আবেগ?
ব্যক্তিগত ডাটা চুরি হয়েছে কি?
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যদি কোনও হ্যাকার এতগুলি সার্ভার প্রটোকল ভেঙে কোনও সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের DNS অ্যাক্সেস করে নিতে পারেন, তবেই তিনি সেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য পেতে পারেন। তবে DNS অ্যাকসেস করা মানেই সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য পেয়ে যাওয়া নয়। এরপরে আরও কিছু ধাপ পেরোলে তবেই সেই হ্যাকার ওই তথ্য পেতে পারেন। সাধারণ সার্ভার খুব সহজেই হ্যাক করা গেলেও হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের মতো বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সার্ভার হ্যাক করা এত সহজ কাজ নয়। অত্যন্ত উঁচু মানের সিকিউরিটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে এই সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে।
উপরন্তু, এবারের হোয়াটসঅ্যাপের গোলযোগটি DNS সিস্টেমের সমস্যার জন্য ঘটেনি। ঘটেছে বর্ডার গেটওয়ে প্রোটোকলের জন্য। ফলে বলা যেতে পারে, সার্ভার ডাউন হলেও আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কোনও হ্যাকারের হাতে চলে যায়নি।
ঘন ঘন কেন সমস্যায় পড়ছে সার্ভার?
এই ধরনের সার্ভার ডাউন হওয়ার সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ হলো অত্যধিক জনপ্রিয়তা। আজকাল বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মানুষ কোনও না কোনও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। আর সোশ্যাল মিডিয়ার কথা বলতে গেলে ফেসবুক সব থেকে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। এই সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে প্রায় ৩ বিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছেন। ফলে এত বড় সংখ্যক ব্যবহারকারীকে একসঙ্গে সামলানো কোনও সার্ভারের পক্ষে সহজ বিষয় নয়। গুগলে হয়তো এর থেকেও বেশি ব্যবহারকারী থাকেন। তবে সেটি কিন্তু একটি সার্চ ইঞ্জিন। ফলে খুব বেশি মানুষ একই সময়ে একই সঙ্গে দীর্ঘক্ষণের জন্য গুগল সার্ফ করেন না। ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো সার্ভিস অনেক বেশি মানুষ অনেক দীর্ঘ সময়ের জন্য একটানা ব্যবহার করেন। এর ফলে সমস্যার সম্ভাবনা বাড়ে।
এত বড় ব্যবহারকারীর বেস সামলানো এখনও পর্যন্ত বিশ্বের কোনও কোম্পানির পক্ষেই সহজ বিষয় নয়। গুগলের মতো সার্ভারও কিন্তু মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়ে। গত বছর একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জিমেইল সার্ভিস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ইউটিউব সহ গুগলের সমস্ত পরিষেবা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য। পাশাপাশি, আজকালকার দিনের থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশনের প্রতিও নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে সবকিছু মিলিয়ে বলাই যায়, যদি ব্যবহারকারীরা নিজে থেকে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিংয়ের অভ্যাস পরিবর্তন না করতে পারেন, তাহলে পরবর্তীতে এই সমস্যা আরও বাড়বে।