কর্নেল সোফিয়া কুরেশি: একতা ও সম্প্রীতির প্রশ্নে অপারেশন সিঁদুরের মাস্টারস্ট্রোক
Colonel Sophia Qureshi: বর্তমানে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ভারতীয় সেনার ‘সিগন্যাল কর্পস’-এর কর্নেল, তাঁর স্বামী মেজর তাজউদ্দিন কুরেশি, ‘মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি’ ইউনিটে কর্মরত।
পহেলগাঁও সন্ত্রাসবাদী হামলার পর যখন গোটা দেশ ক্ষোভে উত্তাল, তখন সীমান্তের ওপারে ভারতের সেনাবাহিনীর এক নিখুঁত প্রত্যাঘাত ইতিহাসের পাতায় সূচনা করল এক নতুন অধ্যায়ের। নাম—অপারেশন সিঁদুর। পাকিস্তান এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত নয়টি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি এই অভিযানে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু এই সামরিক কৃতিত্বের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে এর প্রতীকী তাৎপর্য। হামলার পর সারা দেশ যখন ধর্মের বিভাজনে উন্মত্ত, নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ পড়শি এদেশের সংখ্যালঘুদের 'শত্রু' ভাবতেই শুরু করছে, তখন, সেই প্রেক্ষাপটে এই অভিযানে অন্যতম মুখ হয়ে উঠলেন একজন মহিলা অফিসার, কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। ধর্মে যিনি মুসলিম।
দেশের কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী, সংবাদমাধ্যম এবং অজস্র, অগুনতি সাধারণ মানুষ পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের পর সমগ্র মুসলিম সমাজকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছিল। সেই মুহূর্তে অপারেশন সিঁদুরে সোফিয়া কুরেশির উপস্থিতি যেন এই মৌলবাদী প্রচারের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় প্রতিবাদ হয়ে উঠল। ধর্ম নয়, কর্তব্যই বড়। সেই কর্তব্যবোধই তাঁকে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এক অনন্য মুখ করে তুলেছে।
জাতীয় মিডিয়া সেন্টারে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে যে প্রেস ব্রিফিং হয়, সেখানে পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির পাশে ছিলেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। একজন হিন্দি ও অন্যজন ইংরেজিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংসের সূক্ষ্ম পরিকল্পনার। এটি শুধু কূটনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্যের দৃষ্টান্ত নয়, ভারতের নারীশক্তির এক দৃশ্যমান ঘোষণাও বটে।
একদিকে কাশ্মীরি পণ্ডিত বিক্রম মিশ্রি, অন্যদিকে মুসলিম নারী সেনানায়ক— এ যেন এক প্রগাঢ় বার্তা যে ভারত ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠনের তত্ত্ব মানে না। ভারতের ভিত্তি হলো সংবিধান, নাগরিকতা ও কর্তব্যবোধ। সেনা ও কূটনীতির মিশ্রণে এই দৃশ্যপট যেন এক যুগান্তকারী বার্তা বহন করে—এখানে নারী, ধর্ম ও পেশাগত দক্ষতা সমান মর্যাদার অধিকারী।
কর্নেল সোফিয়া কুরেশি
সোফিয়া কুরেশি আচমকাই এখন দেশের নায়িকা হয়ে ওঠেননি। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই নিঃশব্দে লড়াই করে এসেছেন একাধিক প্রেক্ষাপটে। ১৯৯৯ সালে অফিসার্স ট্রেনিং আকাডেমি থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। একাধারে তিনি ভারতের সিগন্যাল কর্পসের প্রথম মহিলা কর্নেল, আবার ২০১৬ সালে ‘FORCE 18’ মহড়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বও দিয়েছেন—যা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম বহুজাতিক সামরিক প্রশিক্ষণ। ভারতীয় সেনার ৪০ সদস্যের দল অংশগ্রহণ করেছিল এই মহড়ায়, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানবিক মাইন নিষ্কাশন’ ও ‘শান্তিরক্ষী কার্যক্রম’। সেই সময় সোফিয়া কুরেশি লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন, বয়স মাত্র ৩৫। তাঁর পদচিহ্ন কঙ্গোর শান্তিরক্ষা মিশন থেকে শুরু করে এখনকার পাকিস্তান সীমান্তে, সবখানেই।
বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তরের পরে তিনি ভারতীয় সেনায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর পরিবারে অনেকেই সেনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কর্নেল কুরেশির দাদু ছিলেন একজন সৈনিক, তাঁর বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর এক ধর্মীয় শিক্ষক। অন্যদিকে তাঁর স্বামী তাজউদ্দিন কুরেশিও ভারতীয় সেনায় কর্মরত। বর্তমানে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ভারতীয় সেনার ‘সিগন্যাল কর্পস’-এর কর্নেল, তাঁর স্বামী মেজর তাজউদ্দিন কুরেশি, ‘মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি’ ইউনিটে কর্মরত।
নারীশক্তি— স্লোগান নয়, বাস্তব
সোফিয়া কুরেশির পাশেই ছিলেন উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং, যিনি ভারতীয় বায়ুসেনার হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে ২৫০০ ঘণ্টারও বেশি উড়ান পরিচালনা করেছেন। তিনি ২০২১ সালে মহিলা ত্রিস্তরীয় অভিযানের অংশ হিসেবে ২১,৫০০ ফুট উঁচু মানিরাং পর্বতেও অভিযান চালান। অপারেশন সিঁদুরের নেতৃত্ব দিয়ে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও ব্যোমিকা সিংয়ের মতো মহিলারা প্রমাণ করেছেন, শুধুই সংসার সামলে 'সিঁদুর' রক্ষা করা তাঁদের কাজ না। সমস্ত কাজে সমান দক্ষতার প্রশ্নে সিঁদুরকে 'অপারেশন' করে নিতে পারেন তাঁরা।
চিন্তা বদলেছে বিশ্বরাজনীতির
ভারতের এই ঝাঁঝালো জবাব কেবল পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের উদ্দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। চিন, যে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের “অল-ওয়েদার ফ্রেন্ড” হিসেবে পরিচিত ছিল, তার মধ্যেও এখন দ্বিধা ও কৌশলগত দূরত্ব স্পষ্ট। একদিকে গালওয়ানের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে ভারতের প্রতিরক্ষা বার্তা— দুই মিলিয়ে বেজিংয়ের অন্দরেও এখন নতুন হিসেব শুরু হয়েছে। চিন এখন বলছে, তারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার মঞ্চে এবারে হয়তো দেখা যাবে চিনের উপস্থিতিও।
মিথভাঙার গল্প লিখলেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি
অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যের পর কর্নেল সোফিয়া কুরেশির বাবা তাজ মহম্মদ কুরেশি বলেছেন, “আমার মেয়ে দেশের জন্য কিছু করেছে, এই অনুভূতি আমাদের গর্বে বুক ভরে দেয়।” তাঁর মা হালিমা কুরেশি বলছেন, “যে সমাজে মেয়েদের পড়াশোনা করাতেই ভয় পায় অনেকে, সেখানে আমার মেয়ের সাফল্য অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করবে।”
এই পুরোটাই যেন এক মিথভাঙার গল্প। পহেলগাঁও হামলার পর যখন কিছু চরমপন্থী শক্তি ধর্মকে হাতিয়ার করে ঘৃণার রাজনীতি করতে শুরু করেছে, তখন সোফিয়া কুরেশির মতো অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ভারতের সংহতির মূল ভিত্তি ধর্ম নয়, কর্তব্য, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম। আজ যখন ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন রাজনীতির একটা অংশ হয়ে উঠেছে, মহিলাদের অধিকার হরণ এবং জাতীয়তাবাদের নামে ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনা বাড়ছে, তখন কর্নেল সোফিয়ারা যেন এক উল্টো পথ দেখাচ্ছেন।
সিঁদুরের রঙ, প্রতিরোধের প্রতীক
অপারেশন সিঁদুরের নামটি তাই খুবই গভীর ও তাৎপর্যময়। সিঁদুরকে অনেক মহিলা 'স্বামীর মঙ্গল'-এর প্রতীক মনে করেন। আর ‘অপারেশন সিঁদুর’ ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মহিলাদের নেতৃত্বকে সগর্বে তুলে ধরেছে। কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংয়ের মতো অফিসাররা যখন অপারেশন ‘সিঁদুর’-এর অন্যতম মুখ হয়ে উঠে আসেন, তখন তা শুধুই সেনা অভিযানের কাহিনি হয়ে থেমে থাকে না—তা হয়ে ওঠে ধর্মীয় সম্প্রীতির, লিঙ্গ সমতার এবং রাষ্ট্রশক্তির এক সংহত ঘোষণাপত্র। পাকিস্তান যখন ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’ তুলে ধরে হিন্দু-মুসলিমকে চিরকালীন শত্রু হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে, তখন ভারত প্রত্যুত্তরে তুলে ধরছে এমন এক বাস্তবতা, যেখানে একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি, এক মুসলিম মহিলা অফিসার কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং একজন হিন্দু উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং—সবাই এক কণ্ঠে দেশের পক্ষে কথা বলছেন। এটাই ভারতের যোগ্যতম উত্তর। এই উত্তর জঙ্গিদের মতো বেসামরিক সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করে না, এই উত্তর দেয় প্রতিরোধ গড়ে একতা দিয়ে।