হিন্দু হলেই নাগরিকত্ব নিশ্চিত? CAA-তে আবেদন জানাতে পারবেন কারা?

CAA Implementation: এই আইন এনে আসলে হিন্দুদেরই 'প্রাধান্য' দেওয়া হচ্ছে, এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছে বিজেপি সরকার। কিন্তু কাগজ না থাকলে ২০১৪ সালের আগে ভারতে আসা অভিবাসী হিন্দুদের জন্যও কোনো বিকল্প খোলা রাখা হয়নি...

দুয়ারে লোকসভা ভোট। আর ঠিক তার আগেই 'ইলেক্টোরাল বন্ড' প্রকল্প মামলায় সুপ্রিম কোর্টে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি সরকার। ইতিমধ্যেই সেই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির কোটি কোটি টাকার হিসেব জনগণের সামনে। এই পরিস্থিতিতে সেই বিষয় থেকে জনগনের নজর ঘোরাতেই দেশ জুড়ে জারি করা হল সিএএ। আর তা জারি হল এমন এক সময়, যখন রমজান মাস সবে শুরু হয়েছে। গত ১১ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়, দেশ জুড়ে কার্যকর করা হল সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ড অ্যাক্ট (CAA)। মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই নিয়ে এসেছিল আইন। তবে তা কার্যকর করতে লেগে গেল প্রায় চার বছর। আগেও সিএএ নিয়ে প্রচুর বিক্ষোভের মুখে পড়েছে দেশ। সিএএ বিরোধিতায় পথে নেমেছেন আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিবিধ রাজ্যের সাধারণ নাগরিক। বহু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও এই আইনের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। তবে রাজনৈতিক ভাবে বিরোধিতা জানালেও, প্রশাসনিক ভাবে আদৌ এই আইনের পথে কাঁটা হতে পারবে কি কোনও রাজ্যের সরকার। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, এই আইন বলবৎ হওয়া নির্ভর করছে অনেকটাই জনগণের উপরে।  যত বেশি সংখ্যক মানুষ সিএএ-র পোর্টালে গিয়ে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা শুরু করবে, ততই এই আইনের বাস্তবায়ন সহজ হবে। 

১৯৫৫ সালের যে নাগরিকত্ব আইন ইতিমধ্যেই ছিল, তাকে অনেকখানি সংশোধন করা হয়েছে নতুন এই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানেরথেকে যে সমস্ত অমুসলিমরা অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের নির্দিষ্ট নথি ও শর্ত মিলিয়ে নাগরিকত্বের শংসাপত্র দেবে ভারত। অর্থাৎ সকলেই আছেন, বাদ শুধু মুসলিমরাই। অথচ যে দেশগুলির নাম করা হয়েছে আইনে, তারা সকলেই মুসলিম রাষ্ট্র। দেশ জুড়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ( সিএএ)- র বিজ্ঞপ্তি জারির পাশাপাশি এই সংক্রান্ত ওয়েবসাইটও চালু করেছে সরকার। সরকার বলেছে, প্রয়োজনীয় নথিপত্র লাগবে সেই সব উদ্বাস্তুদের নাগরকিত্ব প্রমাণের জন্য। কারাই বা আবেদন করতে পারবেন? ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কী কী নথি প্রয়োজন আবেদনের জন্য দেখে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন: CAA-র জন্য প্রয়োজনীয় নথি না থাকলে কী হবে? যা জানালেন শাহ

সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর আগে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে যেসব সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, শিখ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষজন ভারতে এসেছেন ,শুধুমাত্র তাঁরাই ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন জানাতে পারবেন। খেয়াল রাখতে হবে এখানে মুসলিমদের কথা উল্লেখ নেই।

অর্থাৎ, এই তিন দেশ এবং ছয় ধর্মাবলম্বীদের বাইরের কারওর জন্য এই আইন নয়। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আশ্বাস দিয়েছেন, খুব শিগগিরই তিনি মুসলিমদের জন্যই চিন্তাভাবনা করবেন। তবে আপাতত বাকি অন্য দেশ থেকে আগত বা এই ছ'টি সম্প্রদায়েরর বাইরের মানুষদের নাগরিকত্ব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না সরকার।

মনে রাখতে হবে,এছাড়াও কিন্তু অন্য বহু সম্প্রদায় ও দেশের মানুষ এই ভারতে রয়েছেন, যারা দীর্ঘকাল এ দেশেই বসবাস করছেন। কার্যত এ দেশেরই ভূমিপুত্র বা কন্যা হয়ে উঠেছেন তাঁরা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই আইন অনুযায়ী, সেইসব মানুষগুলোরও আপাতত এই দেশে জায়গা নেই।

এবার আসা যাক আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথির প্রসঙ্গে। ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তিকে সিএএ আইনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হলে এইসব নথিগুলি থাকা আবশ্যক। কী সেগুলি?

  •  বৈধ বিদেশি পাসপোর্ট
  •  পূর্ববর্তী দেশের পরিচয় পত্র
  • পূর্ববর্তী দেশের শিক্ষা -প্রতিষ্ঠানের (বিদ্যালয়,কলেজ, ইউনিভার্সিটি) শংসাপত্র
  • পূর্ববর্তী দেশের জন্মের শংসাপত্র
  •  বর্তমান বাসস্থানের আইনি কাগজ
  • বাবা - মায়ের জন্ম শংসাপত্র বা বাবা মায়ের ভারতের পাসপোর্ট
  • এফআরআরও পারমিট রেশন কার্ড
  •  স্বামী বা স্ত্রী-র ভারতীয় পাসপোর্ট বা জন্ম শংসাপত্র
  •  বিয়ের শংসাপত্র
  • ভিনদেশ থেকে এলে বিদেশি নাগরিক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে
  •  ভারতীয় একটি ভাষায় জ্ঞান সম্পর্কিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শংসাপত্র
  •  ভারতীয় দু ' জনের মতের ভিত্তিতে আবেদনকারীর চরিত্র শংসাপত্র

তবে এইসব নথি পেশ করতে পারলেই যে নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে হাতে হাতে, এমনটা কিন্তু নয়। তথ্য এবং নথি জমা হওয়ার পর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যাচাই করবে। এরপর আবেদনকারীকে কেন্দ্রীয় সরকারি কমিটির কাছে ইন্টারভিউ দিতে হবে। প্রতিটি রাজ্যের একজন এবং কেন্দ্রের পাঁচ প্রতিনিধিকে নিয়ে গঠন করা হবে সেই কমিটি। সেই কমিটির যদি আবেদনকারী ব্যক্তি যোগ্য, তবেই তিনি নাগরিকত্ব পাবেন। আর এই 'যোগ্য নাগরিক' হওয়ার চক্করে নথি থাকা ব্যাক্তিদেরও যে নাগরিকত্ব হাতছাড়া হবে না তা কিন্তু গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

ইতিমধ্যেই এই সিএএ নিয়ে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। অনেকেরই বক্তব্য, হিন্দুত্ববাদী সরকার এই আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের চিহ্নিত করে তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করার চেষ্টায় রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন, ভূমিপুত্র মুসলমানদের সঙ্গেও কি একই কাজ করতে চাইছে বিজেপি? অন্যদিকে আবার হিন্দুদের একটি অংশ  বলছে, অমুসলিম যে সকল ধর্মাবলম্বীদের নাম আইনে রয়েছে, তাঁরা পারবে তো সরকার নির্ধারিত সব তথ্য-প্রমাণ দিতে?  নথিপ্রমাণের অভাবে তাঁদের নাগরিকত্বও হাতছাড়া হয়ে যাবে না তো?  সিএএ আইনে মুসলিমদের বাদ রাখার বিষয়ে হিন্দুত্ববাদী সরকারপক্ষ প্রকাশ্যে যুক্তি দিয়েছে- মুসলিমরাই একসময় উল্লেখিত তিন দেশের হিন্দুদের উপরে নিপীড়ন চালিয়েছিল। এই আইন এনে আসলে হিন্দুদেরই 'প্রাধান্য' দেওয়া হচ্ছে, এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছে বিজেপি সরকার। কিন্তু কাগজ না থাকলে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আসা অভিবাসী হিন্দুদের জন্যও কোনো বিকল্প পথ খোলা রাখেনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি। অর্থাৎ যদি তাঁরা কাগজ দেখাতে না পারে, সিএএ আইন আদতে কোনও কাজেই আসবে না। বিশেষজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, সাম্প্রদায়িকতার ধুয়ো তুলে আদতে হিন্দুদেরও একই দড়িতে ফাঁস দিতে চাইছে না তো হিন্দুত্ববাদী সরকার? 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং লিখেছেন, জনগণের সামনে ধর্মীয় উৎপীড়নের কথা বলা হলেও আইনের মধ্যে কোথাও ধর্মীয় প্রতারণার কথা কিন্তু উল্লেখই নেই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, এই আইনের দৌলতে লক্ষ-কোটি মানুষ নাগরিকত্ব পাবেন। সম্প্রতি তিনি ভরসা দিয়ে জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই অভিবাসী মুসলিমদের জন্যও চিন্তাভাবনা করবে সরকার। যদিও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তথ্য বলছে, ওই ছ'টি ধর্মের ৩১,৩১৩ জন মানুষই মাত্র উপকৃত হবেন এই আইনে। তবে তখনই তা হবে, যখন তাঁদের কাছে থাকবে যথাযথ কাগজপত্র।

আরও পড়ুন:রমজান শুরুর দিনটিই কেন সিএএ ঘোষণার জন্য বেছে নিলেন মোদি?

ভিটেমাটি হারিয়ে যারা অন্য একটি দেশে এসে কোনওমতে আশ্রয় খোঁজেন, কোনও মতে চারটে বাঁশ আর মাথার উপর একটা প্লাস্টিক দিয়েই বেঁধে নেন অস্থায়ী ঘর। তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানাবিধ দুর্ঘটনা তো লেগেই রয়েছে। কতসময় বন্যায় ভেসে যায় ঘরদোরকুটো, আগুনে ছাই হয়ে যায় আজীবনের সম্বল। তাঁদের পক্ষে কি ভবিষ্যতের এই সিএএ আইনের কথা ভেবে সমস্ত নথি গুছিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে আদৌ। সময়মতো কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে তাঁরা হাজির করতে পারবে তো সেই সব নিখুঁত তথ্যনথি-প্রমাণ। 'সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট' এবং 'ডাউন টু আর্থ'- র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন ভারতবর্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। শৈত্যপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত, ভারী বৃষ্টি, বন্যা, ভূমিধস কী নেই সেই দুর্যোগের তালিকায়। অন্তত ৮০,৫৬৩টি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে এই সবের দাপটে। প্রাণ গিয়েছে অন্তত ২,৯২৩ জনের। এমন এক দেশে ভিটেমাটি সহায়সম্বলহীন উদ্বাস্তু মানুষগুলোর কাছে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে কাগজ চাওয়া কি আদৌ মানবিক কাজ, প্রশ্ন জাগে বৈকি!

More Articles