রাহুলের তীর জ্ঞানেশের দিকে, কেন বিদ্ধ হলেন অনুরাগ ঠাকুর?

Anurag Thakur accuses Rahul Gandhi: তীর যখন নির্বাচন কমিশনের দিকে, তখন খামোখা সেই তীরকে নিজেদের দিকে কেন টেনে নিয়ে গেল বিজেপি?‌‌ কেন বিজেপির অন্দরে অতিতৎপর হয়ে উঠল? ঠাকুরঘরে কে বলার আগেই আমি কলা খাইনি আর্তি কেন ধ্বনিত হল...

RD

ভারতের গণতন্ত্রের মূল ভরকেন্দ্র নির্বাচন। সেই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু সাম্প্রতিক অভিযোগে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে এই সংস্থার নিরপেক্ষতা। রাহুল গান্ধীর এক ‘‌প্রি হাইড্রোজেন বোমা’‌ বিস্ফোরণে ভারত জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিস্ফোরণের লক্ষ্য সরাসরি জাতীয় নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। এক কথায় রাহুলের অভিযোগ, জ্ঞানেশ কুমার ‘‌ভোট চোর’‌দের জেনেবুঝে আড়াল করছেন।  যদিও এই অভিযোগ নতুন নয়। রাহুল বেশ কিছুদিন ধরেই সরব। শুধু এবার তিনি নির্বাচন কমিশনারকে নিজের ‘‌ভুল’‌ শুধরে নেওয়ার জন্য রীতিমতো ৭ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন । ‌এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। তারপর যা ঘটল তা নিয়ে নানা মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম নিচ্ছে। এই যেমন, রাহুল সকাল ১১টায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জ্ঞানেশ কুমারের মুণ্ডপাত করার ঠিক পরেই বেলা ১টায় সাংবাদিক সম্মেলন ডাকল বিজেপি। দলের সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর রাহুলের অভিযোগগুলি একে একে খণ্ডন করার চেষ্টা করলেন। এখানেই প্রশ্ন, তীর যখন নির্বাচন কমিশনের দিকে, তখন খামোখা সেই তীরকে নিজেদের দিকে কেন টেনে নিয়ে গেল বিজেপি?‌‌ কেন বিজেপির অন্দরে অতিতৎপর হয়ে উঠল? ঠাকুরঘরে কে বলার আগেই আমি কলা খাইনি আর্তি কেন ধ্বনিত হলো?‌‌

আসলে এই দ্বন্দ্ব আস্থা এবং প্রশ্নের। সকলেই মানবেন, ভারতের গণতন্ত্রের প্রাণভ্রমরা নির্বাচন। সেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা রক্ষার দায় সাংবিধানিক সংস্থা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু, লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর অভিযোগে সেই নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। রাহুল অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন জ্ঞানেশ কুমারকে। অভিযোগ, ভিন রাজ্যে বসে কেন্দ্রীয় ভাবে সংগঠিতভাবে কংগ্রেসপন্থী, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। কর্ণাটকের আলন্দ কেন্দ্রে ছ’হাজারেরও বেশি নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জমা পড়েছিল বলে অভিযোগ।

আরও পড়ুন- রাহুলের অভিযোগে কমিশনের অস্বীকার! জনগণ কাকে বিশ্বাস করবে?

রাহুল গান্ধীর মতে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া আসলে নিতান্তই এক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। নির্দিষ্ট সফটওয়্যার, কল সেন্টার এবং আইপি অ্যাড্রেস ব্যবহার করে নকল আবেদন জমা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর হাতে ফোন নম্বর ও প্রমাণ আছে বলেও দাবি। অন্যদিকে বিজেপি’‌র বক্তব্য, সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন। কংগ্রেসের তৈরি রাজনৈতিক নাটক। নির্বাচনে পরাজয়ের অজুহাত আগেভাগেই দাঁড় করানো ছাড়া কিছুই নয়। নানা মহলের প্রশ্ন, অভিযোগ কেবল নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। তাহলে বিজেপি তড়িঘড়ি পাল্টা সাংবাদিক বৈঠক করল? কমিশন সাংবিধানিক সংস্থা, তারাই তো সাফাই দেবে। শাসক দলের এই তড়িঘড়ি প্রতিক্রিয়া অনেককেই ভাবাচ্ছে। বিরোধী শিবির বলছে, এই তৎপরতা আসলে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রমাণ।

আবার নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, ভোটার তালিকায় নাম সংযোজন ও বিয়োজনের প্রক্রিয়ায় কোনও রকম অস্বচ্ছতা নেই। এমনকী, প্রত্যেক ভোটারকে শেষ পর্যন্ত শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়। কর্ণাটকের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক জানিয়েছেন, অধিকাংশ আবেদনই খারিজ হয়েছে। মাত্র কয়েকটি বৈধ প্রমাণিত হয়েছে। একটি এফআইআরও দায়ের হয়েছে। ঠিক এখানেই সমগ্র বিরোধী শিবিরের প্রশ্ন, অভিযোগ এবং ‌এফআইআর-‌এর তদন্তে অসহযোগিতা করছেন খোদ নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। এই ঘটনাই প্রমাণ করছে ভোটার তালিকা নিয়ে ছলচাতুরি চলছে।

এখানে এমন প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক, নির্বাচন কমিশনের কাছে সরাসরি প্রমাণ না দিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে অভিযোগ করলেন কেন রাহুল গান্ধী? আসলে রাহুল গান্ধীও জানেন, সরাসরি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে লড়াইয়ে নামলে তা আইনগত প্রক্রিয়ায় আটকে পড়বে। জনতার সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার কাজ স্থগিত থাকবে। বরং জনসমক্ষে রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত করা গেলে চাপ অনেক বাড়বে। সেই জন্যইএমন কৌশল। ‘‌হাইড্রোজেন বোমা’‌ ফাটিয়ে ধাপে ধাপে ‘‌ভোট চুরি’‌র তথ্যপ্রমাণ জনসমক্ষে এনে শাসক দলকে চাপে রাখা ও কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় তৈরি করাই কংগ্রেসের লক্ষ্য। 

আরও পড়ুন- কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ভোট জালিয়াতির অভিযোগ ভিত্তিহীন: নির্বাচন কমিশন

কমিশনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিরোধী নেতার অভিযোগ যখন এত মারাত্মক, তখন কমিশনের উচিত স্বচ্ছতার সঙ্গে সব তথ্য প্রকাশ করা। কোন কোন আবেদন এসেছে, কীভাবে খারিজ করা হয়েছে, কার বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে, এইসব তথ্য জনগণের সামনে আনা গেলে বিতর্ক অনেকটাই থামানো যেত। কিন্তু কমিশনের বক্তব্য তুলনামূলকভাবে সীমিত ও প্রতিরক্ষামূলক। ফলে মানুষের মনে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। এখন জনগণকে আশ্বস্ত করাই কমিশনের মুখ্য কর্তব্য। কোন কোন আবেদন খারিজ হয়েছে, কোনটি বৈধ হয়েছে, কোথায় এফআইআর হয়েছে, রাহুলের অভিযোগ খণ্ডন করতে এই সমস্ত তথ্য প্রকাশ্যে আনাই কাম্য। অন্তত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন প্রত্যাশা মোটেই অমূলক নয় বৈকি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সম্মান জানিয়ে কংগ্রেস-‌শাসিত কর্ণাটক রাজ্যের সিআইডি বা তদন্ত সংস্থাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা উচিত। অর্থাৎ যেখানেই সংশয়, সেখানেই তা নিরসনের প্রয়াস থাকতে হবে। তা না হলে ক্রমশ এই সংশয়ই গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে।

খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, গণতন্ত্রে সবচেয়ে বড় সংকট আস্থার সংকট। যদি ভোটার তালিকা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহে থাকে, তবে নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও সংশয় বাড়বে। বিরোধী শিবির হোক বা শাসক দল, দুপক্ষের দায়িত্বই হল এই বিশ্বাস রক্ষা করা। নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিই নিরপেক্ষ হয়, তবে তার প্রমাণ তাকে জনগণের কাছেই দিতে হবে। অন্যথায় “ভোট চুরি” বিতর্ক শুধু বিহার বা কর্নাটকেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সমগ্র ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াবে। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

More Articles