কেন ৯ মাসেই পদত্যাগ করতে চাইছেন মুহাম্মদ ইউনূস?

Muhammad Yunus: শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইস...

T

২০২৪ সালে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্ষমতা পায় আওয়ামী লীগ সরকার। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই সেই সরকারের পতনও হয়। তারপর থেকে ক্ষমতায় রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগে দ্য প্রিন্টকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেছিলেন, দেশজুড়ে মানুষ উদযাপন করছেন। তাঁরা যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছে। তিনি বলেছিলেন, "আমরা এখন নতুন করে শুরু করতে চাই এবং আমাদের জন্য একটি সুন্দর দেশ গড়ে তুলতে চাই। এই প্রতিশ্রুতিই আমি দিতে চাই। আমাদের ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবেন শিক্ষার্থী ও তরুণেরা।" তবে তখনই ইউনূস জানিয়েছিলেন, সক্রিয় রাজনীতিতে তিনি যুক্ত হবেন না। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হন। প্রায় বছর গড়াতে চলল সেই সবের। শোনা যাচ্ছে, পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন মুহাম্মদ ইউনূস। কেন সরে যেতে চাইছেন তিনি?

হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন আনবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে দেশবাসীর উদ্দেশে এক ভাষণে ইউনূস বলেছিলেন, শুধু জুলাই-অগাস্টের হত্যাকাণ্ডেরই নয়, গত দেড় দশক যে অপকর্ম করেছে হাসিনা সরকার সেই সব কিছুর বিচার হবে। হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বহুবার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি তুলেছে। চাপের মুখে পড়েই সরকারকে আশ্বাস দিতে হয়েছে বলেও আলোচনা হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

আরও পড়ুন-ফের টালমাটাল বাংলাদেশ! কেন তিন উপদেষ্টার অপসারণ চায় বিএনপি?

ক্ষমতা পাওয়ার ১ মাসের মধ্যেই সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার-বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার সব মিলিয়ে ৬টি আলাদা কমিশন গঠন করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি সংস্কার কমিশন (স্বাস্থ্যবিষয়ক, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকারিক, নারী বিষয়ক) যুক্ত করা হয়েছিল। এই ১০টি কমিশনের কোথায় কী সংস্কার হওয়া প্রয়োজন সেই নিয়ে কাজও শুরু হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সংস্কার কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়েছিল সরকার কর্তৃপক্ষ। তবে কবে এই সংস্কার কাজ শেষ হবে তা এখনও জানানো হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সংস্কারের কাজ নিয়ে সুনাম করলেও, তাঁরা বলছেন আরও দ্রুত এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এবং ভারত দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধুত্বের সম্পর্কের কথা দাবি করে এসেছে। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে অন্তর্বর্তী সরকারের। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, "আমরা আশা করছি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।" পিটিআইয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফোনালাপে ইউনূস বলেছিলেন, হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তাঁর কথায়, "বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর হামলা সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।"

৯ মাস পর এখন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বিবিসি-কে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নাহিদ বিবিসি-কে বলেছেন, "ওঁর মনে হয়েছে পরিস্থিতি এরকম যে তিনি কাজ করতে পারবেন না।" নাহিদ বলেন, "স্যার বলেছেন আমি যদি কাজ করতে না পারি... যে জায়গা থেকে তোমরা আমাকে এনেছিলে একটা গণঅভ্যুত্থানের পর, দেশের পরিবর্তন, সংস্কার... কিন্তু যে পরিস্থিতি, যেভাবে আন্দোলন হচ্ছে বা যেভাবে আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে। আমি তো এভাবে কাজ করতে পারব না, যদি না রাজনৈতিক দলগুলো তোমরা সবাই একটা জায়গায়, সাধারণ জায়গায় পৌঁছতে পার।" নাহিদ ইসলাম বিবিসি-কে জানিয়েছেন, তিনি ইউনূসকে পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সরকারের দু'জন উপদেষ্টা (মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদ) এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার (মাহফুজ আলম) পদত্যাগ বা অব্যহতি চেয়েছে বিএনপি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইসরাফ হোসেনের শপথের অনুষ্ঠান থেকে এই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে, ২২ মে, সাংবাদিক বৈঠকে খালেদার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ বলেন, উপদেষ্টারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে টালবাহানা করছেন। তাঁর কথায়, "ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখার কথা ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে কোনও কোনও মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।" তিনি আরও বলেন, "যেহেতু একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ, তাই মাথাভারী উপদেষ্টা পরিষদ না রেখে শুধু রুটিন ওয়ার্ক পরিচালনার জন্য একটি ছোট আকারের উপদেষ্টা পরিষদ রাখাই বাঞ্ছনীয়।"

আরও পড়ুন-রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে ধুঁকছে ইউনূস সরকার : আলতাফ পারভেজ

ফার্স্ট পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ইউনূস ৯ মাসে ৯টি সফর করেছেন— যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, আজারবাইজান, সুইজারল্যান্ড, আরব, চিন, থাইল্যান্ড, কাতার, ভ্যাটিকান সিটি। সম্প্রতি চিন সফরে গিয়েছিলেন ইউনূস। সে সময়ই দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সমর্থনও জানিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা এই সফরকে সফল বলে মনে করেছেন। এই সফরে বাংলাদেশে চিনের বিনিয়োগ, নদীর ব্যবস্থাপনা এবং রোহিঙ্গা সংকটের মতো বিষয়গুলিও আলোচনায় এসেছিল। অন্যদিকে, ফ্রান্স ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানিয়েও অপমান করেছে বলে দাবি করেছেন ইউনূস। উল্লেখ্য, বিগত কয়েক বছর তিনি এই দেশেই অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তৃতীয় ওশেন কনফারেন্সে যোগদানের জন্য মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যঁক্রো। এই সফরকালে ম্যঁক্রোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসতে চেয়েছিলেন ইউনূস। এতে প্যারিসের তরফে কোনরকম সাড়া পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতিতে সফরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইউনূস।

প্রসঙ্গত, বিবিস-র এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কার ও নির্বাচন, ছাত্র নেতৃত্বের নতুন দল গঠন সহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ নিয়ে কথা বলেছিলেন। এতদিন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে নানারকম বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।  অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের পূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেছিলেন, "কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এটা আমার সিদ্ধান্ত নয়।" সংবাদ সংস্থা এএফপিকে একটি সাক্ষাৎকারে নির্বাচন বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেছিলেন, "এটি একটি প্রতিশ্রুতি, যা আমরা দিয়েছি। আমরা প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন হবে।" এই সংস্কারপর্ব কতদিনে শেষ হবে সে নিয়ে কোনও স্পষ্ট বার্তা এখনও দেয়নি সরকার পক্ষ। তবে সংস্কার প্রক্রিয়াতে দেশবাসীর অংশগ্রহণ থাকাটা জরুরি, তাই দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হওয়া  দরকার। কবে দেশটির নির্বাচন-সহ বাকি প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে, সেই উত্তর এখনও অধরা।

More Articles