এক হ্যায় তো সেফ হ্যায় মন্ত্রেই ম্যাজিক? কীভাবে মহারাষ্ট্র দখল করল বিজেপি?
Maharashtra Election Result 2024: লোকসভা নির্বাচনের পরেই 'লাডলি বহিন যোজনা' চালু করার পরে রাজ্যের আড়াই কোটি মহিলার অ্যাকাউন্টে চার মাসের টাকা একসঙ্গে পাঠানো হয়।
মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে বিজেপি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল বছর খানেক আগেই। বালাসাহেবের দল যে ভেঙে টুকরো হয়ে যেতে পারে, বালাসাহেবের বংশই যে ক্রমে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারে তা ক্রমেই বাস্তব হয়ে গেল। তবু, কিঞ্চিৎ আশা ছিল গত লোকসভা ভোটেও। মে মাসে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী জোট মহা বিকাশ আঘাড়ি মহারাষ্ট্রের মোট ৪৮টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসন জিতেছিল। মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই ছবিটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, এই জয় উন্নয়নের জয়, সুশাসনের জয়। সত্যিই কি উন্নয়ন আর সুশাসনের বলে মহারাষ্ট্র দখল করল বিজেপি?
লোকসভা ভোটের ফলাফলের পরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছিলেন, জিততে মরিয়া বিজেপি এত সহজে হাল ছাড়বে না। লোকসভায় হার ছিল কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। আবার একাংশের বিশ্লেষকরা বলছিলেন, বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তার নেতৃত্বাধীন ‘মহায়ুতি’ জোট বড়সড় ধাক্কা খাবে আবার। কিন্তু মহারাষ্ট্র নির্বচনের ফল দেখিয়ে দিল, বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট কেবল বিপুল সংখ্যক আসনে জেতেনি, বিজেপি একাই রাজ্যের বৃহত্তম দল হিসাবে উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন- মহারাষ্ট্র নির্বাচন ২০২৪: কেন মোদি বা রাহুলের হাতেই নেই এই নির্বাচনের ফলাফল?
লোকসভায় ভরাডুবির পর কী এমন ম্যাজিক বিজেপি ঘটাতে পারল যাতে বিধানসভা মাত্র পাঁচ মাসে চলে এল দখলে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লোকসভায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন ‘মহায়ুতি’ জোট যে ভুল করেছিল, তা এবারে আর করেনি। ‘মহায়ুতি’ জোট অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি অর্থাৎ ওবিসি ভোটারদের নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করেছিল। উত্তর মহারাষ্ট্রে, যেখানে সবথেকে বেশি পেঁয়াজ চাষ হয়, সেখানে কৃষকরা পেঁয়াজ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সরকার তাদের জন্য স্পষ্ট নীতি ঘোষণা করেছে। ফলে আস্থা ফিরেছে মানুষের।
এবারের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়েছেন অজিত পাওয়ার। গত কয়েক বছরে কেবল তো শিবসেনায় শিবির ভাগ হয়নি। ভেঙেছে শরদ পাওয়ারের এনসিপিও। বর্ষীয়ান নেতা শরদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার বিজেপির হাত ধরেছেন, আলাদা এনসিপি শিবির গড়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের ভোটে বিজেপি ভোটার এবং দলীয় কর্মীদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিল যে জোটসঙ্গী অজিত পাওয়ারের এনসিপি দলকে কেন ভোট দেওয়া দরকার। লোকসভায় হারের পর থেকে অজিতের এনসিপি শিবিরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভোট চেয়েছে বিজেপি। লাভের গুড় ঘরেও তুলেছে।
আরও পড়ুন- কোন মন্ত্রে ওয়ানাড়ে রাহুল গান্ধির চেয়েও বেশি ভোটে জয় প্রিয়াঙ্কা গান্ধির?
তবে এর চেয়েও বড় কিস্তিমাৎ হয়েছে একটি প্রকল্পে। মহারাষ্ট্রে 'লাডলি বহিন যোজনা' প্রকল্পটিই হয়েছে ‘গেম চেঞ্জার’। লাডলি বহিন প্রকল্পে প্রতি মাসে মহিলারা ১৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন। যেসব পরিবারের বার্ষিক আয় আড়াই লক্ষ টাকার কম, সেসব পরিবারের ২১ থেকে ৬০ বছর বয়সি মহিলারা এই প্রকল্পের সুবিধা পান। খানিকটা এই বাংলার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের মতোই। এই রাজ্যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যেমন তৃণমূলকে ক্ষমতায় থাকতে বিপুল ভোট জোগায়, মহারাষ্ট্রেও এবার একই ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, লোকসভা নির্বাচনের পরেই 'লাডলি বহিন যোজনা' চালু করার পরে রাজ্যের আড়াই কোটি মহিলার অ্যাকাউন্টে চার মাসের টাকা একসঙ্গে পাঠানো হয়। এত বড় সংখ্যক টাকা পিছিয়ে পড়া, অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন থাকা মহিলাদের ভোট বিজেপিতে নিশ্চিত করেছে।
এর পাশাপাশি আছে হিন্দুত্বের নীতি। বিজেপি এবার স্লোগান তুলেছিল 'বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’। এমন উস্কানিতে হিন্দুভোটও বিজেপির শিবিরেই গেছে। বৌদ্ধ ও দলিত ভোট আর মুসলিম ভোট বিরোধীরা পেলেও তাতে লাভ হয়নি। মোদি বারবার বলেছেন 'এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়'। এই দু'টি স্লোগানে হিন্দু ভোট একজোট হয়েছে সফলভাবেই। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বিজেপির মূল অস্ত্র কিন্তু কংগ্রেস পাল্টা কোনও রাজনীতির ধারা তৈরি করতে পারেনি। যার ফলে এই জয় ছিল অবশ্যম্ভাবী।
মহারাষ্ট্র নির্বাচনে বিরোধী ‘মহা বিকাশ আঘাড়ি’ জোটে ১০১টি আসনে লড়েছিল কংগ্রেস। তবে লোকসভা ভোটের ম্যাজিকটি আর কাজ করেনি। মহায়ুতি সরকারের ১৫০০ টাকার লাডলি বহিন প্রকল্পের ব্যাপক সমালোচনা করেছিল মহা বিকাশ আঘাড়ি জোট। তারপর আবার নিজেরাই নিজেদের নির্বাচনি ইস্তেহারে মেয়েদের ৩ হাজার টাকা দেওয়ার প্রকল্পের কথা বলে। এই বিষয়টি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। কংগ্রেস-শিবসেনায় মতানৈক্য এই হারের পিছনে বড় কারণ। রাহুল গান্ধি বুঝতে পারেননি, মহারাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে আদানি, ধারাভি বস্তি এবং মুদ্রাস্ফীতির মতো ইস্যু দিয়ে আর ভোটে জেতা যায় না।