এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই কেন পদত্যাগের ঘোষণা জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার
Shigeru Ishiba: ঈশিবার পদত্যাগ শুধু তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জাপানি রাজনীতিতে এক গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই পদত্যাগের ঘোষণা করলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা। সাত দশকেরও বেশি সময় জাপানে ক্ষমতায় থেকেছে এলডিপি। কিন্তু জুলাই মাসের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ভরাডুবি, দলের অন্দরেও ইশিবার নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। আম জনতাও যে তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়েছে, তার প্রমাণ মেলে ভোটবাক্সে। ঈশিবার পদত্যাগ শুধু তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জাপানি রাজনীতিতে এক গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি জাপান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে চলেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ইশিবা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনবেন। কিন্তু ইশিবা সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারা। মূল্যবৃদ্ধি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে থাকে। যদিও তাঁর সরকার মজুরি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বাস্তবে তার প্রভাব খুব কমই দেখা যায়। ব্যবসায়ী মহল থেকেও ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন- এত বিনিয়োগ! কদর্য পথেই পৃথিবীর জলবায়ু বদলাচ্ছে জাপান?
জুলাইয়ের নির্বাচনে এলডিপি ইতিহাসের অন্যতম বড় পরাজয়ের মুখে পড়ে। সংসদের উভয় কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে দলটি কার্যত অস্বস্তির মুখে পড়ে। জাপানি রাজনীতিতে এটি ছিল বিরল ঘটনা, কারণ দেশটির শাসনভার বহু দশক ধরে এলডিপির হাতেই ছিল। ভোটারদের ক্ষোভের কেন্দ্রে ছিল মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং কম মজুরি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল।
অন্যদিকে পরাজয়ের পর থেকেই এলডিপির ভেতরে ইশিবাকে নিয়ে আস্থাহীনতা বাড়তে থাকে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তারো আসো ও কৃষিমন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি প্রকাশ্যে ইশিবাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। আসন্ন নেতৃত্ব নির্বাচন কার্যত অনাস্থা ভোটে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ইশিবা নিজেও উপলব্ধি করেন, যদি তিনি নিজের সিদ্ধান্তে সরে না দাঁড়ান, তবে দল ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। ফলে দলের ঐক্য রক্ষার স্বার্থে পদত্যাগই ছিল তাঁর কাছে একমাত্র বিকল্প।
তবে শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক বড় কার্যসিদ্ধি করেছেন ইশিবা। পদত্যাগ ঘোষণার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করেন তিনি। এই চুক্তির ফলে জাপানি গাড়ি রপ্তানির ওপর শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশে যুক্তরাষ্ট্র ২৫% অতিরিক্ত ট্যারিফের পরিবর্তে কমিয়ে ১৫% করেছে। বিশ্বের কোনো দেশই এই পর্যায়ে ছাড় পায়নি। সংবাদ সম্মেলনে ইশিবা এই নিয়ে বলেন, “আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা অতিক্রম করেছি। এখন সময় এসেছে নতুন নেতৃত্বের হাতে দেশের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার।”
আরও পড়ুন- জীবনযাপনে ছোট্ট বদল, আমার আপনার থেকে অনেক বেশিদিন বাঁচেন জাপানিরা
অক্টোবরের শুরুতে এলডিপির নেতৃত্ব নির্বাচন হওয়ার কথা। সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের তালিকায় আছেন প্রাক্তন অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি এবং কৃষিমন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি। উভয়েই দলের অভ্যন্তরে প্রভাবশালী এবং আগামী দিনে জাপানের পথচলা তাঁদের হাতেই নির্ধারিত হবে। তবে যতদিন না নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীনভাবে দায়িত্ব পালন করবেন ইশিবা।
ইশিবার পদত্যাগ জাপানের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সদ্য স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি, চিন ও কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপানের কৌশলগত ভূমিকা— সব কিছুই নতুন নেতৃত্বের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। জনগণ পরিবর্তন চায়, এটা স্পষ্ট। কিন্তু নতুন নেতৃত্ব কি আম জনতার দাবি পূরণ করতে পারবে? নাকি এই সুযোগে জাপানের বিরোধী দল কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (CDP) শক্তি বৃদ্ধি করবে?

Whatsapp
