কেন বারবার ভূমিকম্প? কতটা পিছিয়ে গেল আফগানিস্তান?

Afghanistan earthquake: বিশেষজ্ঞদের মতে-ভারতীয় প্লেটের উত্তরমুখী গতি এবং ইউরেশীয় প্লেটের বিরুদ্ধে এর চাপ আফগানিস্তানের অসংখ্য ভূমিকম্পের জন্ম দেয়।

৩১ অগাস্ট রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের পড়শি দেশ, আফগানিস্তান। পাকিস্তান সীমান্তসংলগ্ন আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কুনার পার্বত্য প্রদেশে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পে এখনও পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে দেড় হাজারের বেশি মানুষ, আহত হাজার তিনেকেরও বেশি। রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পে সাধারণত এত প্রাণহানি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল নানগারহার প্রদেশের জালালাবাদ শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরপূর্বে এবং এর গভীরতা ছিল মাত্র ৮ কিলোমিটার। প্রথমবার আঘাতের  পরে নেমে আসে আরও তিনটি আফটারশক, যেগুলোর তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৪.৫ থেকে ৫.২-এর মধ্যে।

ভূমিকম্প কেন হয়?

গঠনগত দিক দিয়ে আমাদের পৃথিবী তিনটি স্তরে গঠিত– কোর, ম্যান্টল ও ক্রাস্ট। একেবারে কেন্দ্রে ধাতব গলিত পদার্থ নিয়ে গঠিত হয় কোর, যাকে ঘিরে থাকে উত্তপ্ত কঠিন শিলার স্তর বা ম্যান্টল। একেবারে বাইরের স্তরে, পরিবর্তনশীল টেকটোনিক প্লেটে তৈরি অংশটির নাম ভূত্বক। ম্যান্টলের উপরে থাকা এই প্লেটগুলি যে কোনো গতিতে যে কোনো দিকে চলাচল করতে পারে, যার ফলে শক্তি উৎপন্ন হয়। চলমান এই প্লেটগুলি মাঝে মধ্যে একটির উপর থেকে সরে গেলে, বা একটি অন্যটির উপর উঠে গেলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত হয় এবং ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে, যাকে আমরা ভূমিকম্প বলি। একই ঘটনা সাগর বা মহাসাগরের তলদেশে দেখা গেলে সুনামির জন্ম হয়। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, ভূমিকম্পের ফলে পৃথিবীতে চাপের পরিবর্তন হয়, যার জন্য মূল প্রকম্পনের পরেও বেশ কয়েক ঘন্টা মাঝারি থেকে মৃদু কম্পনের সম্ভাবনা থাকে, এটিই ‘আফটার শক’ বা পরাঘাত।

ভূ-অভ্যন্তরের যে বিন্দুতে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়, তাকে বলে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা হাইপোসেন্টার, আর সেই বিন্দু থেকে ভূপৃষ্ঠে লম্ব টানলে যেখানে মিলিত হয়, তাকে বলে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার।

আরও পড়ুন- নিশ্চিহ্ন বাড়িঘর, মৃতের সংখ্যা ৮০০ পার! ভয়াবহ ভূমিকম্প ঠিক কতটা পিছিয়ে দিল আফগানিস্তানকে

যে ভূমিকম্পের কেন্দ্রের গভীরতা যত কম, অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি অংশে উৎপন্ন হলে তার প্রলয়  ক্ষমতা তত বেশি, তুলনামূলক ভূপৃষ্ঠের অনেক নীচে উৎপত্তি হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়। ভূমিকম্পের তরঙ্গগুলি (Seismic Wave) ব্যাসার্ধ বরাবর বিস্তার লাভ করে, ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠের অনেক গভীরে সৃষ্টি হওয়া কম্পন গুলো ভূত্বকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রায় প্রতিবছরই কেন আফগানিস্তানে ভূমিকম্প হয়?

দুর্গম পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত দেশটি বরাবরই ভূমিকম্পপ্রবণ। এর আগেও বারবার ভূমিকম্পের স্বীকার হয়েছে ছোট্ট এই দেশটি। ২০২৩ সালে হেরাট প্রদেশে পরপর তিনটি ভূমিকম্পে প্রায় ১৩০০ লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন। তার আগের বছর, দেশটির দক্ষিণ পূর্বে ৫.৯ তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ মারা যায়। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৫৬০ জন মানুষ ভূমিকম্পে প্রাণ হারান এবং বার্ষিক হারে আনুমানিক ৪ কোটি ডলার ক্ষতির শিকার হয় গরিব এই দেশটি।

ঠিক কী কারণে বছর বছর ভূমিকম্পের কবলে পড়ে আফগানবাসিরা?

ভৌগোলিক দিক থেকে আফগানিস্তান হিন্দুকুশ পর্বতমালা সংলগ্ন অঞ্চলের ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত, ফলে এই দুই প্লেট একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে বা একে অপরকে অতিক্রম করতে পারে। আবার এরা, এদের দক্ষিণে অবস্থিত আরব প্লেট দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সে কারণে অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম টেকটোনিকভাবে সক্রিয় অঞ্চলে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে-ভারতীয় প্লেটের উত্তরমুখী গতি এবং ইউরেশীয় প্লেটের বিরুদ্ধে এর চাপ আফগানিস্তানের অসংখ্য ভূমিকম্পের জন্ম দেয়। উচ্চ পর্বতমালা থেকে গভীর উপত্যকা কি নেই আফগানিস্তানে। এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক এবং ভূসংস্থানিক বৈচিত্র্য, সাথে  ঘন পাললিক শিলার উপস্থিতি দেশটিকে আরও ভূমিকম্প প্রবণ করে তুলেছে।

আরও পড়ুন- সুনামির ‘ T’ কেন উচ্চারিত হয় না?

এছাড়া প্রতি বছর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাওয়ার হারও বাড়ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই শতাব্দীর শেষের দিকে এই অঞ্চলটি তার হিমবাহের ৮০% পর্যন্ত হারাতে পারে। বরফের ভর হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ওজন হ্রাসের প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ারটি উপরের দিকে বা নীচের দিকে সরে যেতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বরফ গলা জলও মাটিতে প্রবেশ করে, যা টেকটোনিক প্লেটগুলির মধ্যে ঘর্ষণ কমায় এবং ভূমিকম্পের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তোলে।

মূলত পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান, অর্থাৎ উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলি ভূমিকম্প প্রবণ। রাজধানী, কাবুল এই অঞ্চলেই পড়ে।

এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে কীভাবে রেহাই পেতে পারে দেশটি?

ভূমিকম্পের কবল থেকে বাঁচা সহজ কথা নয়। তবে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমানো যায়। আফগানিস্তানের বাসিন্দারা ভূমিকম্পের সময় বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় (কাঠ, কাঁচা ইট বা দুর্বল কংক্রিট দিয়ে তৈরি বাড়ি) বাস করেন। এগুলোর কোনো  ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই, তার পরিবর্তে যদি পরিকল্পনা করে এমন পরিকাঠামো তৈরি করা যায় যা মৃদু বা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তাহলে কিছুটা সুরাহা হয়। সেই সঙ্গে, স্বয়ংক্রিয় রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফল্ট লাইনগুলি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা দরকার। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক দেখলেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে থাকা মানুষজনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া দরকার। বারবার ভূমিকম্পের সম্মুখীন হওয়ার পরেও তালিবান সরকার কবে এই সব পরিকল্পনা গ্রহণ করবে তারই প্রহর গুনছেন আফগানরা।

More Articles