আরজি কর বিচার: কেন ৪ তারিখ সারা রাজ্যের মানুষের পথে থাকা দরকার?
RG Kar CBI: প্রমাণ লোপাট হয়ে থাকলে সিবিআই যেন তা লিখিতভাবে আদালতে দেয়, যাতে সিবিআই নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে কিনা জনগণ তা সাফ বুঝতে পারে।
বুধবার ৪ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানির আগের সন্ধ্যায় ও রাতে ছাত্র-চিকিৎসক-নাগরিক সমাজের একাংশ পথেই থাকতে চান। সারা রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে সাধারণ মানুষের। কোথাও মিছিল, কোথাও মানববন্ধন। এই মানুষদের সাধুবাদ জানাতে চাই কারণ, এর থেকে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত আর কিছু হয় না।
আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার মূল ও একমাত্র আসামী হিসাবে সঞ্জয় রায়কে ধরেছিল কলকাতা পুলিশ। তদন্তের ভার হাতে নেওয়ার পর থেকে সিবিআই ধর্ষণ ও হত্যা প্রসঙ্গে এখনও দ্বিতীয় কোনও অভিযুক্তের নাম আনতে পারেননি। তবে সঞ্জয় যে দোষী নন, এমনটাও তাঁরা বলেছেন বলে শুনিনি। এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ে মূল পদক্ষেপ আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর তিন সহযোগীকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই কাজ মূলত আরজি করের প্রাক্তন কর্মকর্তা আখতার আলিই করে দিয়েছেন। আর্থিক দুর্নীতির যে সমস্ত অভিযোগে সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই তথ্য সব আখতার আলিই তুলে ধরেছেন।
সিবিআইকে বাঁচাতে ইতিমধ্যেই ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে বিজেপি-আরএসএস প্রচার শুরু করে দিয়েছে, সিবিআই কীভাবেই বা আর কিছু পাবে? রাজ্য পুলিশ তো আগেই প্রমাণ লোপাট করে দিয়েছে! আমরা জানি, সারদা ও নারদ কেলেঙ্কারির তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা কী ছিল। গত দশ বছরে, গোটা দেশ দেখেছে, সিবিআই, ইডি, আয়কর দফতরের ব্যবহার হয়েছে মূলত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের উদ্দেশ্যে। হয় জেলে ঢোকানো, নয় জেলের ভয় দেখিয়ে বিজেপিতে যোগদান করানো, এই ছিল সিবিআই-ইডির জুজু দেখিয়ে বিজেপির মূল কাজ। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার এই রাজনীতিকরণে সংস্থা তার দক্ষতা হারিয়েছে, ঠিক যেভাবে দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে রাজ্য পুলিশ।
আরও পড়ুন- নির্ঘুম, অক্লান্ত! পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ কেন চাইছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা?
বিজেপি ও সংঘ পরিবারের লোকজন এই আন্দোলনের ঘাড়ে চেপে রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে চায়। এটাই তাদের মূল লক্ষ্য। নারী সুরক্ষার প্রশ্নে তাঁদের কী চিন্তাভাবনা তা তো অনেকেরই জানা। এই লেখার পরিসরে সেই সব আর টানলাম না। শুধু বিজেপির সুশাসনের মূর্ত প্রতীক, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের একটি বহুল প্রচারিত বক্তব্যের উল্লেখ করছি।
“নারীর গুরুত্ব ও সম্মানের কথা বিবেচনা করে...আমাদের ধর্মগ্রন্থ সব সময়ই তাকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলেছে... নারীকে যেহেতু মুক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত রেখে দিলে তার শক্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং ক্ষতি হতে পারে, তাই নারী শক্তির কোনও স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় না, তাদের প্রয়োজন সুরক্ষা,” যোগী বলেছিলেন। অর্থাৎ, স্বাধীনতা নয়, রাস্তায় নিজের পছন্দ মতো সময়ে নিজের পছন্দের সঙ্গীর সঙ্গে নিজের পছন্দের পোশাকে ঘুরে বেরনো নারীর কাজ নয়।
মনুর বক্তব্য তুলে ধরে আদিত্যনাথ বলেন, “শৈশবে নারী শক্তিকে রক্ষা করেন বাবা, যৌবনকালে স্বামী, এবং পুত্র তাকে রক্ষা করে বৃদ্ধাবস্থায়।" “তাই নারীরা স্বাধীনতার যোগ্য নয়... নারীরা পুরুষের মতো কার্যকরী হলে ঘর ধ্বংস হয়ে যায়,” আদিত্যনাথই বলেছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক তৃতীয়াংশ মহিলা সংরক্ষণ প্রসঙ্গে আদিত্যনাথ লিখেছিলেন, পঞ্চায়েতে সংরক্ষণের 'পর্যালোচনা' করা উচিত। “পরিবার এবং শিশুদের লালন-পালনে নারীর প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা মূল্যায়ন করুন। সিদ্ধান্ত নিন যে, যদি নারীদের রাজনীতিতে এবং বাইরের জীবনে পুরুষদের সমান অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের মা, মেয়ে এবং বোন তাদের রূপ এবং তাৎপর্য হারাবেন কিনা।”
এই রকম চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী বিজেপি সত্যিই বাংলার অবস্থার কতটা পরিবর্তন চায়, সেটা আপনারা আন্দাজ করতেই পারেন। তাঁদের চাই ক্ষমতা। অস্ত্র সিবিআই। তাই সিবিআই ব্যর্থ হলে আগাম সাফাই তৈরি রাখছে। মানুষের মনকে তাদের সম্ভাব্য ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত করে রাখছে এই বলে যে, সিবিআই কী করেই বা স্বচ্ছ তদন্ত করতে পারবে? কলকাতা পুলিশ তো আগেই প্রমাণ লোপাট করে দিয়েছে!
এই বক্তব্যের ফাঁদে পা দেবেন না। পুলিশ প্রমাণ লোপাট করে থাকলে সিবিআইকে সেটাও তথ্য প্রমাণ দিয়ে উপস্থিত করতে হবে। এই জন্যই ৪ সেপ্টেম্বর পথে থাকা প্রয়োজন। প্রমাণ লোপাট হয়ে থাকলে সিবিআই যেন তা লিখিতভাবে আদালতে দেয়, যাতে সিবিআই নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে কিনা জনগণ তা সাফ বুঝতে পারে।
মানুষ রাস্তায় ছিলেন বলেই আজ যতদূর এগিয়েছে, সেই অর্জন সম্ভব হয়েছে। শীর্ষ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা নিয়েছে। এখন এই চাপ কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল নয়, গোটা ব্যবস্থার ওপরই রাখতে হবে। আন্দোলন এখন খুন ও ধর্ষণের প্রাথমিক অভিযোগ ছাপিয়ে বৃহত্তর ইস্যুগুলিকে ধরেছে। স্বাস্থ্য ও পুলিশ ব্যবস্থার কাঠামোয় যে ঘুণ, তার দাওয়াই খুঁজছে এই আন্দোলন। একে বিপথে যেতে দেওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন- ডিয়ার পুরুষ, ‘লড়কিও কি না মে হাঁ নেহি হোতি হ্যায়’
এই সূত্রেই আন্দোলনকারীদের কাছে আমার আন্তরিক প্রস্তাব, রাস্তায় থাকাকালীন হরিয়ানায় নৃশংস হত্যার শিকার পশ্চিমবাংলার বাসিন্দা সাবির মালিকের গণপিটুনিতে মৃত্যুর প্রশ্নটিও তুলুন। ন্যায় বিচারের আন্দোলনকে বৃহত্তর সামাজিক রূপ দিন। সমাজে চলতে থাকা নানা বৈষম্যের ঘাড় ধরে নাড়া দিন। এতে মানুষের প্রকৃত অর্জন বাড়বে, সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়বে। মানুষ একইসঙ্গে দুই শাসককে চমকাতে পারলে মূল লাভ জনগণেরই।
তিলোত্তমার মৃত্যু এক পচনশীল ব্যবস্থায় যেভাবে আঘাত হেনেছে, তাকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সার্বিক সম্প্রীতির পরিবেশ ও অন্যান্য অত্যাচারিতদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন। ভুলে গেলে হবে না, এই আখতার আলি যদি দুর্নীতির প্রমাণ না দিয়ে নিজেই অভিযুক্ত হতেন, তাহলে তাঁর নাম বাংলার ঘরে ঘরে সবাই জেনে যেত বিজেপি, আরএসএস তথা সংঘ পরিবারের অন্যান্য সংগঠনের মুসলিম বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডার বদান্যতায়। এই পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনের অন্যতম কার্যকরী স্লোগান হয়ে উঠতে পারে- “সাবিরের বিচার চাইবে কে? আরজিকর, আবার কে!”