ভারত পাকিস্তানের চেয়ে ভাল, কেন মনে করছেন ইমরান খান?

৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল- মাত্র এক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন। আকস্মিকভাবেই, অনাস্থা প্রস্তাব আনার মাত্র এক মাসের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খান। যখন বিরোধীরা প্রথমবারের জন্য ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তখন হয়তো কেউ ভাবতেও পারেননি ইমরানের বিদায় নিশ্চিত। তবে, এরকম পরিস্থিতি যে হঠাৎ করে তৈরি হয়েছে, সেটা কিন্তু বলা ভুল। দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, দুয়ের অনুঘটনেই গদিচ্যুত হয়েছেন ইমরান খান। তবে অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়টি যেন সবথেকে বেশি আলোচিত হয়েছিল ইমরান খানের ক্ষেত্রে। কার্যত, যে রাষ্ট্রনীতিকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন ইমরান খান, সেই ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতিরই মাশুল দিতে হল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে। 

কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেই হঠাৎ করেই ইমরানের মুখে ভারত-বন্দনার সুর। গত মাসের শেষ লগ্নে ভারতের বিদেশনীতির সুখ্যাতি করে নিজের দেশেই খানিকটা টার্গেট হয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের একমাত্র বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন। আর অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ এবং পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সেদেশের সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেওয়ার পরেই গত শুক্রবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে আবারও সেই ভারত-বন্দনা। এই ভাষণে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করেছেন প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু, প্রশ্ন হল, পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিকে দুষছেন? আর কেনই বা হঠাৎ করে তাঁর কাছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি উত্তম? 

আরও পড়ুন: ভারতের সঙ্গে শিকড়ের যোগ, একই অঙ্গে নানা রূপ নয়া পাক প্রধানমন্ত্রীর

ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি এবং ইমরান

এতদিন পর্যন্ত ইমরান খান যে নীতিকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, সেই নীতিকেই এবারে সরাসরি আক্রমণ করছেন ইমরান খান। তার সরকার উৎখাতের জন্য যে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়েছিল, প্রথম থেকেই সেই প্রসঙ্গে পশ্চিমি হস্তক্ষেপের কথা সামনে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। প্রথমে মুখ ফসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম বললেও, পরবর্তীতে নাম না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ শানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি ছিল, তাঁর সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার আগুনে ঘি ঢেলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারাও। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও, ইমরান দাবি রেখেছিলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সমালোচনায় ইমরান খান সরকার সংযমী হওয়ায় এবং হামলার দিন মস্কো সফর এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করায় এই বিষয়টি নিয়ে না-খুশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকেরা তাঁর দাবিকে অতিরঞ্জিত বললেও, অনাস্থা প্রস্তাবের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে সেটা এখনও জোর গলায় জানিয়ে আসছেন ইমরান খান।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও ক্ষমতার সমীকরণ

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির মতোই এই দেশের কৌশলগত সমস্ত বিষয় এই দেশের সামরিক বাহিনীর উপরেই নির্ভর করে। কাকে ক্ষমতায় আনতে হবে, তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে সেই সব কিছুই কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানের এই পরিচিত সামরিক বাহিনীটি। তাই ইমরান খানের মস্কো সফর যে সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে এটা খুব সহজেই বোঝা যায়। ইমরান খান পরে বিষয়টি নিজেই স্পষ্ট করলেও, মস্কোর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক কিছুটা গতি পায় ইমরানের মস্কো সফরের পরে। মূলত, বিগত কয়েক বছরে সোভিয়েত যুগের রাশিয়ার মিত্র দেশ ভারত ক্রমাগত পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকতে শুরু করলে পাকিস্তানকে হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা করে রাশিয়া। এমনকী, পাকিস্তান এবং রাশিয়ার সেনাবাহিনী যৌথ সামরিক মহড়া করে যা একটা সময় কল্পনা পর্যন্ত করা যেত না। ইউক্রেন ইস্যুতে ভারত যে পশ্চিমা বিশ্বকে সমর্থন করতে পারে, সে বিষয়টা আগেই বুঝেছিল রাশিয়া। তাই হয়তো পুতিন ইমরানকে পাশে বসিয়ে ভারতের জন্য বিশেষ বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। 

একদিক থেকে দেখতে গেলে, ভারত কিন্তু রাশিয়ার সামরিক অস্ত্রের অন্যতম বড় আমদানিকারক দেশ। এই অবস্থায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যদি ভারত ভোট দান করত তাহলে ভারতের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়ে যেত। তাই রাশিয়ার বার্তা বুঝতে খুব একটা ভুল করেনি ভারত। পশ্চিমা অবরোধ সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্ট দিয়ে তেল ভারতে নিয়ে এসেছে মোদি সরকার। অন্যদিকে আবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ পর্যন্ত ভারতকে বাহবা দিয়ে গিয়েছেন নয়া দিল্লিতে এসে। এইখানেই চাপে পড়ে যান ইমরান। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করলে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। তাই ইমরানের মাথা থেকে হাত সরিয়ে হঠাৎ করেই ইউ টার্ন নিয়ে খেলা ঘুরিয়ে দেয় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বলেন, 'নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকার পরেও ছোট একটি দেশের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন ক্ষমার যোগ্য নয়।' পাকিস্তান যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে, সেই বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেয় সামরিক বাহিনী। ইমরান বুঝে যান, রীতিমতো ফাঁপরে পড়ে গিয়েছেন তিনি। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আফগানিস্তান ইস্যু নিয়ে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে। তার মধ্যে আবার সামরিক বাহিনী বুঝতে পেরেছে, অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে যদি যুক্তরাষ্ট্র আরও বেঁকে বসে, তাহলে পাকিস্তানের অবস্থা আবার শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যেতে পারে। তাই, সামরিক বাহিনী তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, বাঁচতে গেলে বলি দিতে হবে ইমরান খানকে। 

সৌদি, তুরস্ক, পাকিস্তান

গোড়া থেকেই ইমরান খানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না। পাকিস্তানের ক্ষমতায় ইমরান খান আসার সঙ্গে সঙ্গেই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের টান পড়ে পাকিস্তানের। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর নেতৃত্বে ইয়েমেনের যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করে পাকিস্তান। সালটা ২০১৪। সেই সময় পাকিস্তানের ক্ষমতায় আছেন নওয়াজ শরিফ। তখন থেকেই ধীরে ধীরে এই সম্পর্কের পতনের সূত্রপাত। নওয়াজের নির্বাসনের শেষ দিনগুলো সৌদি আরবের মাটিতেই কেটেছিল। তিনি একটা সময়ে সৌদি আরবের সমর্থক বলেও নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন। এহেন একটি রাষ্ট্রের এভাবে পিছিয়ে যাওয়া কোনওভাবেই হজম হয়নি আরব আমিরশাহীর। তখন থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে আরবের সংঘাত শুরু। এরপর ২০১৭ সালে যখন কাতারকে একঘরে করে ফেলে সৌদি আরবের জোট, সেই সময়েও এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয় পাকিস্তান। ২০১৮ সালে ইমরান খানের কাছে ক্ষমতা খুইয়ে সৌদি আরবের সমর্থনও হারিয়েছিলেন নওয়াজ। বর্তমানে চিকিৎসার নামে লন্ডনে অবস্থান করলেও নওয়াজ শরিফের কারণেই সৌদি আরবের সঙ্গে প্রথম থেকেই পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ থেকেছে।

এই সম্পর্ককে ঠিকঠাক করার চেষ্টা করেছিলেন ইমরান খান। কিন্তু তবুও, সৌদি আরব ও আমিরশাহির সঙ্গে সম্পর্ক আর আগের জায়গায় পৌঁছয়নি। সৌদি আরবের শাসক মহম্মদ বিন সালমানকে ইসলামাবাদে লাল গালিচার সংবর্ধনা দিয়েও এই সম্পর্ককে টেকাতে পারেননি ইমরান খান। তুরস্ক এবং কাতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং কাশ্মীর ইস্যুতে 'অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন'-এর গা-ছাড়া মনোভাব সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও খারাপ করে।

অন্যদিকে, কৌশলগত এবং সামরিক গুরুত্বের দিক থেকে তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। এই মুহূর্তে, পাকিস্তান চিনের ওপর নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমানোর চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প তুরস্ক। এই মুহূর্তে তুরস্ক দেশটিতে সামরিক শিল্পের একটা ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এই কারণে, যদি ভাল মানের অস্ত্র কিনতে হয়, তাহলে পাকিস্তানের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে তুরস্ক। যুদ্ধজাহাজ থেকে শুরু করে ড্রোন- সবকিছুই তুরস্ক থেকেই আমদানি করছে পাকিস্তান। কিন্তু, সৌদি আরব কখনওই তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক খুব একটা ভালভাবে গ্রহণ করেনি। এমনিতেই তুরস্কের কাছে সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে রয়েছে সৌদি আরব। এই কারণে তুরস্কের কাছ থেকে ইসলামাবাদকে সরাতে বিনা সুদে ঋণের অর্থ ফেরত নেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সৌদি। এছাড়াও কাতারকে যখন তারা এক ঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেই সময় তাদের পাশে দাঁড়ায়নি পাকিস্তান। বরং পরবর্তীতে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করে এই দেশটিকে জ্বালানি এবং আর্থিক সহযোগিতার একটি বিকল্প উৎস হিসেবে তৈরি করেছে পাকিস্তান। এই বিষয়টি সৌদি আরবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এই মর্মে একবার ইসলামাবাদকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল সৌদি রাজ। কিন্তু সেই হুঁশিয়ারিতে কোনওরূপ কর্ণপাত করেননি ইমরান খান, যা সৌদি আরবকে পাকিস্তানের প্রতি আরও বীতশ্রদ্ধ করে তোলে।

আরও পড়ুন:বিয়াাল্লিশ পর্যন্ত উদ্দাম জীবন, বিয়েই বদলে দিয়েছিল ইমরানকে

কাশ্মীর সমস্যা

তবে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের সম্পর্ককে আরও তলানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুঘটকের কাজ করেছিল কাশ্মীর সমস্যা। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে আলাদা দু'টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করা হয়। এই নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে পাকিস্তান। সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণের পাশাপাশি ওআইসি-কে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে হস্তক্ষেপ করার আর্জি জানায় দেশটি। কিন্তু, ওআইসি-র সভাপতিত্বের পদে সেই সময় সৌদি আরব। বারংবার আর্জি জানানোর পরেও পাকিস্তানের সেই আর্জি তেমন ভালভাবে গ্রহণ করেনি সৌদি আরব। ফলাফল, ভারতের পদক্ষেপের পরেই এই ইস্যু নিয়ে ওআইসি দেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠকের প্রস্তাব সম্পূর্ণ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। উপরন্তু, এই একই সময়ে ভারতে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে ভারতে হাজির হন সৌদি আরব এবং আমিরশাহির প্রতিনিধিরা। 

স্বভাবতই ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করেন ইমরান খান। কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি আরবের ভূমিকার কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন তিনি, যা সৌদি আরবকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরও কঠিন মনোভাব গ্রহণে বাধ্য করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এর্দোগান পাকিস্তানের হয়ে জাতিসংঘের মতো একটি বড় মঞ্চে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে কথা বললেও, ইমরান খানের সমস্ত উদ্যোগের বিপক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় সৌদি আরব। মুসলিম বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কুয়ালালামপুরে একটি বিশেষ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ইমরান খানের পক্ষ থেকে। সৌদি আরব সেই আলোচনাসভা শুধুমাত্র বয়কট করে না, এটাকে ওআইসি-র বিকল্প সংস্থা হিসেবে দেখতে শুরু করে। সৌদি আরবের চাপে এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও এরপর থেকে প্রকাশ্যেই সৌদি আরবের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেন ইমরান খান। 

ভারতদরদী ইমরান

পাকিস্তানে এমনিতে গণতন্ত্রের সরকার আছে বলে দাবি করা হলেও এই দেশে কিন্তু ভারতের মতো ইভিএম মেশিন চলে না। এই দেশে নির্বাচনে ব্যাপক রিগিং হয়। সর্বোপরি, পাকিস্তান দেশটি সম্পূর্ণরূপে চলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কথায়। তারা যদি কোনও নেতাকে ক্ষমতায় আনতে চায়, তাহলে তারাই আনতে পারবে নতুবা তারাই ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারবে। এরকম একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন ওঠে। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বদলের পর এই প্রশ্ন তুলেছেন খোদ প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। 

জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইমরান খান বলেন, তিনি নাকি অন্য রাজনীতিকদের থেকে ভারত সম্পর্কে অনেক বেশি জানেন। এমনকী, কাশ্মীরে যা ঘটেছে, তার জন্য ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভাল নেই বলে রীতিমতো দুঃখ প্রকাশ করেছেন ইমরান খান। এছাড়াও আরএসএসের মতাদর্শ নিয়েও গুণগান শোনা গিয়েছে ইমরান খানের গলায়। ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশটিকে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের জন্য বলার মতো কোনও পরাশক্তির সাহস নেই। তারা বলছে, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে তেল কিনবে। কারণ এটা তাদের জনগণের জন্য মঙ্গলজনক।

যদিও, এই একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে কিন্তু আগে সমস্যায় পড়েছিলেন ইমরান খান। তিনি নিজেই স্বীকারোক্তি করছেন, তিনি কখনওই কারও বিরুদ্ধে কিংবা কোনও দেশের বিরুদ্ধে যেতে চান না। তিনি পাকিস্তানের ২২ কোটি মানুষের স্বার্থকে প্রথমে রাখেন এবং পরে দেখেন অন্য দেশ কী করছে। 

যদিও ভারত এবং পাকিস্তানের এই তুলনামূলক বক্তব্যের পরেই ইমরান খানের কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতারা। পাকিস্তানের মুসলিম লিগ নওয়াজের ভাইস প্রেসিডেন্ট মারিয়াম নওয়াজ বলছেন, ভারতের প্রতি যখন এত ভালবাসা, তাহলে ইমরান খান ভারতে চলে যাচ্ছেন না কেন? ইমরান খানের বিরুদ্ধে তার সরাসরি বক্তব্য, 'তাঁকে ঘরে পাঠিয়েছে তাঁর নিজের দল, অন্য কেউ নয়। যদি আপনি ভারতকে এতটাই বেশি ভালবাসেন তাহলে সেখানে একা চলে যাচ্ছেন না কেন? পাকিস্তানকে তার মতো থাকতে দিন।' 

সেই প্রসঙ্গে আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। তিনি বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সময়ে সর্বমোট ২৭বার অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যেভাবে সংবিধানকে ব্যবহার করছেন, এর আগে কেউ এরকমভাবে ব্যবহার করেননি। এছাড়াও, বাজপেয়ীর মাত্র এক ভোটে হেরেও ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়াকে অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা বলেও ব্যাখ্যা করেছেন মারিয়াম।

ভারতপ্রীতির কারণ কি?

অনাস্থা প্রস্তাবের পর থেকেই ভারতের প্রতি ইমরান খানের মনোভাব যেন অনেকটা পরিবর্তিত। ভারতকে খুদ্দার কৌম (নিজেকে সম্মান করে যে) বলেও দাগিয়েছেন তিনি। তার কথায়, দু'টি দেশ একই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও, কোনও সুপারপাওয়ার ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে না। অন্যদিকে, অন্যান্য বড় দেশগুলো পাকিস্তানকে শুধুমাত্র টিস্যুপেপারের মতো ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু এহেন মন্তব্যের কারণ কী? পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে আসার পরে এই মুহূর্তে ইমরান খানের হাতে তেমন কোনও অস্ত্র আর বাকি নেই। অন্যদিকে, নতুন পাকিস্তান গড়ার ডাক দিয়ে যেভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান, সেটা একেবারেই করা সম্ভব হয়নি। জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নয়া ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে সমস্যা হয়েছে ইমরান খানের। নিজের ক্ষমতার থেকেও এই নতুন পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োজন ছিল দেশের কাজে। কিন্তু, পাকিস্তানের বাস্তবতা সবসময়েই অন্য কথা বলে। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণেই মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ক্ষমতা হারিয়েছেন ইমরান খান। ঠিক এই কারণেই হয়তো এখন তার কাছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ভাল মনে হচ্ছে। ইমরানের প্রাক্তন স্ত্রী-ও তাঁকে কটাক্ষ করেই বলেছেন, 'ইমরান আর কোনওদিন নির্বাচনে জিততে পারবেন না বলে এখন ভারতের গুণগান করছেন।' এই মুহূর্তে যদি ভারতের উদাহরণ নিয়ে আসেন, তাহলে হয়তো নিজের দেশের কিছু মানুষের মনে পরিবর্তন আনতে পারবেন বলেই ধারণা করেছেন ইমরান। তবে সেটা কি ইমরানের জন্য ভাল হবে? সামরিক বাহিনী তো আর ভারতের গুণগান ভাল চোখে দেখবে না!

 

More Articles