বিশ্বের উচ্চতম চেনাব রেলসেতু উদ্বোধন পহেলগাঁওয়ের ধাক্কা কমাতে পারবে?

Chenab Bridge: গত ১৯ এপ্রিল চেনাব সেতু উদ্বোধন এবং বন্দে ভারত চালুর কথা ছিল মোদির, কিন্তু সেই সফর বাতিল করা হয়। এর ঠিক তিন দিন পরই, বৈসরন উপত্যকায় ঘটে গণহত্যা।

২২ এপ্রিল। কাশ্মীর তথা ভারতের ইতিহাসে এক বিভীষিকার দিন। পহেলগাঁওয়ে নিরীহ পর্যটকদের হত্যা এবং অপারেশন সিঁদুর ও সংঘাত বিরতির পর, কাশ্মীরের এক অন্য চিত্র দেশ তথা বিশ্বের কাছে পৌঁছতে চাইছে কেন্দ্র সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৬ জুন জম্মু ও কাশ্মীরে চেনাব রেল সেতু উদ্বোধন করছেন। পাশাপাশি শ্রীনগর এবং কাটরার মধ্যে যাতায়াতের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা দু'টি বন্দে ভারত ট্রেনেরও উদ্বোধন করছেন। পহেলগাঁও হামলার মাস দেড়েকের মধ্যে এই সেতু উদ্বোধন কেন? বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলওয়ে আর্চ ব্রিজ চেনাব রেল সেতুটি ২৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল লিঙ্ক (USBRL) প্রকল্পের একটি অংশ। এই মুহূর্তে কেন্দ্র মনে করছে, এই সেতু ভারতের জন্য 'গেম-চেঞ্জার' হতে পারে। কেন?

জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলার বাক্কাল এবং কৌরির মধ্যে প্রায় ১,৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত, চেনাব সেতুটি নদীর তলদেশ থেকে ৩৫৯ মিটার উঁচু। এটি প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের চেয়ে ৩৫ মিটার উঁচু এবং কুতুব মিনারের উচ্চতার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। রিয়াসির চেনাব সেতু নিঃসন্দেহে এক স্থাপত্য বিস্ময়।

২০০৩ সালে চেনাব সেতু নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে, এই পাহাড়ি অঞ্চলের দুর্গম ভূখণ্ড, নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ এবং আদালতের মামলার কারণে সেতু নির্মাণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। সবচেয়ে বড় বাধাগুলির মধ্যে একটি ছিল চেনাব নদীর প্রবাহকে বাধা না দিয়ে সেতু নির্মাণ করা। নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারদের পায়ে হেঁটে বা খচ্চরে চড়ে যেতে হয়েছিল। সরু রাস্তার কারণে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ ছিল আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেতু তৈরির অনেক উপাদানই তাই ওই নির্মাণস্থলেই তৈরি করা হয়েছিল। এই বিস্ময়কর সেতুর নকশা এবং নির্মাণ কাজ আফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার, দক্ষিণ কোরিয়ার আল্ট্রা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ভিএসএল ইন্ডিয়ার যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন হয়েছে।

আরও পড়ুন-টলাতে পারে না ৪০ কেজি বিস্ফোরকও! কীভাবে তৈরি হল দেশের প্রথম কেবল স্টেড ব্রিজ?

১২০ বছররে স্থায়িত্ব এই চেনাব সেতুটির। ২৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে উচ্চ গতির বাতাস, চরম তাপমাত্রা, ভূমিকম্প এবং জলস্তর বৃদ্ধি পেলে জলবিদ্যুৎগত প্রভাবও নাকি সহ্য করতে পারবে এই সেতু। এই সেতুটির উপর দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারে, এই সেতু বিস্ফোরণ-প্রতিরোধী কারণ এটি উচ্চ-তীব্রতার ৪০ কেজি টিএনটি বিস্ফোরণও সহ্য করতে পারে এবং রেলের কোনও একটি স্তম্ভের ক্ষতি হলেও, ট্রেন কম গতিতেও চলতে পারে।

তা এহেন চেনাব সেতু অপারেশন সিঁদুর পরবর্তী ভারতের কাছে কেন এক বড় বিষয়?

চেনাব রেল সেতু ভারতের কাছে কৌশলগত সহায়তার এক মাধ্যম। এর আগে, কাশ্মীর উপত্যকাকে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করার একমাত্র স্থলপথ ছিল ৩০০ কিলোমিটার শ্রীনগর-জম্মু জাতীয় মহাসড়ক। তবে, শীতকালে যখন প্রায়শই এই রাস্তা বন্ধ করে দিতে হতো। ভূমিধসের কারণে জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় মহাসড়ক দুর্গম হয়ে পড়ে। এই রেল সেতুটি সারা বছর ধরে সীমান্তবর্তী এলাকায় সামরিক কর্মী এবং সরঞ্জাম পরিবহণের সুযোগ করে দেবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রেল সংযোগ বাণিজ্যকে সহজতর করে কাশ্মীরের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। এটি ভারতের অন্যান্য অংশে আপেল, শুকনো ফল, হস্তশিল্প ইত্যাদি পণ্যের পরিবহণকেও ঝামেলা থেকে মুক্ত করবে।

 

পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে চেনাব রেল সেতুর উদ্বোধনটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, স্ত্রস্ত কাশ্মীরকে ওই নৃশংস ঘটনার ছায়া থেকে মুক্ত করতে এবং কাশ্মীর যে আসলে উন্নয়নের পথেই আছে, তা বিশ্বকে জানান দিতে চেনাব সেতুর প্রয়োজন ছিল। ২২ এপ্রিলের গণহত্যার কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পর্যটনকে চাঙ্গা করাই এখন এই অঞ্চলে স্বাভাবিক ছন্দ ফেরানোর উপায়। জম্মু ও শ্রীনগরের মধ্যে সরাসরি ট্রেন চলাচল হয়, তাহলে পর্যটনও সস্তা হবে এবং ভ্রমণের সময়ও কমবে। শ্রীনগর এবং জম্মুর মধ্যে ভ্রমণের সময় সড়ক ভ্রমণের সময়কার পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা থেকে কমে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় নেমে আসবে। পাশাপাশি বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল সেতু, আইফেল টাওয়ারের চেয়েও উঁচু নির্মাণ — এই ন্যারেটিভ পর্যটক টানবে কাশ্মীরে।

আরও পড়ুন-আমরা কাশ্মীরের ‘আপনা আদমি’ হতে পারি না?

২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদি সরকার কাশ্মীরে রেল যোগাযোগ নিয়ে কথা বলে এসেছে। রেলপথের এই উদ্যোগের নেপথ্যে ছিল সহজ এক ধারণা: উন্নয়ন বনাম সন্ত্রাসবাদ। সরকারের যুক্তি ছিল, উপত্যকার সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত করলে পর্যটন ও ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে, যা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক বড় ধাক্কা। আগে, কাশ্মীর যাওয়া মানেই ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিমান যোগাযোগ সবার জন্য পকেটবান্ধব ছিল না। কাশ্মীরের জলবায়ু এমন যে সড়ক যোগাযোগও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা সংযোগ সম্পূর্ণভাবে চালু হওয়ার ফলে, উপত্যকায় পর্যটনের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।

উল্লেখ্য, গত ১৯ এপ্রিল চেনাব সেতু উদ্বোধন এবং বন্দে ভারত চালুর কথা ছিল মোদির, কিন্তু সেই সফর বাতিল করা হয়। এর ঠিক তিন দিন পরই, বৈসরন উপত্যকায় সন্ত্রাসীরা ২৫ জন পর্যটক এবং একজন স্থানীয় কাশ্মীরিকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। পহেলগাঁও হামলা উপত্যকার পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দেয়। তাই চেনাব সেতুর উদ্বোধন এবং কাশ্মীরের দ্রুত ট্রেন পরিষেবা চালু করা গেম-চেঞ্জার হিসেবে কাজ করতে পারে।

More Articles