এসআইআর বিরোধী আন্দোলন কি তৃণমূলকে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে?
Mamata Banerjee Leads Massive Rally Against SIR: তাঁর ব্যাখ্যা, “বিজেপির অন্যতম ভিত্তি মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক, এখন এসআইআর প্রক্রিয়ার চাপের মুখে। ভোটার তালিকা নিয়ে যত বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, মানুষের তত অসন্তোষ বাড়ছে।”
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ফের নতুন ইস্যু। এবার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধনী’ বা এসআইআর (Special Intensive Revision)-এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বে কলকাতার রেড রোড থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত বিশাল র্যালি করে তৃণমূল স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে— ভোটাধিকার রক্ষাই এখন তাদের লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য। প্রশ্ন হলো, এসআইআর বিরোধী আন্দোলন করে তৃণমূল কি শক্তি বাড়াতে চাইছে?
প্রতি বছর ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করে নির্বাচন কমিশন। এ বছর সেই কাজের অংশ হিসেবেই চালু হয়েছে এসআইআর প্রক্রিয়া। ৪ নভেম্বর থেকে বুথ লেভেল অফিসাররা (BLO) বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের নাম, ঠিকানা ও জন্মতারিখ যাচাই করছেন। তবে তৃণমূলের দাবি, এই প্রক্রিয়া ‘স্বচ্ছ নয়’। অনেক প্রকৃত ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “একজন ভোটারও যদি বাদ পড়ে, তবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পড়ে যাবে।” তাঁর অভিযোগ, এই এসআইআর প্রক্রিয়ার আড়ালে গোপনে ভোটার তালিকা থেকে বাংলার নাগরিকদের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে।
রেড রোডের ড. বি.আর. অম্বেডকর মূর্তির সামনে থেকে শুরু হয়ে র্যালিটি শেষ হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হাজার তৃণমূল কর্মী-সমর্থক রাস্তায় নেমে স্লোগান তুলেছেন— “ভোটার বাদ পড়লে গণতন্ত্র হারাবে”, “আমার ভোট আমার অধিকার”, “বাঙালির নাম কেটে দেওয়ার চেষ্টা চলবে না।”
আরও পড়ুন
বিহার এসআইআর: কেন সবচেয়ে বেশি বাদ পড়লেন মহিলারা?
রাজ্যজুড়ে চালু করা হয়েছে ৬,২০০-এর বেশি ভোটার সহায়তা কেন্দ্র। মানুষ যাতে অনলাইনে বা সরাসরি গিয়ে নিজেদের নাম যাচাই করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করছে তৃণমূল। মমতা বলেন, “এই বাংলার মানুষ এখানে জন্মেছে, এখানেই বড় হয়েছে। এখন তাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে— এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
তৃণমূল মনে করছে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়া মানে সরাসরি বিজেপির সুবিধা। কারণ, প্রান্তিক বা দরিদ্র ভোটাররা অনেক সময় কাগজপত্র দেখাতে পারেন না, এবং এই শ্রেণিই তৃণমূলের ভোটভিত্তির বড় অংশ। তাই আগেভাগেই দল পথে নেমে ভোটারদের সতর্ক করতে চাইছে। তবে বিজেপি এই অভিযোগ মানতে নারাজ। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, তৃণমূল অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের কাজ সম্পূর্ণ নিয়মমাফিক হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেবাশিস চক্রবর্তী দ্য হিন্দু-কে বলেন, “এই র্যালি তৃণমূলের জন্য দু'দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ— একদিকে এটি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বার্তা, অন্যদিকে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে সংগঠনকে চাঙ্গা করার কৌশল। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, এই এসআইআর ইস্যুতে আন্দোলন তৃণমূলের জন্য নতুন ‘গ্রাউন্ড কানেকশন’ তৈরি করতে পারে। ২০১৯-এর লোকসভা ও ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজেপি যে হারে ভোট বাড়িয়েছে, তার জবাব দিতে তৃণমূলকে আবার প্রান্তিক বা দরিদ্র ভোটারদের মধ্যে পৌঁছতে হবে। এই র্যালি সেই প্রক্রিয়ারই সূচনা।
আরও পড়ুন
এসআইআর শেষে বিহারের চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট: অজস্র অসঙ্গতির উত্তর নেই
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন সেনগুপ্ত ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন, “বিহারে আমরা দেখেছি প্রায় ৪৭ লক্ষ মানুষ ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় অনেকেই আশা করেছিলেন, তাঁদের নাম নিশ্চয়ই আছে। কারণ সেই সংশোধিত তালিকা ঠিকভাবে জনসমক্ষে আনা হয়নি। ভোটের দিন বুথে গিয়ে দেখা যায়, নাম নেই। ফলে বহু মানুষ হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গায় গন্ডগোলও হয়েছে।” তাঁর কথায়, “আগামী নির্বাচনে এমন ঘটনা আরও বাড়তে পারে। তাই যখন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘একটিও বৈধ ভোটার যেন বাদ না যায়’, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভরসা তৈরি হয়। এতে তৃণমূলের সংগঠন ও রাজনৈতিক শক্তি— দুই-ই আরও দৃঢ় হয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন ভট্টাচার্য ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন, “পুরো এসআইআর বিরোধী প্রক্রিয়াই রাজনৈতিক ভারসাম্যে নতুন প্রভাব ফেলছে। এতে তৃণমূল ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, আর বিজেপি তার নিজস্ব ভোটভিত্তি হারাচ্ছে।” তাঁর ব্যাখ্যা, “বিজেপির অন্যতম ভিত্তি মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক এখন এসআইআর প্রক্রিয়ার চাপের মুখে। ভোটার তালিকা নিয়ে যত বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, মানুষের তত অসন্তোষ বাড়ছে। নাম বাদ যাওয়া, যাচাইয়ে জটিলতা, এমনকি মৃত্যুর মতো ঘটনা— এসবই তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও মজবুত করছে।”
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এসআইআর ইস্যু এখন নিছক প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক সংঘাতের কেন্দ্রে চলে এসেছে। তৃণমূলের কাছে এটি শুধু ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রশ্ন নয়, বরং নিজেদের ভোটভিত্তি রক্ষার কৌশলগত লড়াই। অন্যদিকে, বিজেপি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক নাটক বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে, সামনে যে আরও জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা স্পষ্ট। তবে এর মধ্য ভোটার পরিচয়ের প্রশ্ন— কে ‘বৈধ নাগরিক’, কার নাম থাকবে বা বাদ যাবে। সেই বাস্তবতাকে ঘিরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন এক রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাইছেন: ‘ভোটাধিকার মানেই নাগরিক অধিকার’। এই স্লোগান যদি মানুষের মনে পৌঁছায়, তাহলে আসন্ন নির্বাচনগুলিতে তৃণমূল আবারও মাঠে নিজের প্রভাব পুনর্গঠনের সুযোগ পেতে পারে।

Whatsapp
