কেন শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনেই অচল লোকসভা?
Opposition protest in Parliament: বিরোধীরা জনস্বার্থের নানা বিষয়ে আলোচনা চাইছে, কিন্তু সরকার নির্বাচন কমিশন বা বিহার নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলতেই দিতে চাইছে না।
প্রত্যাশিত ভাবেই হইচই, স্লোগান, পাল্টা অভিযোগ আর রাজনৈতিক টানাপোড়েন দিয়ে শুরু হলো সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। বহু আগেই ধারণা করা হচ্ছিল, অধিবেশন শান্তভাবে চলবে না। রোববারের সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধীরা যে সব ইস্যু তুলেছিল, তা থেকেই দিনের রাজনৈতিক আবহ স্পষ্ট ছিল— এ বছর শীতকালীন অধিবেশনও সংসদীয় সংঘাতের নতুন উপাখ্যান লিখতে চলেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই সেই ধারণাই বাস্তব রূপ নিল। লোকসভা কার্যত বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল বিরোধীদের স্লোগান, প্রতিবাদ ও সরকারের অনমনীয় অবস্থানের কারণে। দফায় দফায় সভা বসলেও স্বাভাবিক কাজকর্ম কিছুই হয়নি। দিনের শেষে লোকসভা মুলতবি ঘোষণা ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া যায়নি। কেন এমন হলো?
রোববার সর্বদলীয় বৈঠকেই বিরোধী শিবির স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনার দাবি তুলবে। সেই তালিকায় ছিল বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ‘ভোটচুরি’ ও অনিয়মের অভিযোগ, দেশজুড়ে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ’, দিল্লির বায়ুদূষণ, রাজধানীর সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ। বিরোধীরা দাবি করেছিলেন, এগুলো জনস্বার্থের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। কিন্তু সরকার আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন সংস্থা (ইসি)-র কাজ, সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতা নিয়ে সংসদে আলোচনার প্রশ্ন নেই। সরকার পক্ষ চাইছিল বিরোধীরা নিয়ম মেনে আলোচনায় অংশ নিক। ফলে অধিবেশন শুরু হতেই দু'পক্ষের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। বিরোধীরা স্লোগান তোলে, অন্যদিকে সরকার অভিযোগ তোলে ‘অযথা নাটকবাজি’-র। এমন উত্তেজনার মধ্যেই প্রথম দিনের অধিবেশন কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন
মণিপুরের দুর্দশার জন্য দায়ি মোদিই? যা বলছেন আরএসএসের মোহন ভাগবত…
যদিও লোকসভায় গোলমাল চলাকালীন রাজ্যসভায় সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য ছিল। দু’দিন আগেই উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় পদত্যাগ করায় নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন সিপি রাধাকৃষ্ণন। সোমবার তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাধাকৃষ্ণনকে অভিনন্দন জানাতে রাজ্যসভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ সব দলের নেতারা। তবে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরেও রাজনৈতিক বাকযুদ্ধ থেকে রেহাই মেলেনি। বিরোধীদের তির্যক মন্তব্যের মূল লক্ষ্য ছিলেন প্রধানমন্ত্রীই।
সংসদীয় প্রথা অনুযায়ী অধিবেশন শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রী মোদি গণমাধ্যমের সামনে এসে সংসদে বিরোধীদের আচরণ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। তাঁর কথায়, “সংসদ নাটক করার জায়গা নয়।” তিনি আরও বলেন, “স্লোগান করার অনেক জায়গা আছে, কিন্তু সংসদ তার মধ্যে নয়।” মোদি স্পষ্ট জানান, বিহার নির্বাচনে পরাজয়ের ক্ষত নিয়ে বিরোধীরা সংসদে আসলে তা মানায় না। তাঁর দাবি, বিহারের নির্বাচন গণতন্ত্রের উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীরা টানা ১০ বছর ধরে হারছে, চাইলে তিনি তাদের দলকে কিছু সহজ টিপস দিতে পারেন। কৌশলে কী বদলালে ভালো ফল মিলতে পারে, সে বিষয়েও তিনি দিকনির্দেশ দিতে পারবেন, এমন মন্তব্যও করেন তিনি।
বিরোধীরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য মানেননি। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সংসদ ভবনের চত্বরে সাংবাদিকদের বলেন, এসআইআর, দূষণ বা নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনার দাবি তোলা নাটক নয়। জনস্বার্থে কথা বলা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব, বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর কথায়, যখন জনস্বার্থে আলোচনাই করতে দেওয়া হয় না, তখনই সেটা প্রকৃত নাটক হয়ে ওঠে। রাজ্যসভায় নতুন চেয়ারম্যানকে অভিবাদন জানাতে গিয়ে বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গেও মোদিকে কটাক্ষ করেন। তাঁর বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী সংসদের বাইরে যেসব মন্তব্য করেছেন, তার জবাব তাঁরা ঠিক সময়ে দেবেন।
আরও পড়ুন
শতবর্ষে আরএসএস : ইতিহাস পুনর্লিখনের পথে মোদি সরকার?
প্রসঙ্গত অধিবেশন চলবে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মোট ১৫ দিন। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন, বিজেপি শাসনে প্রতি বছরই সংসদের কর্মদিবস কমছে। প্রত্যেক অধিবেশনেই কাজের দিন কমে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বিল, প্রস্তাব ও আলোচনার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। তাঁদের অভিযোগ, এটা সংসদকে দুর্বল করারই কৌশল। সরকার অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, সংসদে বিরোধীদের অযথা বাধা, হট্টগোল এবং অসাংবিধানিক দাবিদাওয়াই আসল সমস্যা।
বিহার নির্বাচনের ফলাফলই যে সংসদের এই অধিবেশনে বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠবে তা এখনই পরিষ্কার। বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটচুরি, ইভিএম-এর সমস্যা আর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিহারের ভোট সঠিকভাবে হয়নি। কিন্তু সরকারের দাবি একেবারেই উল্টো। এই বিষয়টি নিয়েই দু'পক্ষের মধ্যে আরও তর্ক-বিতর্ক বাড়তে পারে। কারণ বিরোধীরা এখন SIR–এর (Special Intensive Revision) বিরুদ্ধেও সরব। তাদের অভিযোগ, ভোটার তালিকা ঠিক করার নামে অনেক মানুষের নাম বাদ যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছভাবে কাজ করছে না। সরকার অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে, শীতকাল এলেই দিল্লিতে বায়ুদূষণ কলকাঠি নাড়ে। এ বছরও ব্যতিক্রম নয়। বিরোধীরা চায়, দূষণ রোধে কেন্দ্রীয় নীতির ব্যর্থতা নিয়ে বড় আলোচনা হোক। পাশাপাশি রাজধানীর সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ নিয়েও সুষ্ঠু তদন্ত ও সংসদে বিবৃতি দেওয়া হোক। কিন্তু সরকার এখনই সেই আলোচনায় রাজি নয়, প্রথম দিনেই তা স্পষ্ট হয়ে গেল।বিরোধীরা জনস্বার্থের নানা বিষয়ে আলোচনা চাইছে, কিন্তু সরকার নির্বাচন কমিশন বা বিহার নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলতেই দিতে চাইছে না। এদিকে লোকসভা থেকে সংসদের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে বিরোধীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। রাজ্যসভায় নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা কমেনি। তাই ১৫ দিনের এই অধিবেশন কতটা কাজের হবে, বড় কোনো আলোচনায় পৌঁছানো যাবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

Whatsapp
