২৬ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছেন তারেক রহমান! ক্ষমতার কুর্সি অপেক্ষমান?

Tareq Rahman Returns After 26 Years: অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিষয়টি রাজনৈতিক, এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক।”

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ২৬ বছর পর নির্বাসন ভেঙে বাংলাদেশে ফিরবেন। সম্প্রতি এমনটাই জানালেন তারেক রহমান। তিনি বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, কূটনীতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে বিস্তৃত বক্তব্য রেখেছেন। প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে তিনি প্রথমবারের মতো সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দেন তিনি।

২০০৮ সালে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি ও অপরাধমূলক অভিযোগের মুখে পড়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল তারেক রহমানকে। তখন থেকেই তিনি লন্ডনে থাকেন। তবে, সম্প্রতি তিনি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, "কিছু যৌক্তিক কারণে আমার ফিরে আসা হয়নি... কিন্তু সময় এসেছে, আমি শীঘ্রই ফিরব।" তিনি আরও বলেন, "আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব।" তাঁর কথায়, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তনকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বর্তমানে অসুস্থ। ফলে রাজনীতিতে সক্রিয় নন। এমন পরিস্থিতিতে তারেক রহমান দলের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

সাক্ষাৎকারে মানুষের আস্থা অর্জনের প্রসঙ্গে তারেক বলেন, বিএনপির অভিজ্ঞতা এবং পূর্ববর্তী কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি তাদের ক্ষমতা প্রমাণ করবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, যেমন অভিজ্ঞ একজন ড্রাইভার ঠিকভাবে যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনই বিএনপি দেশের নেতৃত্বে দায়িত্ব নিতে সক্ষম। তিনি বলেন, “আমরা অতীতের ভুল-ত্রুটি থেকে শিখেছি এবং ভবিষ্যতে সেগুলো পুনরাবৃত্তি হবে না।” তিনি আরও বলেন, “ইনসাফ এবং স্বাধিকার ফিরিয়ে আনা আমার উদ্দেশ্য।” নির্বাচনকে 'যুদ্ধ' হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, “এই যুদ্ধে জনগণই আমাদের সেনাবাহিনী।” তাঁর কথায়, “নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে সব রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ পায়।” তাঁর মতে, “যিনি জনগণের তত্ত্বাবধানে রাজনীতি করবেন, তিনি ইতিহাস গড়বেন।”

আরও পড়ুন

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন টানাপোড়েন! শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ কোন পথে?

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিষয়টি রাজনৈতিক, এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক।” তিনি উল্লেখ করেন যে, সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সংস্কার ও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন। তাঁর কথায়, “যতক্ষণ তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন, সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা সেটির ওপর নির্ভর করবে।”

৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ, অগ্রাধিকার সংস্কার নিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি প্রথমে যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, সেগুলিতে জোর দেবে। এছাড়া ৩১ দফার মধ্যে যেসব অগ্রাধিকার আছে, সেগুলোও সরকার গঠনের পর বাস্তবায়িত হবে। “যা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে, তা আমরা করতে চাই না। সাংবিধানিক ও আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ” বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী, সংসদ ও দলীয় নেতৃত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হলে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি তিন পদে থাকলে স্বৈরাচার হবে— এমন ধারণা তিনি মানতে নারাজ। তাঁর মতে, গণতন্ত্র মানে বিভিন্ন মতামতের সংমিশ্রণ, সব ক্ষেত্রে একমত হওয়া বাধ্যতামূলক নয়।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, "আমার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ সবসময় উপরে। জল সম্পদ সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের মতো বিষয়ে আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই।" তিনি বলেন, “সীমান্ত বা জলসম্পদ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থকে কোনোভাবেই অবহেলা করা হবে না।” তারেক রহমানের বক্তব্যে বিএনপির কূটনীতির মূলনীতি পরিষ্কার, “সবার আগে বাংলাদেশ। দেশের সার্বভৌমত্ব ও মানুষের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।” তিনি বলেন, এটি কোনো বৈশ্বিক ট্রেন্ড নয়, এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

আরও পড়ুন

৬ মাসেই পদত্যাগ! কেন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?

তিনি এক এগারোর সরকারের সময়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং স্বৈরাচারি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিএনপির বর্তমান রাজনীতিকে তিনি অভিজ্ঞতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমন্বয় হিসেবে দেখছেন। তাঁর কথায়, “আমরা অতীতের শিক্ষা নিয়ে দেশকে সামনে নিয়ে যেতে চাই।” তারেক রহমান দাবি করেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে মত প্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে। তাঁর কথায়, “২০০১ থেকে ২০০৬ সালের সময় সাংবাদিকদের উপর কোনো নির্যাতন হয়নি। ভবিষ্যতেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে।” তিনি সতর্ক করেন যে, ফ্যাক্ট চেক ছাড়া অপপ্রচারকে সংবাদ হিসেবে প্রচার করা ঠিক নয়।

তারেক রহমান সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, “আমি অনেক মিম ও কার্টুন উপভোগ করি। তবে ফ্যাক্ট চেক জরুরি, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বন্ধ করতে হবে।” তিনি মনে করান, গণতন্ত্রে মানুষের বাক-স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ, তবে অন্যের ক্ষতি করা উচিত নয়।

প্রসঙ্গত, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন এমন একটি সময়ে ঘটছে যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে। গত বছরের "জুলাই অভ্যুত্থান" আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসা এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বিএনপির পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। তবে, তাঁর বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতি ও অপরাধমূলক অভিযোগের কারণে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, যা তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন একটি নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের সূচনা হতে পারে, বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।

More Articles