বিশ্বের সবচেয়ে অসুখী চাকরি কোনটি? ৮৫ বছর ধরে গবেষণা করে ভয়াবহ তথ্য জানালেন গবেষকরা
World's Unhappiest Jobs: প্রায় ৮৫ বছরের এই গবেষণায় এমন চাকরির ধরন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যা সবচেয়ে অসুখী।
পৃথিবীতে কোনও বিশুদ্ধ চাকরি যে নেই, তা মোটামুটি বহুকাল আগেই জানা। চাকরির নানা আঘাত সারাজীবন বইতে বইতে মানুষ ক্লান্ত। চাকরির নিরাপত্তাহীনতা, চাকরিক্ষেত্রে মারাত্মক চাপ এবং কিছুতেই নিজের কাজে ভালো না থাকা- অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং মর্মান্তিক। জীবনানন্দ যখন চাকরি বিষয়ক এই অমোঘ কথাখানি বলছেন, প্রায় সেই সময় থেকেই একটি গবেষণা শুরু হয়েছিল বিশ্বে। প্রায় ৮৫ বছর ধরে চালানো এই গবেষণার ফল সম্প্রতি হাতে এসেছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রায় ৮৫ বছরের এই গবেষণায় এমন চাকরির ধরন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যা সবচেয়ে অসুখী। হার্ভার্ড গবেষকরা ১৯৩৮ সাল থেকে এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। সারা বিশ্ব থেকে ৭০০ জনেরও বেশি মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করেন তাঁরা। প্রতি দুই বছর অন্তর তাদের জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত প্রশ্ন করা হয়েছিল।
এই সমীক্ষা অনুসারে, যে কাজগুলিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনও যোগাযোগই নেই, বা মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত কম, যেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগই নেই, সেই চাকরিগুলিই বিশ্বের সবচেয়ে অসুখী কাজ। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে, সুখী, স্বাস্থ্যকর এবং দীর্ঘ জীবনযাপনের রহস্য অর্থ, পেশার ক্ষেত্রে সাফল্য, ব্যায়াম বা স্বাস্থ্যকর খাবার নয়। মানুষে মানুষে ইতিবাচক সম্পর্কই মানুষকে খুশি রাখে।
সহকর্মী, বা কর্মক্ষেত্রে নানা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, আলাপচারিতা, কাজ ভাগাভাগি করা এমন একটি মূলগত সামাজিক প্রয়োজন যা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পূরণ করা উচিত। যদি কোনও মানুষ অন্য মানুষের সঙ্গে বেশি করে সংযুক্ত থাকেন তবে তিনি তাঁর কাজ নিয়ে আরও বেশি সন্তুষ্ট বোধ করেন এবং আরও ভাল কাজ করেন, জানিয়েছেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মনোরোগবিদ্যার অধ্যাপক এবং হার্ভার্ড স্টাডি অব অ্যাডাল্ট ডেভেলপমেন্টের পরিচালক রবার্ট ওয়াল্ডিংগার।
আরও পড়ুন- লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে সম্বল বই, সাইকেল লাইব্রেরির হাত ধরে দিনবদলের স্বপ্ন এমবিএ যুবকের
গবেষণায় কর্মক্ষেত্রে একাকীত্ব নিয়েও বিশদে কাজ করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন পেশার একটি তালিকাও করা হয়েছে। গবেষণা বলছে, সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন বা একাকী কিছু কাজের মধ্যে একজন মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের যোগাযোগ একেবারেই নেই। এসব ক্ষেত্রে একা একাই কাজ করে যেতে হয়, যেমন রাতের শিফটের কাজ। ট্রাক চালানো এবং রাতের নিরাপত্তারক্ষীদের কাজ একেবারেই একাকীত্বে ভোগার মতো কাজ।
প্যাকেজ এবং খাদ্য সরবরাহ পরিষেবা সহ প্রযুক্তি-চালিত শিল্পক্ষেত্রে প্রায়শই কর্মীদের কোনও সহকর্মী থাকেন না। অনলাইন রিটেইল পরিষেবায় এমনও ঘটে, যেখানে একই শিফটের কর্মচারীরা একে অপরের নামও জানেন না। এই ধরনের কাজে মানুষ ধীরে ধীরে একাকীত্বে ভোগা যন্ত্র হয়ে ওঠে। যেসব চাকরিতে একজন ব্যক্তির সঙ্গে অন্যজনের সম্পর্কই গড়ে ওঠে না, একা একা কাজ করে যেতে হয়, সে রাতের শিফটের কাজ হোক বা ট্রাক চালানো, রাতের নিরাপত্তারক্ষী- এই কাজগুলি মানুষকে একা করে। এই কর্মীদের জীবনে আনন্দ নেই।
তবে শুধু এমন একা একা চাকরির ক্ষেত্রেই নয়, প্রবল সামাজিক চাকরিতে থাকা মানুষও বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারেন যদি তাদের অন্যদের সঙ্গে ইতিবাচক এবং অর্থপূর্ণ যোগাযোগ না ঘটে থাকে। এই কারণেই কর্মক্ষেত্রে একাকীত্বের অনুভূতি কমাতে এবং কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার চাবিকাঠি বলে মনে করা হচ্ছে সামাজিকীকরণকে। মানুষ যদি সারাদিনের কাজের মধ্যে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের, ভাবনা বিনিময়ের, হাসি ঠাট্টার সময় বা সুযোগটুকুও না পান, প্রিয় কাজও অপ্রিয় হতে শুরু করে।
কর্মক্ষেত্রে সামাজিক সংযোগের জন্য ছোট ছোট সুযোগ তৈরি করা একজন কর্মচারীর মন ভালো রাখে। চুপ করে মুখ গুঁজে কাজ করা, একাকীত্ব এবং অসন্তোষের বিভিন্ন অনুভূতি মানুষকে কর্মবিমুখ করে তোলে। মাইনে, প্রোমোশন, সম্মান কোনও কিছুই সেই একাকীত্ব, না ভালো লাগাকে পূরণ করতে পারে না। বিশুদ্ধ চাকরি নেই ঠিকই, কিন্তু মানুষের মানুষের সম্পর্কের উষ্ণতা চিরকালই বিশুদ্ধ। ভালোভাবে বাঁচতে গেলে, এরচেয়ে বেশি আর কীই বা প্রয়োজন!