ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের তথ্য ফাঁস করায় ১৮ বছর জেল! কে এই ব্যক্তি?

Mordechai Vanunu: ইজরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ তাঁকে রোম থেকে অপহরণ করে। তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় নৌকা করে ইজরায়েলে পাচার করা হয়েছিল। এরপর জেল বন্দি করা হয় তাঁকে।

নব্বইয়ের দশক থেকেই ইজরায়েল অভিযোগ করেছে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের দাবি, ইরান গোপনে এই অস্ত্র তৈরি করছে। ইরান দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচী শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, দেশটি এই দাবি মেনে নেয় না, আবার অস্বীকারও করে না। তবে আন্তর্জাতিক মহল দাবি করে আসছে, ইজরায়েলের কাছেও পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এই তথ্য আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন ইজরায়েলি পরমাণু টেকনিশিয়ান মোরেখাই ভানুনু। খোলসা করা যাক, ইজরায়েল কি সত্যি গোপনে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে? কী বলেছিলেন মোরেখাই ভানুনু?

মোরেখাই ভানুনু-এর ফাঁস করা তথ্যের মাধ্যমেই ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের কথা জানতে পেরেছিল গোটা বিশ্ব। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে, লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, শিরোনাম ছিল 'রিভিলড - দ্য সিক্রেটস অফ ইজরায়েলস নিউক্লিয়ার আর্সেনাল' (ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের গোপন তথ্য ফাঁস)। ব্রিটিশ সাংবাদিকতায় সবথেকে বড় 'স্কুপ' সংবাদের মধ্যে অন্যতম এটি। মোরেখাই ভানুনু-কে ছাড়া এই প্রতিবেদন করা সম্ভব ছিল না। ইজরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে এই নিয়ে বিশ্বজুড়ে সন্দেহর জায়গা থাকলেও ভানুনু-এর জন্যই ধোঁয়াশা কেটেছে এবং সবটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে সময় দ্য সানডে টাইমস লিখেছিল ইজরায়েল বিশ্বের ষষ্ঠ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠেছে। আরও বলা হয়, দেশটির কাছে ২০০-টির মতো পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।

ভানুনু নিজেই ইজরায়েলের অতি গোপন 'ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে' চাকরি করতেন। এটি জেরুজালেম থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে নেগেভ মরুভূমির মাঝে। ১৯৮৬ সালে দ্য সানডে টাইমস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ঠিক একবছর আগে ১৯৮৫-র শেষ দিকে চাকরি ছেড়ে দেন ভানুনু। সিদ্ধান্ত নেন এশিয়া-ভ্রমণে বেরবেন। ইজরায়েল প্যালেস্তাইনদের সঙ্গে যা ব্যবহার করে এবং দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প- ইজরায়েলের প্রতি তাঁর অসন্তোষ তৈরি করে। চাকরি ছাড়ার আগে ওই পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের ভেতরের ছবি তুলে নিয়েছিলেন তিনি। সেই ছবির মধ্যে ছিল অস্ত্র তৈরি করতে কীভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিষ্কাশন করা হয় এবং পরীক্ষাগারে বানানো থার্মোনিউক্লিয়ার যন্ত্রের একটা মডেলের ছবি।

আরও পড়ুন-বাহ ১২! ১২ দিনের যুদ্ধে ট্রাম্পের ১২টি পোস্ট

চাকরি ছেড়ে লন্ডনে যান তিনি। সেখানেই দ্য সানডে টাইমস-এ সাক্ষাৎকার দেন। ওই সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক পিটার হাউনাম বিবিসি-কে বলেছিলেন, ৫ অক্টোবর ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়। আর সেদিনই মোরেখাই ভানুনু নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর কথায়, তিনি ডিমোনা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে যা দেখেছেন, তা পুরো বিশ্বকে জানাতে চেয়ে ছিলেন। ভানুনু জানিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি গোপনে ক্যামেরা কারখানার ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। গভীর রাতে বা ভোরের দিকে তিনি গোপনে ছবি তুলতেন।

লন্ডনে তাঁর সঙ্গে এক নারীর আলাপ হয়। দু'জনে দেখাও করতেন। সিনেমা দেখতেও যেতেন। তারপর হঠাৎ একদিন তিনি সানডে টাইমসের সাংবাদিক-কে জানান, তিনি দিন কয়েকের জন্য  ইংল্যান্ডে যাবেন। ঠিক তার এক মাস পর ইজরায়েল ঘোষণা করে ভানুনু-কে আটক করা হয়েছে। হানি-ট্র্যাপ অর্থাৎ নারীকে ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলে ভানুনুকে বন্দি করা হয়। ইজরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদ তাঁকে রোম থেকে অপহরণ করে। তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় নৌকা করে ইজরায়েলে পাচার করা হয়েছিল। এরপর জেল বন্দি করা হয় তাঁকে।

ইজরায়েলের জেল থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সময় ভানুনুর হাতের তালুতে লিখে রেখেছিলেন কীভাবে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। যাতে উপস্থিত সাংবাদিকরা তাঁর হাতের তালুর ওই লেখা দেখে বুঝতে পারেন। সাংবাদিকদের পড়ার জন্য হাতটা জানলায় চেপে ধরেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই জানা গিয়েছিল, লন্ডনে পর্যটক সেজে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল মোসাদ এজেন্ট শেরিল বেনতোভ। এই মহিলাই ৩০শে সেপ্টেম্বর রোমে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে অপহরণ করে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে পাচার করা হয়।

আরও পড়ুন-দলের অন্দরেই অসন্তোষ! ইরান আক্রমণ করে আইন ভেঙেছেন ট্রাম্প ?

বিশ্বাসঘাতকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে ভানুনুর বিচার শুরু হয়। ১৮ বছরের সাজা নির্ধারিত হয় ভানুনুর। জেলে বেশিরভাগটাই তাঁকে একা একটা সেলে বন্দি থাকতে হয়। বন্দি অবস্থাতেই রেকর্ড করা একটি সাক্ষাৎকারে  বলেছিলেন, তিনি ইজরায়েলের  নীতির বিপরীতে গিয়ে বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলেন যে বাস্তব রূপ কী? ভানুনুর বলেন, এটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়। ২০০৪ সালের ২১ এপ্রিল, তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। তাঁর ইজরায়েল ছাড়ার অনুমতি নেই। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার শর্ত না মানার জন্য পরেও বেশ কয়েকবার জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে। ২০০৯ সালে, জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় ভানুনুর চিৎকার করে বলেছিলেন, "১৮ বছরেও আমার কাছ থেকে কোনো কথা বার করতে পারনি, তিন মাসেও পারবে না। ধিক্কার ইজরায়েল।"

২০০৪ সালে ভানুনু জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর সমর্থকরা উৎসব করেছিলেন। তাঁকে 'শান্তির নায়ক' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে একটি সাক্ষাতকারে বিবিসি-কে বলেছিলেন, তাঁর "কোনো অনুশোচনা নেই"। তাঁর কথায়, "গোপনে কী কর্মকান্ড চলছে, তা আমি বিশ্বকে জানিয়েছি। আমি তো বলিনি ইজরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া হোক, আমি বলেছি ডিমোনা ধ্বংস করা হোক। আমি শুধু তুলে ধরেছি যে, এদের কাছে কী রয়েছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ত্ব তো অন্যদের।"

ভানুনু তথ্য ফাঁস করার আগে পর্যন্ত ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না বিশ্ব। শুধু তাই নয় ইজরায়েলের মিত্র দেশগুলোও এই তথ্য জানত না। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, ১৯৪৮ সালে দেশটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিল। ইজরায়েলের প্রচুর দেশের সাথে শত্রুতা রয়েছে। ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুর‍্যিয়নের ভাবতেন, পারমাণবিক অস্ত্র একটা নিরোধকের কাজ করবে।

আরও পড়ুন-কেন কাতারেই হামলা চালাল ইরান?

ডিমোনা কারখানা তৈরির সময় ফ্রান্সের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছিল ইজরায়েল। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ৬০-এর দশক থেকেই পারমাণবিক বোমার তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশটিতে। ইজরায়েল ওই কারখানাটিকে একটি কাপড় তৈরির কারখানা বলে দাবি করতো।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকরা ৬০-এর দশকেই একাধিকবার এখানে এসেছেন। তবে মাটির তলায় যে আরও বেশ কয়েকটি কেন্দ্র রয়েছে তা জানানো হয়নি। লিফট আর দরজাগুলো ইটের গাঁথনি দিয়ে প্লাস্টার করে ঢাকা হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ইজরায়েল ১৩ জুন ইরানে হামলা শুরুর সময় দাবি করেছিল, তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে। যেকোনো সময় এ অস্ত্র তৈরি করে ফেলবে তারা। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ঠেকাতেই দেশটিতে হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েল, মত ইজরায়েলি জনপ্রতিনিধিদের। ওই দিনের হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, রেভ্যুলেশনারি গার্ড-এর কমান্ডার হোসেইন সালামি-সহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং অন্তত ৯ জন পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ইরান। হামলার পর ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, 'ইরানের অস্ত্র তৈরির একেবারে কেন্দ্রস্থলে আঘাত করেছি আমরা।' কিন্তু ইজরায়েল কখনই স্পস্ট করে জানায়নি তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে কিনা।

পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ ও নিরস্ত্রীকরণের জন্য ১৯৭০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ১৯১ টি দেশ ট্রিটি অন দ্য নন-প্রলিফারেশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি) বা এনপিটি-তে সই করেছে। ইজরায়েল ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং চিনের পারমাণবিক অস্ত্র রাখার অনুমোদন রয়েছে। কারণ, এই প্রতিটি দেশই ওই চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগে পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছিল। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, ইজরায়েল নিজের অবস্থান স্পষ্ট না করেই কী করে অন্য দেশের বিরুদ্ধে আঙুল তুলছে? প্রশ্ন এও উঠছে যে, যখন মোরেখাই ভানুনু-কে অপহরণ করা হলো কোথায় ছিল পুরো বিশ্ব?

More Articles