১৯৬৭ থেকে ২০২৫! যেভাবে গাজায় বারবার নিশানা করা হচ্ছে সাংবাদিকদের

Israel’s killing of journalists: ইজরায়েল ১৯৬৭ সালে দখলদারিত্বের প্রথম দিন থেকেই, মিডিয়া রিপোর্টিংয়ের উপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চেয়েছে। পরে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে সেন্সরশিপ আনা হয়।

২৫ অগাস্ট ইজরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগ টার্গেট করে পর পর দু-বার হামলা চালায়। হামলায় প্রাণ হারান মহিলা চিত্র সাংবাদিক মরিয়ম আবু দাক্কা। তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আরবিয়া এবং অ্যাসোসিয়েট প্রেস-এর সঙ্গে কাজ করতেন। মরিয়াম আবু দাক্কা ২০২০ সালের শুরুতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট আরবিয়া-তে ফটো সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রতি দিন বিশ্বের সামনে তুলে ধরেতেন তিনি। বোমা হামলা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, ক্ষুধার্তদের দৃশ্য কোনোটাই বাদ যায়নি তাঁর কভারেজে।

মাত্র ১১ বছরের ছেলে গাইথকে রেখেই গাজায় চিত্র সাংবাদিকতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন মরিয়ম আবু দাক্কা। যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝাতে সোশাল মিডিয়ায় করা শেষ পোস্টে লিখেছিলেন, “প্রতিটি বাড়িতে একটি গল্প, প্রতিটি বাড়িতে একজন বন্দি, প্রতিটি বাড়িতে দুর্দশা— এখানে কোন জায়গাই নিরাপদ নয়।”

২৫ অগাস্ট ইজরায়েল বাহিনী প্রথমে টার্গেট করে নাসের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। উদ্ধারকারী দল আহতদের সরিয়ে নিতে, মৃতদের উদ্ধার করতে এবং সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করতে এলে ১৫ মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয় হামলাটি করা হয়। হামলায় ২০ জনেরও বেশি প্রাণ হারান। তার মধ্যে পাঁচ জনই সাংবাদিক। তাঁদের নাম- মরিয়ম আবু দাক্কা, আল জাজিরা-র মোহাম্মাদ সালাম, রয়টার্স-এর হুসাম আল-মাসরী, মিডেল ইস্ট আই-এর মোয়াজ আবু তাহা এবং আহমদ আবু আজিজ। রয়টার্স জানিয়েছে, আল-মাসরি হাসপাতাল থেকে লাইভ ভিডিও চালাচ্ছিলেন। সেই সময়ই হামলা হয়। মুহূর্তেই হঠাৎ লাইভ বন্ধ হয়ে যায়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করে। আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, এই দিন ইজরায়েলি হামলায় গাজা জুড়ে মোট ৬১ জন নিহত হয়েছেন।

আরও পড়ুন-গাজা প্রসঙ্গে ১০০-রও বেশি অবসরপ্রাপ্ত আমলার খোল চিঠি! ইজরায়েল প্রশ্নে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ অবস্থানের নিন্দা যে ভাষায়

এর আগেও সাংবাদিকদের নিশানা করে হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল বাহিনী। ১১ অগাস্ট আল জাজিরার চার সাংবাদিক নিহত হয়েছিলেন।আল-শিফা হাসপাতালের গেটের বাইরে সাংবাদিকদের জন্য একটি তাঁবু ছিল। সেখানেই হামলা করেছিল ইজরায়েল। আক্রমণে মোট ৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ৫ জনই আল জাজিরার-র সংবাদিক।

উল্লেখ্য, কানাডা, মিশর, ইরান এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলি নাসের হাসপাতালে ইজরায়েলি হামলার নিন্দা করেছে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ) এবং ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন-সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলিও এই হামলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠার পর , ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে ইজরায়েল "সাংবাদিকদের কাজকে মূল্য দেয়।" কিন্তু বাস্তব চিত্র তো সেই কথা বলে না। আল জাজিরার ১২ অগাস্টের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ২২ মাসে মোট ২৭০ জন সাংবাদিক প্রান হারিয়েছেন। এই সংখ্যা ইউক্রেনের যুদ্ধে নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যার তুলনায় অনেকটাই বেশি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস ইজরায়েলের নিন্দা করে বলেছে, সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে ইজরায়েল সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যার চেষ্টা করছে। তারা আরও বলে, "প্যালেস্টাইনের সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সরাসরি নিশানা করা হচ্ছে এবং তাঁদের নির্বিচারে আটক করে নির্যাতনও করা হচ্ছে"।

গাজায় সাংবাদিকদের হত্যার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। প্যালেস্টাইনের এক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ দ্য কনর্ভার্সেশন-কে বলেন, সাংবাদিকদের উপর হামলা ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হল, ইজরায়েল গাজায় বাইরের দেশের সাংবাদিকদের ঢুকতে দিচ্ছে না। এর ফলে গাজায় সিংহভাগই প্যালেস্টাইনের সাংবাদিকরাই গ্রাউন্ড রিপোর্টিং করতে পারছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে ২০০ জনই প্যালেস্টাইনের।

ইজরায়েল ১৯৬৭ সালে দখলদারিত্বের প্রথম দিন থেকেই, মিডিয়া রিপোর্টিংয়ের উপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চেয়েছে। পরে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে সেন্সরশিপ আনা হয়। ওই বছরেরই অগাস্টে, ইজরায়েলি সেনাবাহিনী ধারা ১০১ জারি করে প্যালেস্টাইনে রাজনৈতিক সমাবেশ এবং প্রচারমূলক প্রকাশনাগুলিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। সে সময় সমস্ত প্যালেস্টাইন সংবাদমাধ্যমগুলিকে ইজরায়েল কর্তৃপক্ষের কাছে দুটি করে মুদ্রণ কপি জমা দিতে হত। তবে বিধিনিষেধ সত্ত্বেও, স্থানীয় সাংবাদিকতা টিকে ছিল এবং তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধিও পেয়েছিল।

আরও পড়ুন- যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে মুনাফা লুটছে মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট?

১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে প্যালেস্টাইনবাসী প্রথম ইজরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহের প্রথম বছরেই , ইজরায়েলি বাহিনী ৪৭ জন প্যালেস্টাইন সাংবাদিককে আটক করে, আটটি স্থানীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্র সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে, দুটি পত্রিকার লাইসেন্স বাতিল করে এবং চারটি প্রেস সার্ভিস অফিস বন্ধ করে দেয়।

অনেকেই মনে করেছিলেন, ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার মধ্যে হওয়া অসলো চুক্তি হয়তো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু তা হয়নি। ওই চুক্তির অংশ হিসেবে প্যালেস্টাইনে নতুন কর্তৃপক্ষ আসে, এরা অস্থায়ী ভিত্তিতে প্যালেস্টাইনেকে আংশিকভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরাও আবার নিজস্ব একটি সেন্সরশিপ ব্যবস্থা আনে। যে সংবাদমাধ্যম গুলিকে সমালোচনামূলক বলে মনে করা হত, তাদের সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হত, এমনকি কিছু সংবাদমাধ্যমকে বন্ধও করে দেওয়া হয়েছিল।

ইজরায়েলের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ইজরায়েলি হামলায় ২০২৩ থেকে এখনও অবধি মোট ৬২,৭৪৪ জন নিহত এবং ১,৫৮,২৫৯ জন আহত হয়েছেন। শেষে পরে থাকে একটাই প্রশ্ন, যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রচার বন্ধ করতেই কি ইজরায়েল সাংবাদিক মুক্ত গাজা চাইছে?

More Articles