একদিকে রাস্তায় হাঁটছেন নগ্ন মেয়ে, অন্যপ্রান্তে ২ আদিবাসী তরুণীর গণধর্ষণ, চলছেটা কী মণিপুরে?
Manipur horror: একের পর এক মণিপুরে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা শিউড়ে ওঠার মতোই। এতদিন সিরিয়া, কাবুলে জঙ্গি-অত্যাচারের কথা শুনে ভয় পেয়েছি আমরা। মণিপুরে যা হচ্ছে, তাকে কি কোনও ভাবেই লঘু করে দেখা যায়?
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সঙ্গে নিরাপত্তাও মানুষের মৌলিক অধিকার। আর মণিপুরে যা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, তাকে শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন বললেও বোধহয় কম বলা হবে। একটা সময় দিল্লিকে 'রেপ ক্যাপিটাল' বলা হত। তবে মণিপুরে যা হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, বিশেষত মেয়েদের সঙ্গে, তা ভেঙে ফেলছে সমস্ত রেকর্ড।
মণিপুর ছাড়া উত্তরপূর্বের হাতে গোনা কয়েকটি রাজ্যেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। সেই মাতৃতান্ত্রিক মণিপুরে আপাতত মেয়েদের রাস্তাঘাটে বেরোনোটাই ভয়ঙ্কর রকমের বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিপজ্জনক অবশ্য বাড়িতে থাকাটাও। কখন যে জাতিহিংসার জের এসে ঢুকে পড়বে একেবারে ঘরের অন্দরে, তা বলা কঠিন। টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় বের করে আনা হবে বাড়ির মেয়েদের। চলবে নির্বিচারে অত্যাচার, গণধর্ষণ। নগ্ন করে ঘোরানো হবে রাস্তায়। কিংবা রক্তাক্ত দেহখানি পড়ে থাকবে রাস্তায় নর্দমার ধারে।
আরও পড়ুন: মণিপুর ঢাকতে বিজেপির চাই একটা শরীর? রাজা তোর কাপড় কোথায়!
দু'দিন আগেই সামনে এসেছিল মণিপুরের দুই মেয়েকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় ঘোরানোর ভয়ঙ্কর ছবি। ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল সেই ভিডিও। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। মে মাস থেকে হওয়া জাতি হিংসা, অশান্তির খবর কানে আসা সত্ত্বেও এতদিন চোখে ঠুলি ঠেঁসে ছিল সরকার ও প্রশাসন। তবে ওই ভিডিও সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসে তারা। এমনকী প্রশাসনের পদক্ষেপ করার সময় বেঁধে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তবে তার রেশ কাটতে না কাটতে ফের ভয়াবহ নারী নির্যাতনের খবর এল মণিপুর থেকে।
ইম্ফলের একটি গাড়ি ধোয়ার ওয়ার্কশপের ভিতরে এবার দুই আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের দোষ একটাই, তাঁরা আদিবাসী, এবং তাঁরা দু'জনেই কঙ্গপকপি জেলার বাসিন্দা। এই ঘটনাটিও কিন্তু গত ৪ মে-র। গণধর্ষণের পরে তাঁদের ফেলে রেখে যাওয়া হয় একটি রাস্তার ধারে। আর ঠিক সেদিনই ইম্ফল থেকে ঠিক ৪০ কিলোমিটার দূরে হিংসায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল কঙ্গপকপি জেলা। চলেছিল ব্যাপক ধর্ষণ, মহিলাদের উপর নৃশংস অত্যাচার। যে সময় বিবস্ত্র করে রাস্তায় ঘোরানো হচ্ছিল দুই মণিপুর-কন্যাকে, ঠিক সে সময় মণিপুরের আরেক প্রান্তে, ইম্ফলে ভয়ঙ্কর নির্যাতন চলছিল অন্য দুই মেয়ের উপর। পরে যখন পুলিশ এসে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যায়, ততক্ষণে উধাও প্রাণপাখি।
'বিচারের বাণী' বরাবরই নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে। মণিপুরের ক্ষেত্রেও তা কোনও নতুন ব্যাপার। মনোরমার মৃত্যুর পরেও সাজা পায়নি দোষীরা। এই মনোরমারাও পাবেন কিনা বলা কঠিন। গত মে মাস থেকেই হিংসায় উত্তাল ছোট্ট রাজ্যটি। মর্গে জমছে লাশের পাহাড়। সৎকার তো দূরের, শনাক্ত করার মতো স্বজনেরও বড় অভাব। অভাব হবে না-ই বা কেন, বেশিরভাগ লোকই এখন মান-প্রাণ হাতে করে মণিপুর ছাড়ছেন। পিছনে পড়ে থাকছে আপনজনের মৃত শরীর, স্মৃতি। যেমন ইম্ফলে কাজ করতে গিয়ে দেহ হয়ে যাওয়া ওই দুটি মেয়ের এই ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা জানতেই পারল না তাঁর পরিবার। এক বন্ধু শুধু দেখেছিলেন, ওই দুই তরুণীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। পরের দিন হাসপাতালে খবর নিতে গিয়ে জানতে পারেন, মারা গিয়েছেন দু'জনেই। কোনও মতে এক মৃতার তুতো-বোনকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু জানা যায় প্রাণভয়ে এক গির্জায় লুকিয়ে রয়েছেন তিনিও। পরে আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা এসে সেই মেয়েটিকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেন।
এটাই এখন কার্যত পরিস্থিতি গোটা মণিপুরের। সেদিন বিকেলের ওই ঘটনাটা চাক্ষুষ করলেন অনেকেই। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না মেয়ে দু'টিকে বাঁচানোর জন্য। কেউ কেউ আরও উস্কে দিলেন। একদল লোক এসে এক এক করে ঘরে তুলে নিয়ে গেল মেয়ে দুটিকে। চলল পালা করে ধর্ষণ। তার পর ফেলে গেল রাস্তার ধারে। প্রশাসন চুপ, প্রত্যক্ষদর্শীরা চুপ। ঘটনায় স্বতপ্রণদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
একের পর এক মণিপুরে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা শিউড়ে ওঠার মতোই। এতদিন সিরিয়া, কাবুলে জঙ্গিদের অত্যাচারের কথা শুনে ভয় পেয়েছি আমরা। মণিপুরে যা হচ্ছে, তাকে কি কোনও ভাবেই তার থেকে লঘু করে দেখা যায়! ইম্ফলে কাজ করতে গিয়ে 'লাশ' হয়ে যাওয়া ওই দুই তরুণীর পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি এফআইআরে। অথচ হাসপাতাল থেকে সেসমস্ত তথ্যই পেয়েছিল পুলিশ। এমনকী মিলেছিল দু'জনের পরিচয়পত্র দু'টিও। গত দু-আড়াই মাস ধরে চলা মণিপুরের অশান্তি, হিংসা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিয়ে কী পদক্ষেপ করেছে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার, সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আর তারপরেই বিবস্ত্র করে মেয়েদের রাস্তায় ঘোরানোর ঘটনায় পটাপট গ্রেফতারি সারছে পুলিশ। এর মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে নয়া তরজা। মণিপুরে মুখ বাঁচাতে অন্য কোনও রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা, সেই নজির খোঁজার চেষ্টা করছে বিজেপি।
আরও পড়ুন:ফের ফিরছে মনোরমার স্মৃতি! এ কোন অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে মণিপুরে?
আর ভয়ে ভয়ে অন্ধকারে সিঁধিয়ে কোনও মতে জীবন কাটাচ্ছেন মণিপুরের মেয়েরা। সেই মণিপুর, যা নাকি মাতৃতান্ত্রিক। সেই মণিপুর, যা বছরের পর বছর ধরে সুযোগ পেলেই মেয়েদের কোণঠাসা করেছে, নিপীড়ন করেছে। শরীরকে বানিয়ে তুলেছে লালসা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অস্ত্র। যে কোনও রকম শাস্তি দেওয়ার নামে যেভাবে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ধর্ষণের পথ বেছে নিয়ে এসেছে ক্ষমতাশালীরা, তার অন্যথা হচ্ছে না মণিপুরেও। তবে ইতিহাস সাক্ষী, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তা জানে মণিপুরের 'মনোরমার মা'-রা। আর এখন এই অসুস্থ মণিপুরের দিকে তাকালে মনে হয়, সে দিনের আর খুব বেশি দেরি নেই বোধহয়।