অপরাজিত, বেলাশুরু থেকে বল্লভপুরের রূপকথা, বাংলা ছবির দর্শককে কতটা হলমুখী করল ২০২২

Bengali Movie : ২০২২ সালে মুক্তি পেয়েছে একগুচ্ছ বাংলা ছবি, কী কী দিয়ে গেল ছবিগুলি

‘নস্টালজিয়া’ শব্দটার সার্থক তর্জমা করেন বাঙালিরাই। ফিরে দেখার অভ্যাস এ জাতির চিরকালীন। বর্ষশেষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাই সারা বছরের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মস্ত একখানা হিসেবের খাতা খুলে না বসলেই নয়। ২০২২, একটা ‘নিউ নর্মাল’ বছর। নিউ আর নর্মালের এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা বাঙালি তবু জীবনের সবটুকু রসদ চেটেপুটে উপভোগ করেছে। এ বছরের শুরুটা মনে পড়লে অদ্ভুত একটা অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। একের পর এক শিল্প জগতের জ্যোতিষ্ক মৃত্যুর ঘটনায় জর্জরিত ছিল সেসময়। তবু সে সময়টুকু একমাত্র সত্য নয়, তার পাশেই ছিল রোদের ঝিলিক। হাসি কান্নার এই ব্যালেন্সটুকুই তো জীবন। এর কোনও একটা পাল্লা বেশি ভারী হওয়ার জো নেই।

হাতে গোনা মাত্র আর কয়েকটা দিন, তারপরই আনকোরা নতুন একটা বছর। এই ২০২২ আমাদের কী কী দিয়ে গেল সেই হিসেবটুকু আসন্ন। ২০২২ সালে মুক্তি পেয়েছে একগুচ্ছ বাংলা ছবি। বাংলা ছবি দেখার যে প্রচ্ছন্ন অনীহা দিন দিন জাঁকিয়ে বসেছিল সমাজে, এ বছর তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলার ছবিই। শুধু ছবি বললে ভুল হবে, সেই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা গোটা ইন্ডাস্ট্রি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শুধু শহর কলকাতা নয়, শহরতলির বাঙালি দর্শকরাও আবার হলমুখী হয়েছে বাংলা ছবির হাত ধরেই। এ বছরের এমন কিছু বাংলা সিনেমা নিয়েই আজকের প্রতিবেদন।

অপরাজিত

অনীক দত্তের ছবি আর বিতর্ক, এ যেন সমার্থক। নিন্দুকেরা বলেন এভাবেই খানিক দর্শক টানার প্রয়াস করেন পরিচালক। তবে এবার সেসব নিন্দার মুখে ছাই ঢেলে দিয়েছে নতুন ছবি ‘অপরাজিত’। ছবিটির লুক সেটের ছবি সামনে আসার পরই বাঙালি নড়েচড়ে বসে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা জিতু কমল যেন অবিকল সত্যজিৎ রায়। প্রথম দেখায় তফাৎ করা মুশকিল। সত্যজিতের মুখের প্রতিটি ভাঁজ যেন অবিকল মিলিয়ে দিয়েছেন টিম অপরাজিত। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী' নির্মানের গল্প নিয়েই ছবি। বাঙালির এমনিতেই সত্যজিৎকে নিয়ে বিস্তর নস্টালজিয়া তার ওপর জিতু কমলের অমন লুক, সব মিলিয়ে এ ছবি মুক্তির আগে থেকেই উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। তবে গত ১৩ মে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এ ছবি নিয়ে চলেছে অন্য বিতর্ক। সেই জল্পনার রেশ আজও উজ্জ্বল। কলকাতার সরকারি প্রেক্ষাগৃহ নন্দন, যার লোগোর ক্যালিগ্রাফিটি পর্যন্ত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, সেই হলেই জায়গা পেল না খোদ সত্যজিতের জীবনী। শুধু তাই নয়, কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলার নামজাদা বেসরকারি হল গুলিতেও প্রাইম টাইমে জায়গা পায়নি এই ছবি। যদিও তাও বাঙালি বুঝিয়ে দিয়েছে এ ছবিতে আটকে রাখা সম্ভব নয়। সমস্ত বিতর্ক, বাধা সামলেও এই ছবি বক্স অফিসে আনুমানিক ২.৯৪ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। এই ছবির পরতে পরতে উঠে এসেছে নস্টালজিয়া। অদ্ভুত সেই পুরাতন দৃশ্যের হুবহু চিত্রায়ন। আর এতেই বাঙালির আটকে পড়ল আবারও। হলের বাইরে লম্বা লাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পর্যালোচনা নিমেষে একটা যুগকে আবার ফিরিয়ে আনল বাংলা ছবির কাছে।

আরও পড়ুন - ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ফিরিয়ে আনল বাংলা সিনেমার হারিয়ে যাওয়া ‘ভূত’

বেলা শুরু

শুরু থেকেই এই ছবিকে ‘বেলা শেষে’র এক্সটেনশন বলতে নারাজ ছিলেন পরিচালক নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। অথচ সেই এক কাস্ট, এক সম্পর্ক। কেবল বদলে গিয়েছে সমীকরণগুলো, আর তার সঙ্গে এসেছে একটা নতুন গল্প। এই ছবির আসল ইউ এস পি হল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সাথীলেখা সেনগুপ্ত। সদ্য না ফেরার দেশে পাড়ি দেওয়া এই দুজনই যেন মৃত্যুর পরেও বাংলা সিনেমাকে একটা অন্য দিগন্ত চিনিতে দিয়ে জেলার আবার। আর চিরন্তন নস্টালজিয়া আঁকড়ে ধরে বক্স অফিসে আনুমানিক ৪.৩৮ কোটি টাকার বাজার ছুঁয়ে ফেলল ‘বেলা শুরু’।


কিসমিস

গত ২৯ এপ্রিল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে 'কিশমিশ'। বর্তমানের চাহিদা ভালোই বোঝেন প্রযোজক দেব। তাই কমার্শিয়াল ছবি থেকে অন্য ধারার ছবি ঝুঁকেছেন তিনিও। দেব এবং রুক্মিণী অভিনীত একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প রয়েছে ছবিতে। অথচ তার মধ্যেই রয়েছে একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসার সার্থক প্রয়াস। দেব রুক্মিণী জুটির জন্যই হোক অথবা নতুন ধরনের গল্পের জন্য 'কিশমিশ' কিন্তু বক্স অফিসে দারুণ সাড়া ফেলে। আনুমানিক ২.০৬ কোটি টাকার ব্যবসা করে ছবিটি।

দোস্তজি

নতুন পরিচালক প্রসুন চট্টোপাধ্যায়ের এটিই প্রথম ছবি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলার এক গ্রামের দুই বন্ধুর গল্প নিয়ে এগিয়েছে ছবির গল্প। নতুন ধারার এই কাজের ট্রেলার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন। বাঙালি অবশ্য ইতিমধ্যে অন্য রকম ছবি দেখার প্রতি আকর্ষিত হয়েছেন তাই এই ছবিটি সেই তালিকায় বাড়তি সংযোজন।

হাওয়া

ওপার বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে এ পারে জনপ্রিয় হতে বেশি সময় লাগেনি চঞ্চল চৌধুরি অভিনীত ছবি 'হাওয়া'র। প্রথমে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব, তারপর কলকাতা আন্তর্জাতিক উৎসব হয়ে এপার বাংলার হলে মুক্তি। নিছক ‘হাওয়া’ হয়ে থাকেনি এ ছবিটি, হল থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, দুই পক্ষের দর্শকের মধ্যেই রীতিমত ঝড় তুলেছিল।

বিসমিল্লা

এই ছবিতে একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এবং অসমবয়সী ভিন্ন ধারার প্রেমের কথা বলেছেন পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। ছবিতে ঋদ্ধি সেন, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয়ও বহুল প্রশংসিত হয়েছে।

আরও পড়ুন - পাশে দাঁড়ানোর আর্তি নয়, নিজের জোরে এপার বা‌ংলাকে টেক্কা দিচ্ছে বাংলাদেশের সিরিজ ও সিনেমা

কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন

গত ৩০ সেপ্টেম্বর, মহাপঞ্চমীর দিন মুক্তি পেয়েছিল ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি 'কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন'। এসভিএফ-এর ব্যানারে এটা সোনা দা, আবির ও ঝিনুকের তৃতীয় ছবি। একে পুরনো দুই ছবির একটা নস্টালজিয়া তায় আবার পুজোর ছুটির মোক্ষম সময়ে মুক্তি, সিন মিলিয়ে এ বছর সবথেকে বেশি ব্যবসা করে এই ছবিটি। ‘অপরাজিত’ অথবা ‘বেলা শুরু’ যে বাংলা ছবির দর্শককে হলমুখী করতে পেরেছিল তার সার্থক ফল মেলে এই ছবির আয়ের হিসেবে। আনুমানিক ৯.৮ কোটি টাকার ব্যবসা করে ছবিটি।

বল্লভপুরের রূপকথা

‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ ছবির ঠিক মাস খানেক পর গত ২৫ অক্টোবর মুক্তি পায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য পরিচালিত প্রথম বড় পর্দার ছবি 'বল্লভপুরের রূপকথা'। অনির্বাণের পরিচালিত ‘মন্দার’ সিরিজের ঘর তখনও টাটকা, ফলে এই ছবি নিয়ে প্রথম থেকেই উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। এই ছবিতে বাংলা থিয়েটারের একাধিক নতুন মুখকে তুলেছেন পরিচালক। হরর কমেডি জঁনারের এই ছবিটি বাদল সরকারের জনপ্রিয় নাটক 'বল্লভপুরের রূপকথা' অবলম্বনে তৈরি। ছবিতে অভিনয় করছেন সত্যম ভট্টাচার্য ও সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়। আনুমানিক ৪ কোটি টাকা আয় করে ছবিটি।

টনিক

সব শেষে আরও একটি ছবির কথা না বললেই নয়। যদিও এই ছবিটিকে এ বছরের তালিকায় কতটা রাখা যায় তার বিচার করবেন দর্শকরাই। অভিজিৎ সেন পরিচালিত 'টনিক' মুক্তি পায় গত বছর ডিসেম্বর মাসের শেষে। কিন্তু তার সফর ২০২২ সালের শুরুটা মাতিয়ে রেখেছে। মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই বক্স অফিসে বিপুল সারা ফেলেছিল ছবিটি। 'হাউজফুল' শো-এর জেরে, বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে বাড়াতে হয়েছে শো সংখ্যা। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে তারকাদের মুখে মুখে প্রশংসিত 'কাকা' ও তাঁর 'টনিকের' দারুণ বন্ডিং।

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে আরও বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি। ‘হামি টু’, ‘প্রজাপতি’, ‘হত্যাপুরী’র মতো ছবিগুলি হিন্দি ছবির সঙ্গে দৌড়ে রীতিমতো মন কাড়ছে দর্শকদের। আগামীতে এই পথ আরও সুগম হবে, এমন আশা নিয়ে চলবে নতুন বছর। ২০২৩-এর সফরে বাংলা ছবির ওঠানামা চলুক তরতরিয়ে।

More Articles