ঋণ : সুনেত্রা সাধু
Bangla Short Story: অতীনের কেউ নেই, যার কাছে সে স্মৃতিকথা জমা রাখবে। তাই সব কথা আসবাবের কানে কানে বলে রাখে অতীন। বিশ্বাস করে, ওরা মনে রাখবে।
ভগ্ন দেউলে যেমন নিঃসঙ্গ ঈশ্বরের বাস তেমনই এই দো’মহলা দালানে একলাই থাকে অতীন। ঠিক একলা বলাটা ভুল হবে। ভাঙাচোরা মন্দিরে রাধামাধব জীউয়ের সেবার জন্য এক পুরোহিত বহাল করা আছে, যার বাপ ঠাকুর্দা এ বাড়ির ঠাঁট চেখেছিল। রোশনাই দেখেছিল। সে সবই গিয়েছে। তবু নড়বড়ে পুরোহিত দু'বেলা আসে। মঙ্গলা ভোগ আর শীতল ভোগে নম নম করে জল বাতাসা নিবেদন করে। অতীনকেও দেখাশোনার জন্য এইরকমই এক ভাঙাচোরা মানুষ এখনও রয়ে গিয়েছে, তার নাম জগা। দু’বেলা দু’মুঠো রেঁধে দেয়, বহুকাল ধরেই দিচ্ছে। ওর রক্তেও দাসত্ব বইছে, ছেড়ে যেতে পারে না। লোকটার বয়সটাও অতীন এবং এই বাড়িটার সঙ্গে মানানসই…
আশ্চর্যের হলেও হাতিবাগানের মতো জায়গায় বাড়িটা এখনও আছে। ফাটল ধরেছে। পলেস্তারা খসেছে। চিলেকোঠার গম্বুজে গজানো বটগাছের শেকড় বাড়তে বাড়তে মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে, তবু বাড়িটা আছে। অতীন না থাকলে আর থাকবে না। সৎকার হবে, মৃত মানুষের যেমন হয়। ভাঙবে, আবার গড়বে। এ শহরে শূন্যতার কোনও স্থান নেই। গড়ে ওঠা ছোট ছোট পায়রার খোপে ভিনদেশি মানুষেরা ঠাঁই নেবে। একটু একটু করে বদলে যাবে শহরের চরিত্র। ফারাক শুধু একটাই, রয়ে যাবে বার্মা টিকের কড়ি-বরগা, বেলজিয়ামের আয়না, ইউরোপের কাচের পুতুল, ভিক্টোরিয়ান আসবাব, রঙচঙে শার্সি, পার্সিয়ান গালচে, সাধের গ্রামাফোন, গজলের রেকর্ড… হয়তো ঠাঁই হবে কোনও নিলাম ঘরে। তারপর ছড়িয়ে যাবে এর বাড়ি ওর বাড়ি। অতীন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, জড় বস্তুরও স্মৃতি থাকে। স্মৃতি, এক অদ্ভুত ক্ষমতা। মগজের কোশে কোশে কত তথ্য জমা করে রেখেছে অতীন, সব কি মনে থাকে? সঞ্চয় করেছে ঠিকই তবে সংরক্ষণ হয়েছে কি? বেশিরভাগই হয়নি। তবু কিছু ঘটনা এমন থাকে যা ভোলা যায় না, আজীবন। অতীনের কেউ নেই, যার কাছে সে স্মৃতিকথা জমা রাখবে। তাই সব কথা আসবাবের কানে কানে বলে রাখে অতীন। বিশ্বাস করে, ওরা মনে রাখবে। মানুষ মরণশীল, কতদিনই বা আয়ু? সৎকার হলে দেহটা পুড়বে, সঙ্গে স্মৃতিটাও…
আরও পড়ুন- চন্দ্রবিন্দু ডট কম: অমৃতা ভট্টাচার্য
অতীন ওই স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে থাকে, বৃদ্ধ মানুষের আর কীই বা কাজ! বিকেল হলে দোতলার একফালি ছাদে আরামকেদারা পেতে দেয় জগা। অতীন বসে থাকে, আকাশ দেখে। আজও তাই দেখছিল। চৈত্রের শেষ দিনটা ছেড়ে চলে যাবে বলে আকাশের পশ্চিম দোরে পা রেখেছে। লালচে আলোর চাদরে ঢাকা পড়েছে কলকাতা শহর। পুরনো অভ্যাস বশে দু’ আঙুল দিয়ে সেই আলোর চাদরের জমি পরীক্ষা করে অতীন। সিন্থেটিক যেন, আগে কেমন আলোর গায়ে রেশমের মায়া জড়ানো থাকত। অতীনের তিনপুরুষ রেশমের কারবার করেই এই দালান কোঠা তুলেছে, গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরেছে। ব্যবসাটা যখন অতীনের হাতে এল তখন তাতে সেই জাঁক আর ছিল না। না থাকারই কথা। অতীনের জন্মের বছর কয়েক আগেই ব্রিটিশরা দিল্লি চলে গেল। ওঁর বাবা কামিয়েছেন যত, উড়িয়েছেন তার দ্বিগুণ। বৈভবের গায়েও এক সময় মরচে পড়ল। অতীন অবশ্য ছেলেবেলায় অভাবটা তেমন করে টের পায়নি। বছর শেষের দিনটা বেশ উৎসবে মোড়ানো থাকত।
যা ছিল তা আর থাকে না। সময়ের কাঁটা ঘোরে, সবই একদিন ফিকে হয়ে আসে। সুদিনও…
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশে মন দেয় অতীন। সন্ধ্যা নামছে। মায়ার টান থাকলে চলে যাবার আগে সবাই একবার পিছন ফিরে তাকাতে চায়। দিনের শেষ আলোটাও পিছন ফিরে তাকিয়ে আছে। মিলিয়ে নিচ্ছে কী কী ফেলে গেল। আগামীকাল থেকে সব নতুন। আরামকেদারাটা অতীনের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে, “চলো অতীন আমরাও ঘুরে আসি।”
“যাব? প্রথমে তাহলে গাজনতলায় যাই?”
“হ্যাঁ, তুমি কোথায় যেতে চাও তা কি আমি জানি না? প্রথমে গাজনতলা সব শেষে নাচঘর। ওই পথে আমরা কতবার গিয়েছি অতীন? গুনে রেখেছ? তোমার খেরোর খাতায় সে হিসেব তোলা আছে তো?”
“আছে। জানো, মাঝে মাঝে মনে হয় অপেক্ষার হিসেব রাখব বলেই বোধহয় জন্মেছি।”
“অপেক্ষার হিসেব? নাকি ঋণের?”
“হ্যাঁ ঋণই বটে, দৃষ্টিঋণ…” অতীন সামান্য উদাস হয়ে যায়।
“চলো অতীন গাজনতলায় ভিড় বাড়ছে। এই বেলা বেরিয়ে পড়ি। ওই শুনতে পাচ্ছ “ভদ্দেশ্বরো শিব মহাদেবও…”
পাচ্ছি তো। ঢাক বাজছে, ছম ছম ঘুঙুর পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সন্ন্যাসীর দল। গন্ধও পাচ্ছি। উঠোনে ভিয়েন বসেছে। বেণী ময়রা ‘পয়লা বৈশাখ’ ছাপ মেরে সন্দেশ গড়ছে। কড়াতে দুধ সাদা রসগোল্লা বগবগ করে ফুটছে। জনা কয়েক লোক নিমকির জন্য তাল তাল ময়দা ঠাসছে। বুধো মালি ঝুড়ি ঝুড়ি কাঁচা আম এনে জড়ো করেছে, আম পোড়ার শরবত হবে। বার মহলের নাচঘর সাফ-সুতরো করে ফরাস আর গালচে বিছানো হয়েছে। ঝাড়বাতিতে নতুন মোম বসছে। আজ লখনউ থেকে বাঈজি আসবে। রাতভর মুজরো হবে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। উদবাস্তু মানুষের ভিড়ে থিকথিক করছে শহর। চতুর্দিকে অভাব তবু বাবুয়ানির জাঁক দেখাতে বিলিতি মদের ফোয়ারা ছুটবে।
অতীনের ওদিকে যাওয়া নিষেধ ছিল। চাকর-বাকর পাহারা দিত। দূর থেকে তবলা, সারেঙ্গী আর নূপুরের বোল কানে আসত, বিছানায় শুয়ে শুয়ে অতীন শুনত। সেদিন মা কেমন যেন বদলে যেত। বছরে ওই একটা দিন, তবু… বিকেল থেকে বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত, চোখ আকাশের দিকে। এই এখন যেমন অতীন আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে।
ছেলেবেলায় অবশ্য নাচঘরের থেকে গাজনতলার আকর্ষণই বেশি ছিল। বন্ধু জুটিয়ে ছুটত অতীন। শিবতলায় তুমুল ভিড়, বাবার মাথায় ফুল চড়ছে, ঘটি ঘটি জল ঢালছে, গাজনের সন্ন্যাসীদের সে কী উল্লাস! বৈচির কাঁটা ফেলে ঝপাঝপ ঝাঁপ মারছে। জিভে বাণ ফুঁড়ছে, পিঠে লোহার কাঁটা ফুটিয়ে বাঁই বাঁই পাক খাচ্ছে। অতীন ভাবত ঈশ্বরের কী মহিমা! কিন্তু মানুষ যত বড় হয় ততই তার ভাবের জগত মিথ্যে আর শরীরটা সত্য হয়ে ওঠে। অতীনেরও তাই হল। গাজনতলা, কাঁটা ঝাঁপ, বাণ ফোঁড়ার থেকে ওই নাচঘরের আকর্ষণ অনেক বেশি সত্যি হয়ে উঠল।
সে বছর আর গাজনতলায় যায়নি অতীন। বর্ষারম্ভের জুলুসটাও ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছে। ব্যবসাটা পড়তির দিকে। ঋণ বাড়ছে। তবু নাচঘর সাজল। লখনউর রহিস বাঈজি আনার রেস্ত আর নেই। যে এল তার নাকি ঠাঁটও নেই, ঠমকও নেই। চাকর-বাকররাই সেসব বলাবলি করছিল। রাত বাড়লে অতীন বুঝল এই মেয়ের কিছু না থেকেও এক অদ্ভুত মরমী গলা আছে। “হাজারোঁ খোওয়াহিশে অ্যায়সে কি…” বার মহল থেকে ভেসে আসা সেই সুর অতীনের বুকে এসে ধাক্কা দিল। সারারাত সে জেগে রইল। বড় ইচ্ছে করছিল যে গাইছে একটিবারের জন্য তাকে দেখতে। ভোর হল। ঠাকুরঘরে হালখাতা পুজোর তোড়জোড় চলছে। মা সেদিকে ব্যস্ত। অতীন ধীরে ধীরে নেমে এল। বার মহলের দোর খোলাই ছিল, জাফরি কাটা দালান পেরিয়ে সে এসে দাঁড়াল নাচঘরের সামনে। ষোল বছরের অতীনের বুকে তখন রেসের ঘোড়া দৌড় দিচ্ছে যেন, বিন বিন ঘাম জমছে নাকের পাটায়। পেল্লায় নাচঘরের মাঝখানে হাঁটুর উপর থুতনি রেখে জড়সড় হয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। কতই বা বয়স হবে! অতীনেরই মতো। ডানা কাটা পরী নয়, বড়ই সাধারণ। ঘরের বাকি মানুষ মদের ঘোরে অচেতন। চিকের আড়ালে অতীনকে দেখতে পেয়ে মেয়েটি পায়ে পায়ে উঠে এল। ওর সফেদ নাচপোশাকে বড় বড় লালচে ছোপ। ফরাসটাও রক্তে লাল।
চিক সরিয়ে বাইরে এল মেয়েটি। দীঘল চোখ তুলে অতীনের দিকে সরাসরি চাইল। তারপর করুণ স্বরে বলল, “আমার তবিয়ৎ ভালো নেই, ঘর যাব।”
“ঘর? লখনউ?” অতীনের স্বরে বিস্ময়।
হাসল মেয়েটি, সেই হাসিতে বিষাদ মাখা। বলল, “নাহ, সোনাগাছি। এখন ওটাই ঘর। আগে লাহোরে থাকতাম। এইট পাস, পড়ি লিখখি গানেওয়ালি বেশ্যা।” মেয়েটার স্বরে তখন আলগা বিদ্রুপ।
“তুমি দাঁড়াও,” বলে একছুটে খাজাঞ্চিখানার দিকে দৌড় দেয় অতীন। লাগোয়া গুদামঘরে ডাঁই করা রেশমের গাঁটরি থেকে একখানা লাল রঙে ছোপানো থান এনে সেই মেয়েটির হাতে দিয়ে বলে “জড়িয়ে নাও, রিকশায় তুলে দিচ্ছি।”
মেয়েটির চোখ তখন জলে ভরে আসছে। বেশ্যার লাজ ঢাকতে কেই বা কাপড় দেয়? বুঁজে আসা গলায় ও অতীনকে শুক্রিয়া জানাল। তারপর বলল, “এ তো অনেক কিমতি কাপড়! এর দাম চোকাবো কেমন করে? দালাল পাওনা টাকা নিয়ে ভেগেছে।”
“না না দাম লাগবে না।”
“কর্জ থেকে গেল বাবু। আজ নতুন সালের পহেলা দিন, কেউ কর্জ রাখে না। আর আমি…
“বেশ, তবে গান শুনিয়ে যেও…”
“শুধু গান শুনবে বাবু তাহলেই কর্জ মাফ?” মেয়েটির গাল বেয়ে টুপটাপ জল ঝরে পড়ে। মুছে নিয়ে অতীনের চোখে চোখ রাখে। এই কর্জ আদা করতে একদিন ঠিক ফিরে আসব। ইয়ে রোশনি বাঈকা কা ওয়াদা।”
আরও পড়ুন- নসু মোড়লের বাদা: হামিরউদ্দিন মিদ্যা
টানারিকশাটা ঠুনঠুন ঘণ্টা বাজিয়ে আধো-অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তখন সবে শহরের ঘুম ভাঙছে। অপেক্ষাকে সঙ্গী করে সদরে দাঁড়িয়ে রইল অতীন। ভাবনাটা আর এগোলো না। জগার পায়ের আওয়াজ পেয়ে আরাম কেদারাটা বাস্তবে ফিরতে চাইছে। অতীনও ফিরল…
পুরনো বছরটা শেষ হয়ে গেল। সারারাত জেগে রইল অতীন, যেমন করে এতকাল জেগে এসেছে। যদি সেই সুর ভেসে আসে!
ভোর হলে নাচঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরের ছাদটা পড়ে গিয়েছে। সেই ফাটলধরা ছাদ থেকে নেমে আসছে ভোরের আলো, রোশনিই তো…
সেদিকে তাকিয়ে ভাঙা দালানে বসে রইল অতীন। ওদিকে খাজাঞ্চিখানার লাজ ঢাকতে নড়বড়ে দরজায় মোটা একটা তালা ঝুলছে। বার দেয়ালে লাট খাচ্ছে বহু পুরনো একটা ক্যালেন্ডার। অপেক্ষারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। বছর শুরুর দিনটাও আধবেলা পুরনো হয়ে এল। ঝুলতে থাকা ক্যালেন্ডারের ঠোঁটে তখন ফুটে উঠছে হাসির আভাস…
কাঁপা কাঁপা গলায় অতীন বিড় বিড় করছে- “হাজারোঁ খোওয়াহিশে অ্যায়সে কি হর খোওয়াহিশো পে দম নিকলে, বহুত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফির ভি কম নিকলে…”