মায়ের নাম জাবেল: স্বাতী গুহ
Bengali Short Story: জাবেলেরও তো অনেক সময় মনে হয়েছে – নিজের শরীরের নীচের দিকটা সে কেটে বাদ দিয়ে দেয়! কিংবা মাটিতে পুঁতে দিয়ে অহল্যার মেয়ে অঞ্জনার মতো কঠিন তপস্যা করে।
পেড়্রু বাড়ি ফেরেনি। দশ দিন হল। রোববার গির্জা থেকে ফিরে আর কেউ তাকে দেখেনি। অথচ পেড়্রু একা কোথাও যেতে পারে না। ওর পা দুটো এখনও নরম তুলতুলে। একটা কাঠের গাড়ি ছিল ওর। কিন্তু বড় হতে হতে সেটায় আর আঁটত না পেড়্রুর শরীরটা। ওর দুই দাদা। শক্ত সমর্থ। একেবারে ছোটোবেলায় দাদারা পেড়্রুকে বাড়ি ফিরে এসে গল্প বলত। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ওরা কত কী দেখেছে! কত খেলা, মারামারি! পেড়্রু কান খাঁড়া করে সব শুনত। ওদের পাড়াটা খ্রিস্টানদের। পেড়্রু ঘরে শুয়ে শুয়ে শুনত গির্জার ঘন্টা। ঢং ঢং শব্দটা ওকে অনেক কথা বলতে চাইত যেন। পেড়্রু চাইত মা এসে একবার ওর কাছে বসুক। কিন্তু মায়ের সময় ছিল না। নাকি মা ওকে দেখতে পারত না দু’চক্ষে! পুরো পাড়াতে একমাত্র পেড়্রু এমন একজন বাচ্চা, যে কোনোদিন হাঁটেনি, চলেনি। জাবেল মনে মনে বিশ্বাস করত, ওর পাপের জন্যই এমন বাচ্চা জন্মেছে। প্রথম আর দ্বিতীয় দু’টি সন্তানই ছেলে। অ্যান্থন আর লাজার। তৃতীয়বার গর্ভসঞ্চার হতেই জাবেল প্রতি রোববার গির্জার প্রার্থনায় একটিই কথা আওড়াত। মাথা ঠুকে ঠুকে শুধু চাইত ওর একটা মেয়ে হোক। যার নাম রাখবে নাতালিয়া। জাবেলের ঠাকুমার নাম ছিল ওটা। অসম্ভব সুন্দরী! দাদু অবশ্য একটুও ভালবাসত না ঠাকুমাকে। দাদুর বিশ্বাস ছিল নাতালিয়া খাঁটি পর্তুগিজ। কোঙ্কন উপকূলে তখনও সাহেবদের দিন পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। তবুও জাবেল চাইত ওর একটি মেয়ে হোক। অমন সুন্দরী। অমন টানাটানা চোখ আর চোয়ালের গড়ন! পাদ্রিবাবা কানে কানে বলেছিলেন – হবে। তোমার মনের ইচ্ছে অবশ্যই পূর্ণ হবে।
অ্যান্থন আর লাজার মায়ের কথা ভেবে খোঁজ করতে বেরিয়েছিল। কিন্তু ওরাও জানত, পেড়্রু একা তো এক পা-ও চলতে পারে না। তাহলে ও কীভাবে একা একা হারিয়ে যেতে পারে! নিশ্চয় কেউ একটা ওকে নিয়ে গেছে। কিন্তু কে নেবে পেড়্রুকে? একে দাঁড়াতে, চলতে পারে না। অ্যান্থনরা সারাদিন পাড়া বেড়িয়ে সন্ধ্যের মুখে বাড়ি ফিরে আসে। এসে দেখে, মাকে ঘিরে রয়েছে পাড়ার বুড়িরা। আর বাবাকে তখনও না দেখতে পেয়ে ভাবে – বাবা কি এখনও খুঁজছে পেড়্রুকে? কী দরকার ওকে খোঁজার? একটা আস্ত বোঝা! কে দেখবে ওকে? বাবা-মা যখন থাকবে না, তখন তো পেড়্রুকে ওরা সমুদ্রের জলে ফেলে আসবে; ভাবাই ছিল। এই বেশ হল! ও নিজে থেকে হারিয়ে গেছে। মা তখনও ভুস ভুস করে কাঁদছে আর বলছে –
‘মহাদেবের তপস্যা করলে পেড়্রুর পা ঠিক হয়ে যেত, বলেছিল দয়াতাই ভাদুর শিষ্য। আমি খুব হেসেছিলাম! খুব হাসি পেয়েছিল! তা-ই কান্না এল। আমি জানি পেড়্রুকে মহাদেব নিয়ে গেছে।’।
খ্রিষ্টানপাড়ায় রাম-বারণ, নেহাৎ অচেনা নয়। তবু বুড়িমা মুখ খুলছিল না। অ্যান্থন মাকে এসে জড়িয়ে ধরেছিল আচমকা। জাবেল চিৎকার করে বলে উঠেছিল –‘দূর হয়ে যা তোরা! যতক্ষণ না পেড়্রুকে খুঁজে পাস, তোরাও ফিরবি না।’ বুড়ি ক্যাবরাল এবার খিঁচিয়ে ওঠে – ‘গির্জায় মন নেই তোর। শুধু রাম-রাবণ আর মহাদেব-গৌরি! তোর ছেলেকে ওই হিঁদু দেবতাগুলোই নিল!’
জাবেল চোখের জল মুছে বলতে থাকে – ‘মেয়ে চেয়েছিলাম। পাদ্রিবাবা কাছে টেনে কত মন্ত্র আওড়ালো! সারা শরীরে হাত বোলালে বারবার। কিন্তু কোথায় নাতালিয়া! ছেলেটা হল পা ছাড়া!’
ক্যাবরাল চুপ। পুরো মহিলামহল চুপ। অ্যান্থন আর লাজারও চুপ। কোনও শব্দ নেই কারও মুখে। খসখস করে গোসাপটা পুরনো পাতা আর ঘাসের মধ্যে দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেল। একটা বোঁটকা গন্ধ। জাবেল দু’হাঁটুর ফাঁকে মুখ রেখে কী যেন ভাবতে থাকল। ভাবতেই থাকল। পড়শিরা একে একে ফিরে গেল। দুই ছেলেও কোথাও একটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে যেন!
জাবেল ছোটোবেলায় ঠাকুমার মুখে শুনেছিল পানগঙ্গা নদীর ধারে জম্বু নামে একটা রাজ্য ছিল। সেখানকার রাজা ছিলেন একজন মালী। শুনতে শুনতে ছোট্ট জাবেল খিলখিল করে হেসে উঠত! ঠাকুমার দিকে মুখ তুলে চেয়ে বলত – ‘মালী কখনও রাজা হয়?’
‘হয়, হয়’- ঠাকুমার গলা আরও সুরেলা হয়ে উঠত। তারপর গল্প গড়াত ব্যাঙ কন্যার পেট থেকে খসে পড়া আশ্চর্য জাদুর কথায়। গাছে গাছে ফুল ফুটে ওঠার গল্প বলার সময় ঠাকুমার চোখে কেমন নীলাভ আলো জ্বলে উঠত। নাতনীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে ঠাকুমা বলে চলত জম্বু রাজার মেয়ে সীতার গল্প। জাবেল ভাবত, তার নাম সীতা হলে বেশ হত! কিন্তু সেই কবে যেন ওদের ঠাকুরদা না তার বাবারা নাম-টাম সব বদলে ফেলল। ঠাকুমার কাছে শুনেছে, আগে ওরা সবাই একটা গ্রামে থাকত। তারপর আস্তে আস্তে পাড়া হল। ভাঙ্গিদের পাড়াটা ওদের পাড়ার সব চেয়ে কাছে। ওই পাড়াটা একটু একটু করে গির্জার ধারেকাছে চলে আসছে। ওরা এখন মালীর কাজ করে। রোববারের প্রার্থনায় একেবারে পিছনের সারিতে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু পেড়্রুকে কীভাবে খুঁজে পাবে সে? ঠাকুমার মা নাকি তার মা বলত সেসব গল্পকথা। আখতিজের দিন গৌরি উদযাপনের গল্প বলত ঠাকুমা। জম্বুর মেয়ে সীতাকে কীভাবে জনক ভুলিয়ে নিয়ে গেল, সেসব গল্প যেন আলো-আঁধারের ছায়াবাজি। গির্জার ছাদের যে ছবিগুলো পরীরা এঁকে দিয়ে গিয়েছিল সেই কোন দূর দেশ থেকে এসে, সীতা কি তবে সেই দেশে চলে গিয়েছিল? পেড়্রু…পেড়্রু – নাম ধরে সহসা চিৎকার করে ওঠে জাবেল। ঘুম ভেঙে টের পায়, অনেক রাত তখন। একটি মাত্র ঢং শুনতে পায় সে।
খুব তেষ্টা পায় জাবেলের। কাঠ হয়ে গেছে গলার নলী। পেড়্রু কিছু খায়নি সারাদিন। মা হয়ে কীভাবে খাবে সে! ইচ্ছে করছিল গির্জার লনে শুয়ে থাকতে। ছোটোবেলায় ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে সাজাতে কীভাবে ঘুমিয়ে পড়ত ওরা ভাই-বোনেরা। খোলা আকাশের নীচে। ঠান্ডা লেগে গলা ফুলে উঠত এক-একবার। লাল রঙের মিষ্টি মিষ্টি সিরাপের এক এক ঢোক গলার ভিতরে ঢেলে দিত মা। জাবেল চোখ বুঁজে দেখত সেই ফ্রেসকোগুলো। সুন্দর রঙের পরতে পরতে কত যে যুদ্ধের আর হিংসার কথকতা! এখন মনে পড়ল কেন ওর? পেড়্রু কি ওই যুদ্ধে গেল? ও কীভাবে যেতে পারে? কে? কে নিয়ে যেতে পারে ওকে? ধবলগিরির মহাদেব? ধুর ধুর! তা কী করে সম্ভব? আবার ঘণ্টা বাজল। এবার ঢং ঢং। দু’বার। অ্যান্থন আর লাজারের নাম ধরে জোরে চিৎকার করে ওঠে জাবেল। রাতের অন্ধকার দেওয়ালে সেই ডাক প্রতিধ্বনি হতে হতে এগিয়ে চলে কোথাও একটা। ঘুমের গভীর থেকে জেগে উঠে আকাশের নীচে এসে দাঁড়ায় সে। হলুদ সর্ষেখেত আর হাওয়াদের খেলা চোখে সেঁটে যায়। দু’চোখ বেয়ে ধারা নেমে আসে জাবেলের। পেড়্রু হারিয়ে গেছে। আর কী সে ফিরবে কোনওদিন? লং টিউনিকের নীচের ফ্রিল মুচড়ে চোখের জল মুছে নেয় সে। নীলগিরি পাহাড়ের টোডাদের কন্ঠনাদ শুনতে পায় যেন। পাহাড়ের গায়ের ঝর্নাগুলোর নেমে আসার শব্দ কানে বাজে। জাবেল বাঁশের দরজাটা খুলে বেড়িয়ে পড়ে। নিশুত রাত। কিন্তু কে যেন তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। কোথায় যাবে সে জানে না। কিন্তু যাবেই। পেড়্রুকে যতটা ঘৃণা করেছে এতকাল, সবটা যেন ওর বুকের পাঁজর দুমড়ে-মুচড়ে বেরিয়ে পড়তে চাইছে রাতের আকাশে তারাদের সাক্ষী রেখে। আবার সে চিৎকার করে ওঠে – পেড়্রু, পেড়্রু… কোথায় গেলি বাপ? সীতার গল্প শোনাবো তোকে। ফিরে আয়। রুকমাঈ আর বাসুদেবের গল্প বলবো তোকে। শ্রাবণের কথা। না । না । ওর কথা বলবো না। লুকিয়ে রাখবো। ছেলের মৃত্যুর কথা কীভাবে শোনাই তোকে। মা, মা তো শুধু জন্মের কথা বলে! ফিরে আয় পেড়্রু। তোকে তোর জন্মকথা শোনাবো।
আরও পড়ুন: আয়না ভবন : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
রাত পেরিয়ে দিন। আবার দিন পেরিয়ে রাত। গির্জার মাঠের ঘাসগুলিকে কেমন কুশের মতো লাগে পায়ে। অথচ এখানে তো দূর্বা ঘাসের নরম বিছানা ছিল। পেড়্রু হারিয়ে গিয়ে কি সব বদলে গেল! কিন্তু জাবেল ঠিক করতে পারে না, এই কুশ দিয়ে সে কার মুণ্ডচ্ছেদ করতে পারে! ঠাকুমা যে বলত, বিষ্ণুর চক্র আর এই কুশ নাকি এক ধরনের অস্ত্র। অমৃত পেতে হবে কি তবে তাঁকে? কাকে জিজ্ঞাসা করবে সে? পাদ্রীবাবা তো কিছুই বলেন না আর। জাবেলের মুখের দিকেও তিনি ভালো করে তাকাননি পেড়্রুর জন্মের পর থেকে। পেড়্রুর পা বিহীন শরীরে খ্রিস্টনাম জপে দিতে দিতে ওর চোখ থেকে জল নেমেছিল গড়িয়ে। কিন্তু জাবেল একেবারে চুপ করেছিল পুরো সময়টা। ওঁর চোখে যে আগুনটা দেখেছিল পাদ্রিবাবা, তাতেই কি ভয় পেয়েছিলেন! গাউনের ঢাকনা এক ঝটকায় একবার মাত্র সরিয়ে সবার সামনে ছোট পেড়্রুর ছোট্ট লিঙ্গ আর তার নীচের এক বিঘৎ থলথলে মাংস না মাসল্ নগ্ন করে বলে উঠেছিলেন – ‘ঈশ্বর…গড…জেসাস্…সেভ হিম্! সেভ মি! সেভ আস্…!’
দলা দলা কান্না উঠে আসছিল ওঁর প্রার্থনা-পোষিত গম্ভীর আওয়াজে। সেদিন কিন্তু জাবেল কাঁদেনি। একবারও না। সেই প্রার্থনাসভায় লোকজন বেশ অবাক হয়েছিল! কেউ বুঝতে পারছিল না। জাবেল কি শোকে পাথর হয়ে গেছে? জাবেল শুধু বিড়বিড় করছিল – ‘বিষ্ণুর চক্রে ধ্বংস হয়েছিল দানব, কারণ তার অমৃতে অধিকার স্বীকার করেননি দেবতারা। আর নাগেরা যখন সেই অমৃত গরুড়ের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল তখন কুশ তাদের জিভ চিরে দু-ভাগ করে দিয়েছিল’। কিন্তু সেই রাতে কে ছিল তার সেই ক্রোধকে ধারণ করার জন্য? কে ছিল জাবেলকে শান্ত করার মতো! হেঁটে যেতে যেতে শুধু বলেছিল সে – ‘ডোম জন্মায় অড়হরের ক্ষেতে … মাথার ওপর কোনও ছাদ ছাড়াই সে বাঁচে…’ নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করছিল না সে। চোখকেও না। তবুও হাঁটছিল। রাত ফিকে হয়ে আসছিল। পেড়্রুর মা হেঁটে চলছে তখনও!
তখনও চন্ডাল ও শ্বপচ জাতির মানুষ থাকত গ্রামের বাইরে। না ছিল জমি-জমা। সম্পদ বলতে কুকুর আর গাধা। এরাই কি তবে ডোমদের পূর্বসূরী? নাতালিয়া তার দাদু-ঠাকুমার যে গল্প শুনেছিল তার মায়ের কাছে, মাসীর কাছে। তারা পরত শববস্ত্র। লোহার অলংকার। খাবার খেত ভাঙাপাত্রে। তাই তো গির্জার পাদ্রিবাবারা ওদের কাছে টেনে নিল। ওদের নাম বদলে গেল। বদলে গেল বসত। বদলে গেল খাওয়া-দাওয়া। আস্তে আস্তে ওদের অনেকের ঘরে আলো করে এল সুন্দর শিশুরা। তারা সবাই নাকি যিশুর উপহার! ঘরে ঘরে যিশুর ছবির সামনে লাল ছোটো আলো আর তাকে ঘিরে ছোটো ছোটো হলুদ আলোর মালা। নাতালিয়ার চোখ গাঢ় সবুজ রং-এর। জাবেল এখনও চোখ বুঝলে দেখতে পায় সেই টলটলে দৃষ্টি ! ওর দাদুদের বাড়ির লোকজনরা নাকি আগে ছিল দোসাদ। যাযাবরদের মতো ঘুরে ঘুরে এর ওর জমি চাষ করত। প্রায়ই পাওনা মিলত না। জমিদারের বাড়ির বাইরের দাওয়ায় পর্যন্ত উঠতে পারত না ওঁরা। তাই যিশু যেন সাগর পেরিয়ে এসে কিছুটা মুক্তি দিল! কিন্তু সত্যি কি দিল? এইসব ভাবনা কি সত্যি আজও জাবেল কে ভাবায়! জাবেল হাঁটে। হাঁটতে থাকে। ভোররাতের আকাশে আবছা সাদাটে হয়ে আসা চাঁদের শরীর দেখে মনে পড়ে, চাঁদ আর সূর্যর সেই ঋষি গৌতমের বাড়ির পিছনে লুকিয়ে থেকে অহল্যাকে ছলনায় ভোগ করার গল্প। ঠাকুমাকে জাবেল অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে – ‘তুমি এসব কীভাবে জানলে?’ নাতালিয়া বলতেন – ‘ছোটোবেলা থেকে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়াত তার মা।’ আর একটু বড় হয়ে সাহস করে একদিন জাবেল জিজ্ঞাসা করছিল – ‘তুমিই কি সেই অহল্যা?’
নাতালিয়া সঙ্গে সঙ্গে কানে আঙুল দিয়ে বলেছিল, ‘এসব বলতে নেই। ওঁরা দেব-দেবতা!’
‘তাহলে ওঁরা কেন খারাপ লোকেদের শাস্তি দিত না?’ জাবেলের সটান প্রশ্ন।
সে শুনেছিল অহল্যা কীভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাথরের মূর্তি যেন সে। জাবেল জানে মেয়েরা পাথর হলে কেমন হয়! কেমন ভারি হয়ে ওঠে তাঁদের শরীর, মন। জাবেলেরও তো অনেক সময় মনে হয়েছে – নিজের শরীরের নীচের দিকটা সে কেটে বাদ দিয়ে দেয়! কিংবা মাটিতে পুঁতে দিয়ে অহল্যার মেয়ে অঞ্জনার মতো কঠিন তপস্যা করে সে। কিন্তু তাই কি আজ ভোর ভোর সূর্যের নতুন আলোর দিকে তাকিয়ে তাঁর গা গুলিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে অনেকটা বমি করে ফেলতে! শরীরের ভিতরে জমে থাকা বিষ বের করে দিতে পারলে বাঁচত যেন জাবেল। পেড়্রুকে কি তবে গির্জার ভিতরে কোথাও নিয়ে গেল কেউ? না। তা কী করে হবে? প্রার্থনার মন্ত্র উচ্চারণের সময় তো জাবেল এত বছর হল চোখে চোখ রাখে। যিশুকে সে আর ভালবাসতে পারে না। সেই কবে থেকে। যিশুর মূর্তির পায়ের দিকে তাকালে কেমন মনে হয়, কোনো একটা হত্যার ষড়যন্ত্র শুধু চারিদিকে। জাবেলও কাউকে হত্যা করতে চাইত! কাকে? পেড়্রুকে? পাদ্রিবাবাকে? না নিজেকে?
আরও পড়ুন: মায়াজাল : সোমক রায়চৌধুরী
হঠাৎ ওর মনে পড়ে অ্যান্থন আর লাজারের কথা। আহা! ওদের মুখের ছবি ভোরের আলোয় কেমন ঘুমন্ত দেখায়। অ্যান্থন তো ফুলের মতো ছিল। দু'বছরের ছোটো লাজার ঈশ্বরের কৃপায়ই তো সে বার বেঁচে গিয়েছিল কালাজ্বর থেকে। তখন পেড়্রু কোথায়? দু'টি ফুলের মতো ছেলে। বাগান, গির্জার কাজ আর পছন্দমতো খাবার তৈরি করা। মিগুয়েল তখনও এখানেই ছিল। তারপর কী যে হল! কোথায় চলে গেল একদিন সকাল বেলা উঠে। বলেছিল ফিরবে। এখনও হয়তো সময় হয়নি! তাই কি ওকে একা একা পেড়্রুকে খুঁজতে বেরোতে হল? কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা খিদেয় পেটের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে ওর। সামনে নদীটায় জল বড় কম। নদীর নুড়ি পাথরগুলো ভিজে শরীর রোদে মেলে দেবে বলে অপেক্ষা করছে।
তবে কি জাবেলও অঞ্জনার মতো এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছে যে লঙ্কাকাণ্ড করে ছাড়তে পারে। সামনের নদীটা পেরোলেই কি সিংহল? রাবণরাজার বাস! গির্জার চূড়োটা আর দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি অনেকটা দূরে চলে এসেছে সে! এতটা দূর, যেখান থেকে পিছনে তাকালে কিছুই চোখে পড়ে না। তাহলে কি ও পেড়্রুর কাছে পৌঁছে যাবে একটু পরেই! পেড়্রু কি আসলে পবনপুত্র হনুমানের মতো? কিন্তু কেকৌচালা কি এখনও তেমনই হিংসুটে আছেন? যুদ্ধ না বাঁধিয়ে থামবে না সময়ের গতি। জাবেল নিজের হাত-পা, নখ-চোখ-কান বারবার হাত বুলিয়ে দেখে। সেই কি জাবেল? বাবা আদর করে তার নাম রেখেছিল। বাবার ঠাকুমার নাম ছিল ইসাবেল। তাই বাবা ঈশ্বরের নামে শপথ করে জাবেলকে বড় ভালোবেসে বড় করেছিলেন। কিন্তু এক পেড়্রু তো সব বদলে দিয়েছিল। নাকি ওই গির্জার ভিতরের চাপ চাপ অন্ধকারগুলো!
জাবেল আস্তে আস্তে নদীর খাতের দিকে পা বাড়ায়। সন্তান নিখোঁজ হওয়ার পরই কি সে নতুন শক্তি ফিরে পেল? মনে হল সে দেবতাদের সঙ্গেও লড়ে যেতে পারে।