পোলিং পার্টি ১৩৫ : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

Bengali Short Story: বিকাশ মদ খায় না, গ্রামার পড়ে। দিঘিপুরেই ঠিক হয়, ভোট শেষ হওয়ার আগেই বিকাশকে পতাকা বানানো হবে।

আর মাত্র দু'বছর। তারপরেই অবসর। যদিও অবসর শুনলেই বিকাশবাবুর মন খারাপ হয়ে যায়। অবসর বলে সত্যিই কি কিছু হয়! কত রকমের কাজ ছড়িয়েই থাকে। পড়ানো কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না। কিছু না কিছু ভাবে বিকাশবাবু পড়াতে চান। একই গ্রামার বই বিকাশবাবু কতবার যে পড়েছেন। কতবার যে সেই বইগুলোর ভুল খুঁজে বার করেন আর পাবলিশারকে চিঠি লেখেন। বইয়ে যেমন লেখা থাকে সেভাবে গ্রামার শেখানো যায় না। 'ক্রিয়ার অতীতকাল হলে ভার্বের পাস্ট ফর্ম ব্যবহার হয়', এভাবে লিখলে বাচ্চারা কিচ্ছু বুঝতে পারে না। 'ক্রিয়ার কাল' ব্যাপারটাই তো ওরা ধরতে পারে না। বিকাশবাবু অন্যরকমভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন। যে ভাষায় বাচ্চারা কথা বলে তেমন কিছু। এ এক নেশার মতো। যখন দশটা ভুল করার পরে এগারোবারের বেলা ওরা ঠিক উত্তর দেয়, বিকাশবাবুর সে এক আলাদা আনন্দ! চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গত তিরিশ বছর ধরে সেই আলো কমেনি। যদিও চোখের অপারেশন হয়েছে, চশমার পাওয়ার বেড়েছে; তবু বিকাশবাবু ওই আলোতেই একই গ্রামার বই আবার পড়েন। 

যখন ভোটের ডিউটির চিঠি এল, বিকাশবাবু একবার ভেবেছিলেন অন্তত একটা গ্রামার বই সঙ্গে নিয়ে যাবেন। কিন্তু মালতী এমন চিৎকার চেঁচামেচি করল যে বাধ্য হয়েই বইটা আর নেওয়া হলো না। মালতী তো এবার বিকাশবাবুকে ডিউটিতে যেতেই নিষেধ করেছিল। বারবার বলেছিল, "তোমার যে ছাত্র বিডিও না ডিএম কী বেশ হয়েছে তাকে বলো না এবারে কোনওভাবে ম্যানেজ করে দিতে।" কিন্তু এসব বিকাশবাবুর একেবারেই ভালো লাগে না। নিজের ছাত্রকে কেউ এভাবে বলতে পারে? তারপর যদি সে কথা না রাখে কত লজ্জার ব্যাপার! এমনিতেও আর তো মাত্র দু'বছর। কত ডিউটি করেছেন বিকাশবাবু। কত প্রশংসা পেয়েছেন। দশ বারো বছর আগে এক লোকসভা ইলেকশনে সেক্টর অফিসের ওই ভদ্রলোক বলেছিলেন, "মাস্টারমশাই, আপনাকে মিষ্টি খাওয়াব। এত ভালো, এত নিখুঁত কাজ কেউ করতে পারেননি।" বিকাশবাবু সেই গর্ব এখনও শোনান সবাইকে। এমন কত অভিজ্ঞতা আছে। আর চাকরির শেষ জীবনে এসে এইসব একে ধরে তাকে ধরে একটা সামান্য ভোটের ডিউটি ক্যানসেল করার কোনও মানেই হয় না। আর এমনিতে ট্রেনিংয়ে গিয়ে তাঁর ১৩৫ নম্বর পার্টির বাকিদের সঙ্গেও আলাপ পরিচয় হয়েই গেছে। সবাই-ই কম বয়সি। কম বয়সি টিচারদের নিয়ে বিকাশবাবু খুব একটা খুশি নন যদিও। এরা ঠিকঠাক পড়াতে পারে না। বাচ্চাদের গুডমর্নিং স্যার আর থ্যাংক ইউ স্যার শেখলেই ইংরেজি শেখানো হয় না। ঋভুস্যার, মানে ওই নতুন ছেলেটা, বাচ্চাদের রিডিং অব্দি পড়ায় না! বিকাশবাবু বলেছিলেন একবার। ঋভু বলেছিল, "ও স্যার, ওরা এমনিতেও শিখবে না, ওমনিতেও না। কী দরকার শুধু শুধু। ইউনিটে নম্বর দিয়ে দেব।" তারপর থেকে আর কথা বাড়াননি বিকাশবাবু। ঋভুস্যার না এলে, বিকাশবাবু নিজেই ওই ক্লাসে গিয়ে রিডিং শেখান। ব্রিটিশ উচ্চারণ আর আমেরিকার উচ্চারণের পার্থক্য বোঝান। বোঝাতে বোঝাতে ভূগোলে চলে যান, ইতিহাসে চলে যান। আমেরিকা কী করে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল সেই কথা বলেন। বাচ্চারা শোনে না। ছবি আঁকে, কথা বলে। তবু বিকাশবাবু বলতে থাকেন। ঘণ্টা না পড়া অব্দি বলে যান।

আরও পড়ুন- আয়না ভবন : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

সে যাই হোক, এই পোলিং পার্টি ১৩৫-এর কম বয়সিরা কেমন সেটা তো আর এখন জানা যাবে না। একেবারে বুথে গিয়েই জানা যাবে। কে কেমন কাজ করে সেটা কাজ শুরু না হলে বোঝার উপায় নেই। আর কাজ করবেই বা কখন? সব সময় তো ফোন ঠেলছে। বিকাশবাবুর ওই সব বালাই একেবারেই নেই। সেই জন্যই গ্রামার বইটা আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই যে মালতী! গোটা ব্যাগ ভর্তি ছাতু, মুড়ি, বিস্কুট, কেক, গামছা, গেঞ্জি, প্যান্ট এবং ওষুধ। বই ঢোকানোর জায়গা কোথায়? অবশ্য ভালোই হয়েছে বইটা আনা হয়নি। কাল রাতে সেন্টার থেকে বুথে আসতে আসতেই প্রায় রাত ন'টা বেজে গেছিল। কাজকর্ম সেরে সব গুছিয়ে একটু শুতে শুতেই রাত বারোটা। এই গ্রামটা এমনিতে ভালোই। দিঘিপুর। নামটাও কী সুন্দর। দিঘিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত। আহা। লোকজনের তো তুলনা হয় না। তিন চারটে ছেলে তো কাল প্রণাম অব্দি করে গেল। শহরে এসবের পাট চুকে গেছে এখন। গ্রামের দিকে মানুষ এখনও ভালোবাসতে জানে, শ্রদ্ধা করতে জানে। কিন্তু আজ আর রাত করা যাবে না। দুটো হাইবেঞ্চ একসঙ্গে করে চাদর পেতে বিকাশবাবু শুয়ে পড়েন।

তারপরের ঘটনা সামান্য। এতই সামান্য যে না বললেও হয়। কিন্তু ওই বিকাশবাবুর তাড়াতেই বলতে হচ্ছে। তিনি আবার কাজ অর্ধেক করে রাখা পছন্দ করেন না। বয়স হলে মানুষ যে এত খিটখিটে কেন হয়ে যায় কে জানে! সবাই-ই জানে এরপরে কী হয়েছিল, তবু বলতে হবেই। তেমন কিছুই না। ভোটের দিন প্রায় শেষবেলায় ওই বুথেই পিকনিক হয়েছিল। সবাই ওই একটু আনন্দ করতে চায়। বিকাশের নিষেধ কেউই শোনেনি। এমনকী সেই প্রণাম করে যাওয়া ছেলেগুলো মদের বোতল নিয়ে এসে বিকাশকে বলেছিল, "এই মাস্টার একটু হবে নাকি? দু' ঢোক?" বিকাশ বিরক্ত হয়ে মুখ সরিয়ে নিয়েছিল। বাকি ছেলেগুলো মদ খেয়ে ফুটবল খেলতে শুরু করেছিল। একজন আবার দেখাচ্ছিল কী ভাবে সে উড়ে উড়ে হেড করতে পারে। তাদের পায়ে সব পেরেক লাগানো জুতো। কয়েকটা ছেলে একটু দূরে মাটি খুঁড়ছিল। ওখানে নাকি স্টেজ বেঁধে ফাংশান হবে। বিকাশ বুঝতে পারে না এটা কী করে সম্ভব! ভোটের কাজ তখনও বাকি। প্রচুর লোক দূর দূরান্ত থেকে দিঘিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে আসছে ভোট দিতে। কেউ কেউ অবশ্য বিকাশকেও দেখতে আসছে। বিকাশ বলেছিল, "এভাবে তোমরা করতে পারো না, এটা ঠিক নয়, শোনো আমার কিন্তু আর মাত্র দু'বছর। কাগজপত্র ঠিক রাখতে হবে।" বাচ্চারা খুব হেসেছিল বিকাশের কথা শুনে। বাচ্চাদের হাতে কাঁচি ছিল। তারা এসেছে ভোটের কাগজ কাটতে। রঙিন ব্যালট। বিকাশ একবার শুনেছিল, বাচ্চাদের হাতে কাঁচি এবং কাটার মতো বাজে কাগজ দিলে বাচ্চারা নিজের আনন্দে কাগজ কাটতে থাকে। এভাবেই বাচ্চারা নতুন নতুন জিনিস বানাতে শেখে। কিন্তু এই ব্যালটগুলো তো কাটতে নিষেধ করেছে মালতী। বারবার বলেছে, "রঙিন কাগজগুলো বাড়িতে নিয়ে এসো। বড় বৌমা বলেছে দিদুনের হোমওয়ার্ক করতে কাজে লাগবে।" কিন্তু বাচ্চারা যদি কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়? আর সেই সেক্টর অফিসের ভদ্রলোকই বা কী বলবেন? তিনিও তো কিছু কাগজ চেয়েছেন। বারবার অনুরোধ করেছেন, "স্যার কিছু ব্যালট আমার জন্য নিয়ে আসবেন। ঘর সাজাতে দরকার।" কিন্তু সব কাগজ যদি বাচ্চারা কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়? বিকাশের তো আর মাত্র দু'বছর।

আরও পড়ুন- লুকিয়ে থাকা রুটম্যাপ: সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

দিঘিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের লোকজনের কিন্তু বিকাশকে খুব পছন্দ হয়েছে। বিকাশ মদ খায় না, গ্রামার পড়ে। দিঘিপুরেই ঠিক হয়, ভোট শেষ হওয়ার আগেই বিকাশকে পতাকা বানানো হবে। ভোট শেষ হয়ে গেলে তো বিকাশকে আর পাওয়া যাবে না। ওর তো আর মাত্র দু'বছর। তার আগেই বিকাশকে পতাকা বানিয়ে স্কুলের সামনে টাঙিয়ে রাখা হবে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সব নিজেদের বাগানের সব থেকে লম্বা লাঠি বা বাঁশ বা রড নিয়ে ছুটে আসে। হাসমত মিস্ত্রি তার মাপার ফিতে দিয়ে দেখে নেয় কোনটা সব থেকে লম্বা, যাতে পাশের গ্রাম থেকেও পতাকা দেখা যায়। হাসমত মাপতে দেরি করছিল বলে সবাই খুবই বকাবকি করল ওকে।

ভোট শেষ হতে আর মাত্র দশ মিনিট। বিকাশকে ধরে নিয়ে আসা হলো। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হলেও শেষে বিকাশও খুব একটা আপত্তি করেনি। যত তাড়াতাড়ি কাজ মেটে ততই ভালো। নাহলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাড়াতাড়িই বিকাশের হাত এবং পা পিছমোড়া করে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে লম্বা করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। না না, খুব একটা লাগেনি যদিও। চশমাটা খুলে পড়ে গেল, এটুকুই। সে আর কী করা যাবে। সবাই আনন্দ করছে। এটুকু তো হবেই। বাঁশে বাঁধা বিকাশের জামা কাপড় উড়ছে হাওয়ায়। বিকাশ নিজেও উড়ছে। পতপত করে ১৩৫ নম্বর পোলিং পার্টির বিকাশ হালদার উড়ছে। সবাই নীচে দাঁড়িয়ে বিকাশ হালদারকে স্যালুট করছে। ওই তো বিকাশের পুরোনো ছাত্র অনিল। বিকাশকে স্যালুট করছে। অনিল এখন ডিএম হয়েছে। অনিলই সবাইকে বোঝাচ্ছে বিকাশ কী সুন্দর করে গ্রামার বোঝাতে পারত। অনিল খুবই ভাল ছাত্র ছিল। খালি সিম্পল সেন্টেন্স আর কমপ্লেক্স সেন্টেন্সটা ও একটু গুলিয়ে ফেলত। তবে তাড়াতাড়িই শিখে নিয়েছিল। শিখবে না মানে! বিকাশ গ্রামারের জাদু জানে। আর মাত্র দু'বছর। মাত্র দু'বছর এই পতাকার মতো পতপত করে ওড়ার কাজ। দিঘিপুর আনন্দে টগবগ করছে। নীচে স্টেজ বাঁধা কমপ্লিট। গানের দলও চলে এসেছে। আজ থেকেই পনেরোই অগাস্টের প্রস্তুতি। সবাই ওপরের দিকে তাকিয়ে বিকাশ হালদারকে স্যালুট করছে। বিকাশের চোখে জল। গ্রামার জানতো বলেই না আজ এই সম্মান। নীচে এতক্ষণে গান শুরু হয়ে গেছে। ভেঙেছ দুয়ার, এসেছো জ্যোতির্ময়।

 

More Articles