গর্ভপ্রেত : অভিষেক ঝা
Bengali Short Story: লতিফ তো টেরই পায়নি গেঁড়িটা তাদের সাথে সাথে আসছে। বেটিকে কবরে শুইয়ে খানিক এগোতেই পিছনে ভুউউস ভুউউস করে কীসের আওয়াজ? মনের ভুল তো না, লতিফও থেমেছে। দঅঅঅপ শব্দে আলো জ্বলে ওঠে।
এই আমবাগানটার দেখভাল শুকরু হক করে আসছে তিন-পুরুষ। সমারু আর রইসুনের মরার পর যখন আলো- জল- বাতাসের মত নিয়ম মেনেই শুকরু খাসমহলের এই বাগানের সাথে জুড়ে গেল, সেদিনের বিকেলটা শুরা লাগা খেসারির ডালের রঙ ছড়াচ্ছিল। ঠিক আজকে যেমন। খেসারির ডালের ফ্যাকাসে হলুদকে শুরা পোকা আস্তে আস্তে শুধুই ফ্যাকসা করে ছাড়ে। হলদেটে ভাবের কোনও চিহ্ন থাকে না আর। শুরাগুলোকে সরিয়ে ছাঁকতে হয় ডাল। থেকে যায় তবু দু-চারটা চোখ এড়িয়ে। শুরার বু উঠে এল আজ ডালে শেষ চুমুক দিতেই। শুকায়ে আসা গমের মতো একটা বু। ল্যাটল্যাটে আঠালো। পিছু ছাড়তে নাছোড়। কাল রাতের বু। গা গুলিয়ে ওঠে তার। খেঁকিয়ে ওঠে। “আঁখেমে ভুঁয়া লাগলেছে...” , বাকি কথাগুলিতে বমির ওয়াক ওয়াক আর হড়হড় লেগে যাওয়ায় লতিফের বিবি শুনতে পায় না আর। কলাইয়ের থালা জুড়ে কিছুক্ষণ আগের থুতু মাখতে মাখতে নামা ভাদোই চালের ভাত, আলুপিঁয়াজ ভাজি, খুবই সোহাগ নিয়ে জিভ ছেড়ে না যেতে চাওয়া ছোলার শাক সব বের হয়ে আসে। বমির দিকে তাকিয়ে ফের একপ্রস্থ বমি। নাক দিয়ে বেরিয়ে আসা ভাপ লেগে থাকা ভেজা ভাত ঠোঁটের উপরে এসে থামে। থুঃ করে ফেলে দেয় বহু পথ ঘুরে আসা ভাতের দানাটিকে। মুখ ধোয়। বিছানায় গিয়ে শোয়। গন্ধটা আবার আসছে। বেটিকে নিয়ে আসে ঘরে। বুকে জড়ায়ে শুয়ে পড়ে। বেটি গল্প শুনতে চায়। বেটির চুলের বাস নিতে নিতে নিদ লাগে শুকরুর। আজকের রোজের ফজরের নমাজ এখান থেকে ঠিক কতখানি দূর?
চান করে, কড়কড়া লাটিম লুঙ্গি পরে শুকরু এসেছিল সতীশ উপাধ্যায়ের দালানে সেইদিন। বসে আছে চক-মিলানো বারান্দার এক কোণে। প্রতিবারের মত একটা কোণ ভাঙা চিনামাটির প্লেটে একটা কেকের টুকরা আসে। আর ডাঁটি ভাঙা কাপে চা। শুকরু জানে এটা বড়দিনের কেক। ছোটবেলা থেকে এই বাড়িতে আসে সে । চক-মিলানো বারান্দার আরেক কোণে আব্দুল রউফ আর সতীশ চন্দ্র উপাধ্যায় চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। আসরের নমাজের সময় হয়ে এসেছে। পাশের দালানের ছাদে সতীশ উপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের দুই ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করছে। দ্বিতীয় পক্ষ বাঁজা। লোকে বলে টাকার জন্য এরকম যোধাইনকে বিহা করেছেন সতীশবাবু। এত ধিঙ্গি হয়ে গেলেও মেয়ের বিহা কেন দিচ্ছেন না সতীশ বাবু?কেকে কামড় দেওয়ার আগে মনে আসে তার। রউফ আর উপাধ্যায় যে বিষয় নিয়ে ইষৎ দুঃখ পেয়ে বৈকালিক চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন তার কোনওকিছুই শুকরু বুঝে উঠতে পারছিল না। সে জানে এসব সময় শুকরুদের মুখ মির্জা আর বাভণদের মুখ দেখে ঠিক করে নিতে হয়। তার বড়দাদা সমারু শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল তাকে। এই সমস্ত বাড়িতে পা দেওয়ার আগেই। তাই সে গম্ভীর মুখে কেক খেতে শুরু করেছিল। “দেশের স্বাধীনতার এত বড় মূল্য দিতে হবে জানলে তোমার গ্র্যাণ্ডফাদার কি কংগ্রেসকে খিলাফতের সময় থেকে ব্যাক করতো হে সতীশ!”, চায়ে আবার ডুব দেন রউফ। চায়ের ভিতরে একটি জাপানি মেয়ের মুখ ডুবে আছে। “এইসব আর ভেবে কী হবে? সার্ভাইভাল স্ট্র্যাটেজি নাও”, জাপানি মেয়েটির মুখ থেকে সূর্যের সমস্ত রঙ নিজের ভিতর চালান করে দিলেন সতীশ। রউফ জাপানি মেয়েটির মুখ গাঢ় হয়ে আসা সূর্যের রঙে ভরলেন আবার। “তাহলে ক্রোক আটকাবার উপায় একমাত্র ডিভাইড?”
আরও পড়ুন: গাঙ্গেয় : অভিষেক ঝা
“উই শুড বি থ্যাংকফুল টু আওয়ার পেরেন্টস ফর দেয়ার ফার্টিলিটি রউফ। আজ তোমার আমার সাতটি করে ভাই না থাকলে জমি আর বাগানও চলে যেত অনেক”। সতীশের গলায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়ার ছায়া। “সে তো বটেই কিন্তু এই যে এত অ্যান্টিকস! ইট’স অ্যাবাউট টেস্ট সতীশ। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগবে না? এইগুলো ছাড়া বাড়িতে কাটাতে হবে পুরো একটা জীবন। বাড়িটা খুব অচেনা ঠেকবে আমার।” রউফ জানেন, কিছুই আটকাতে পারবেন না তবু বলে চলেন। “বাদ দাও। নয়া যুগ; নয়া টেস্ট গড়ে নেওয়া যাবে। আর যা যা লুকাতে পারো লুকাও। আমবাগানগুলো প্রপিতামহ-পিতামহরা রেখে গেছে কীসের জন্য? লুকাতে না পারলে লুকাবার খোয়াব দেখো। নেহেরুর প্রজা আমরা আল্টিমেটলি”। দুইজনকে হাসিতে বুঁদ হতে দেখে শুকরুও হাসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এবং চোখে আসে সে। কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছে নেয়। “এদের নিয়ে কী করবা উপাধ্যায়?”, রউফের গলায় মজা, “ইভেন দে ক্যান বি ট্রিটেড বাই দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট ইন্ডিয়া অ্যাস দ্য সাবজেক্ট টু বি ক্রোকড সামডে”, যেন আচ্ছা ধাঁধাঁয় ফেলেছেন সতীশকে। “শুকরু তু গঙ্গা দিয়ারাক খাসমহলক বাগিচা দেখিন”, এইসব ক্ষেত্রে সতীশ উপাধ্যায় কম কথার মানুষ,“রাজশাহীতে তোমাদের বেন্থাম কে পড়াতেন মির্জা?”।
আশ্বিনা বাগান ৭ বিঘা--- ---- ধানী জমি ১৬ বিঘা --- ছোটকা জোলা-- তারপর ৭৫টা শিশু গাছের বাগিচা-- -বিপিনশা বাগান ৫ বিঘা---- দিয়ারাটোলার গঙ্গাজলী গমের ক্ষেত ১১ বিঘার মধ্যে শুকরুকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫ বিঘা---- বড়কা জোলা--- খাসমহলের বাগান ১৮ বিঘা --- বাগানের ঠিক পাশ দিয়েই বাঘআড়ের শুকনা খাত---- ৬১টা গামারি আর মেহগনি গাছ---- ভাদোই ধানী জমি ৮ বিঘা--- কুশিয়ারের ক্ষেত ৫ বিঘা--বালু--- ভুট্টার জমি ৩ বিঘা- বালু----------- গঙ্গা--- ধুকপুক করে চলেছে শুধু জল। ২১২টা মেহগনি গাছ আর বালুর ভিতর আরো বহু বাগান ও ক্ষেত ছিল একসময়। বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে আর গঙ্গা কেটে এগোতে এগোতে সেগুলোর পর্চা গেছে। পর্চার বাইরে সতীশ বাবু তেমন আগ্রহী নন। তার মানচিত্রে শুকরুরা থাকলেও দিয়ারাটোলা থাকার প্রয়োজন হয় না। বহু বছর আগে উপাধ্যায়দের কোনও পূর্বনারীর সাধ হয়েছিল মাঘী পূর্নিমার ভোরে গঙ্গা অবধি যেতে তার গরুর গাড়ির চাকা যেন অন্য কারো জমি দিয়ে না যায়। মা ঠাকরুণের সেই আহ্লাদ পূরণ করতে দিয়ারাটোলা থেকে শুরু করে গঙ্গা অবধি যেতে যতটুকু পর্চার প্রয়োজন তার মালিকানা উপাধ্যায়রা নিয়েছিল, বড়কা জোলার কিছু অংশ সমেত। জোলার পাশের কিছু জায়গায় কবর থাকায় মা ঠাকরুণের গরুর গাড়ির চাকা সেই জমি দিয়ে যেতে চায়নি। তাই সেটা রেহাই পেয়েছে। বর্ষায় জোলাগুলো গঙ্গার সঙ্গে জুড়ে যেত অন্য সময়ে চোখে না আসা খাতগুলো দিয়ে। বাঘআড়ের খাত বর্ষা থেকে হেমন্তের শুরু অবধি জলে ভরে যায়। ক্রোশ খানেক দূর দিয়ে বওয়া পাগলা নদীর সাথে খাসমহলের বাগানকে জুড়ে দেয়। বাঘআড়ের কিছু জায়গায় বাঁশঝাড় এত ঝুঁকে নেমে থাকে যে খাত থেকে আলাদা হয়ে নতুন এক জোলা জন্মেছে বলে ভুল হয়। সেই জায়গায় জল শ্যাওলায় ভার হয়ে থাকে। রোদ পড়ে তেরছা ভাবে। শরতের মাঝ নাগাদ বাঘআড়ের খাত আর জোলাগুলোর বেশ কিছু অংশ শুকিয়ে গিয়ে চাষের জমি হয়। কলাই ছড়ালেই টাকা। জমি আর জলার বেশিরভাগটা টাকার জোরেই দখল নিয়েছিল উপাধ্যায়রা। বেশ কিছু অংশ লাঠিসোঠা দিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আর দু-একটা খুন। সব জায়গাতেই কাজে এসেছিল ইংরেজি লেখাপড়া। ইংরেজি লেখাপড়া জানলে আর ভদ্রলোকী বাংলা বলতে পারলে এইসব রেকর্ড রাখতে ভুলে যেত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। পূর্ণিয়া থেকে কেটে মালদায় জুড়ে দেওয়া কাঁকজোল পরগনাকে বেঙ্গল প্রভিন্স বানানোর কাজে আসা লোকদের জন্য ওইটুকু ভুলে যাওয়া যায়। এই ভুলে যাওয়াকে সতীশ বাবুর ঠাকুরদা বেশ ভারি একটা নাম দিয়েছিলেন। দ্য মাইনিউটস অফ কুইন্সসিয়েস্তা। খাসমহলের বাগান থেকে গঙ্গা তখন অনেক দূর। দ্য মাইনিউটস অফ নেহেরুসিয়েস্তা কি নেই? সতীশ বাবু নিশ্চিত যে আছে। সতীশ বাবু তার খোঁজ এখনও পাচ্ছেন না। এই নিয়ে কিঞ্চিৎ খেদ আছে তার।
সাতচল্লিশকে সাত দিয়ে পূর্ণমানে ভাগ করা সম্ভব না হওয়ায় একজনকে দুটি কম বা দুইজনকে একটি করে কম নিতে হবেই। এটি ধানীজমি কিংবা আমবাগান নয় যে ডেসিম্যালেও ভাগ নেওয়া সম্ভব। যদিও সেই ডেসিম্যাল নিয়েও কোর্টকাছারি রুটিনকার ব্যাপার। সাতচল্লিশটি মানুষ উঠানে রোদ তাপতে তাপতে শুনছে। প্রত্যেককে ছয়টা করে গঙ্গাজলী গমের রুটি , বেগুনপোড়া আর খেজুরের গুড় দেওয়া হয়েছে কলাইয়ের বাসনে। “হরিমন তু সেজলা গিরস্থকা পাঁজরা যাকে বইঠ। হ্যাঁ হরিমনকে পেল ক্ষিতীশ চন্দ্র উপাধ্যায়”। হরিমন নিজের থালা তুলে সেজোবাবুর মেহগনির চেয়ারের কাছে এসে বসে। খেজুর গুড়ে কামড় দেয়। কে বা কে কে কম পাবে তা নিয়ে জট পাকতে থাকে । ছোটোবাবুর শরীর জন্মাবধি রুগ্ন হওয়ায় কোনো দাদাই চায় না যে ভাই ভাগে একটি কম পাক । সতীশ চন্দ্রই সূত্র বার করেন। রাঙাবাবু যেহেতু তেভাগাকে সাপোর্ট করে একমাস জেলও খেটে এসেছেন তাই তার ভাগে সাতটি নয়, তার ভাগে যাবে পাঁচটি। “ মেনে নাও জ্যোতিষ। আইডিওলজির জন্য তোমাদের হরেকৃষ্ণ নাকি পুরো জমিদারি ছেড়ে দিচ্ছে ? তুমি সেরেফ দু’টা মুনিষ কম নিতে পারবা না!”। এই কথায় কাজ হয়। শুকরু জানতো যে সতীশ বাবু তাকে নেবেই। কেন নেবে তা-ও হয়তো জানতো কিংবা তেমন করে জানত না। মরে যাওয়া সমারু জানত নিশ্চিত।
দিয়ারাটোলা থেকে ভোর ভোর উঠে রওনা দেয়। খাসমহলের বাগানে চাটাইয়ের একটা ছোট্টো ঘর। রাঁধার চুলা। একটু দূরে মাচানা বাঁধা। আমের সময়ে পাঁচমাস ছাড়া রাত কাটাতে লাগে না রোজ কে রোজ। তবে মাঝে মধ্যে থাকতে হয়। যত্নআত্তি বছরভর। মাটি দিয়ে দিয়ে গাছের গোড়া উঁচু রাখা, দরকার মতো আল দিয়ে বাগানে পানি ধরা, দরকার মতো আল কেটে পানি বার করে দেওয়া, গাছ পচতে লাগলে পচা সেই অংশ কেটে গাছের গোড়াতেই দিয়ে দেওয়া, মৌমাছি গাছে চাক বাঁধলে বাজের হাত থেকে চাকগুলোকে বাঁচানো, উঁই গোড়ায় বাসা বাঁধলে কেরোসিন দিয়ে বাসা ভাঙা, ডাল ছেঁটে ছেঁটে গাছগুলোকে গোল হতে দেওয়া, শীতের আগে আগে বাগান চাষ দেওয়া— অনেক বছর ভরের যত্নআত্তি শেষে পাকা সুর্মা ফজলি এমন গন্ধ ছড়ায় যে লোকে বলে জোড় লাগা সাপ জোড় ছেড়ে আমের কাছে চলে আসে। শুকরু শেয়ালকে আম খেতে আসতে দেখেছে। সাপকে দেখেনি কখনও আমে চুষকি মারতে। সুর্মা ফজলির সওদার সময় বাঘআড় দিয়ে নৌকার পর নৌকা এসে দাঁড়ায় ঠিক বাগানের পাশে। ভোর থেকে ঠুসি দিয়ে আম ভাঙা চলে। বেতের টুকরিতে গামছা বিছিয়ে রাখা হয় সুর্মা। টুকরিগুলা উঠে যায় ছাউনিওয়ালা বড় বড় সব নৌকার ছাউনির তলে। সওদা হওয়া সব ফজলি বাঘআড় দিয়ে গিয়ে পড়ে পাগলা নদীতে। ঘন হয়ে আসা বাঁশঝাড়গুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে ছমারুর উবে যাওয়ার গল্প করে কেউ কেউ। পাগলাতে নৌকা ঢুকলে রাজশাহীর সওদাকারীরা ডান দিক নিয়ে সামান্য দূরে গঙ্গায় গিয়ে পড়ে। পাল তুলে দেয় হাওয়া বুঝে । দুপুরের আলো চিকাচ্ছে জল জুড়ে। বড় নিশ্চিন্তে লাফ মেরে উঠে ডুব দিচ্ছে শুশুক। বাদামি গায়ে রোদ পিছলায়। তেমন ভাবওয়ালা সওদাকারী থাকলে নৌকায় সাতচল্লিশের কথা ওঠে। শুশুকদের কপাল মানুষের মতো খারাপ না বলে আফসোস করে কেউ । এইসব শুশুকদের কেউ কোনওদিন গঙ্গা থেকে তাড়িয়ে দেবে না বলে ফের সাতচল্লিশের কথায় ফেরে কেউ কেউ। পাগলা দিয়ে বামদিক নেয় যারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাবে। আমবাগানের ছায়া মাখতে মাখতে পাগলা এগোয় মহানন্দার দিকে। দোপহরে নৌকাগুলো দাঁড়ায় যেখানে, সেখান থেকে গৌড়ের ভাঙাচুরা দেখা যায়। নৌকায় বাখোয়াজি করার তেমন তেমন কেউ থাকলে চেনাতে থাকে সওদাকারীদের। ওই পুকুরে পারা মিশিয়ে তেষ্টায় ছাতি ছটপট করতে থাকা জালিমদের এনে ছেড়ে দেওয়া হত। জালিম ছাতি ভরে পানি খেয়ে মরতো। রামকেলির মেলার ভিড় কমে যাচ্ছে কেন তা নিয়ে কথা হয় তারপর। ওইটা হারামের মসজিদ— আঙুল তুলে দেখায় কেউ। বাঈজি নাচনো হত বাদশাহকে না জানিয়ে ওখানে। আগে গঙ্গা বইত ওই যে দেখা যাচ্ছে ওই শুখা খাতটা দিয়ে। রেশমের পর রেশম যেত তখন উত্তরের দিকে উজান বেয়ে। বাখোয়াজি সামটিয়ে এখনকার আমের নৌকারা রওনা দেয় পূবের দিকে। সেখান থেকে পানিতে পানিতেই সুর্মা চলে আরও পূবে। কাল থেকে সুর্মা ফজলি ভাঙা এই বাগানে। নৌকা আসতে থাকবে সকাল সকাল। শুকরু জানে তিরিশ-চল্লিশটা সুর্মা দেওয়া হবে তাকে। তবু আর বিশটা বেশি হলে বেটিটা আর চাররোজ বেশি খেতে পাবে। আমের দিকে হাত বাড়াতেই ঠান্ডা লাগে। হাত আঙুলে ধরে রাখা কয়েকশো বছরের গল্পের স্মৃতি দিয়েই মুহূর্তে বুঝে যায়। অন্য ডালে সরে আসে হাত। এই ডালে এক মনে আমে পাক দিতে থাকে গল্প হতে চলা হয়তো কোনও সাপ।
এভাবেই সমারু , রইসুনের পর গাছগুলো শুকরুকে দেখতে শুরু করল। শুকরুও দেখে সবকিছু। দখিনা বওয়াকালীন বাগানের পাতা আসা দেখেই আন্দাজ পেতে পারে এ দিয়ারার সবকিছু, তেমন চোখ শুকরুর কোনওকালেই ছিল না। তার ছিল কান। তার কান আরও তিখা হয়ে গেল সেই জ্বিন ধরা রাতের পর থেকে। খাসমহলের এই বাগানে সে কত কথা যে শুনতে পেত তারপর ! বাগান জুড়ে তখন শুধু সে, সার সার পুরনো গোপালভোগ, ল্যাংড়া আর সুর্মা ফজলি আর ভার হয়ে চেপে থাকা বিকেল বা কালীর মাই-এর মতো ঝুলতে থাকা রাত। সে শুনল ঘড়ঘড় করে ইঁদারা থেকে পানি তুলতে তুলতে ঝপাং করে বালতি ছিঁড়ে পানিতে পড়ে গেল। এত আওয়াজ কি বালতি পড়লে হয়? নাকি বালতি শুদ্ধু কেউ? লকড়ি ফাড়ার শব্দ, অথচ বাগানে সে একা । প্রথম প্রথম ভয় পেত খুব। তারপর একদিন সমারুর গলা শুনতে পেল এক গাছ থেকে। রিঠা মাছের গায়ের মত ছিল দুপুরটা। আলো পিছলাচ্ছিল মেঘের গা থেকে । দক্ষিণ পূর্বে মাচানা থেকে পঞ্চাশ পা দূরে থাকা গাছটা সমারু গলায় বলেছিল, “ডরবে নাই । ইটা শুখখা সময়। গাছেকা গোড়া যখন এখনই পানি টানিছে। ইখন লোক লোক লাগতে সবকিচ্ছু । কান তোর হাম্মার মতন হইলছো । তোর বাপেক আঁখ খুব তেজি ছিল । উ বয়রা ছিলে। অকরেল ইসব তোরা নাহি বইলেছো। নুকায়েকে ঘাস করিলেবে নিজেকে, তবে শুনেল পাইবে মরলে মানুষেক বাতচিত। বজরাকে পাছু মে বজরা যাইক আওয়াজ শুনেল পাইল্যা জানবে...”। কথা শেষ হওয়ার আগেই সতীশবাবু চলে আসায় সমারু গাছ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। অথবা এও হতে পারে সতীশ বাবুর উপস্থিতিতে শুকরুর কান সমারু গাছকে আর আলাদা করতে পারছিল না। তাই বাকি কথাগুলো বাতাসের শব্দ হয়েই কেবল পাতাগুলির ভিতর দিয়ে চলাচল করে যেতে থাকলো। চুপচাপ বাগান জরিপ করছেন সতীশ বাবু। দিনের আলো থাকতে থাকতে বাগানে এসেছিলেন শীতের শুরুতে শেষবার। তখন হাতে ছিল একটি ছোট্ট লোহার বাক্স। শুকরু পাশে এসে দাঁড়ায়। “ কোদারি লে”, কোদাল নিয়ে শুকরু। “ খুদ”, মাটি খুঁড়ে শুকরু। “ এখনি দশহাত খুদেল হইলতো”, তিন হাত, চার হাত, পাঁচ, ছ, হাঁপাতে থাকে শুকরু। “বইস। খাস্তাইল গেইলছেন। বইস”, ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে শুকরু। শীতকাল এখন। জাড়ের সময়। বাগান ঘুমিয়ে থাকে এখন। পাতাগুলো ভার হয়ে আছে। ক্লান্তি কেটে যায় দ্রুত। “বাবু, ই কী ছিয়ে?”, “ তু শুনিকে কী করবে?”। শুকরু চুপ। বাবু চুপ। তারপর বাবুর মনে হয় এই লোকটিকে গাছের মতো মনে করে বলে রাখা দরকার। বাবু যদি মরেটরে যান তাহলে তার পরের বাবুকে যাতে এই গাছ জানাতে পারে। এইরকম গাছের মতো লোকদের প্রয়োজনীয়তা তাদের বরাবর। এইবারই ভাগাভাগির সময় যদি বাবুদের প্রপিতামহের আমলের মুনিষটিকে জীবিত না পাওয়া যেত তাহলে বাবুদের কাকা বাবুদের বাবার যে বেশ কিছু আমবাগান দখল করে রেখেছে তা জানা যেত না। এই গাছমানুষেরা খুব দরকারি। বাবু গাছকে বলে যান। মানুষ নির্বিকার হয়ে শোনে। বেলেমাটির তারা, মহীপালেরও আগের সময়ের। বড়কা জোলা থেকে উঠেছিল। সমারুই পানির তল থেকে খুঁজে পেয়েছিল। বাড়িতে কালী হিসেবে পূজা পায়। সতীশ বাবুর পিতামহের আমল থেকেই। কিছুদিনের ভিতরেই জমিদারির দখল নিতে ভারত সরকার আসবে। সাত ভাই ভিন্ন হয়ে যাওয়ায় জমি বেঁচে যাবে প্রায় সবটাই। বাঁচবে না ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে উপহার পাওয়া অ্যান্টিকগুলো আর খুব প্রাচীন মূর্তিরা। বাড়ির পবিত্রতা রক্ষা করে চলেন যিনি তার বাড়িতে থাকা বড়োই প্রয়োজন। জমিদারি মাটিতে মিশে গেলে, সরকার সব ভুলে যাওয়ার পর চার-পাঁচ বছর পর আবার তুলে নিয়ে যাবেন। পূজা শুরু হবে আবার। তাই বাড়ির মাটিতেই থাকা খুব দরকার। শুকরু চোখ বুজে ঝপঝপ করে মাটির আওয়াজ শুনে। জলের তল থেকে উঠে আসা বেলেমাটি মাটি পায়। ঘুমিয়ে পড়ে এই বাগানের মাটিতে। সমারু গাছ তখনও কথা বলত না শুকরুর সাথে। শুকরু আস্তে আস্তে বাগানের আরেকটা গাছ হয়ে উঠতে থাকে। আমের টিকলি আসতে শুরু করার এক ফজরের নমাজের কিছুদিন পর থেকে সমারু গাছের গলা পেতে শুরু করে শুকরু। সমস্ত ভয়কে লাথ মেরে ডরহীন ভাবে বাগানকে শুনত তারপর থেকে। চোখ বুজে শুনলে মনে হয় বা যেন দেখছিও । অবাক হয়ে সে শুনতে থাকে একইসাথে বউল ফোটার শব্দ আর পাতা ঝুরে যাওয়ার শব্দ লেগে থাকে বসন্ত জুড়ে। পছিয়া আর দখিনা একসাথে বয় তখন।
বাগানের খবর দিতে সাত-দশদিনে একবার সে সতীশ বাবুর দালানে যায়। বারান্দার এক কোণে বসে চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখ বন্ধ করলে কান আর নাক জেগে ওঠে। এই বাড়ির গন্ধ তাদের বাড়ির গন্ধের চেয়ে পুরা আলাদা লাগে তার। বাভণদের গায়ে একটা আলাদা বু আছে। প্রথম প্রথম অচেনা ঠেকতো তার। অস্বস্তি আসতো। তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়। চামেটার আওয়াজ কানে এল ভিতর থেকে। একটু অবাক হয় সে। এই বাড়িতে থাপ্পড়ের আওয়াজ সে শুনেছে কেবল উঠানেই। সমারুর গালের চামেটার আওয়াজ আর তার রইসুনের গালের চামেটার আওয়াজ আলাদা ছিল। চামেটাগুলার পর ভালো করে তারা ভাত খেয়েছিল উঠানে বসেই, তার মনে আছে। সঙ্গে থাকলে কয়েকটা পয়সা শুকরু পেত সেদিন, যেদিন সমারু আর রইসুন চামেটা খেত সতীশবাবুর বাপের হাতে। সতীশবাবুও মেরেছে রইসুনকে দু-একবার। দোষ নিশ্চয় ছিল বড়দাদার, বাপের। নইলে চামেটা কি এমনি এমনি খায়? দোষ করলে সেও চামেটা খাবে। দোষ করার দিন মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে, ঠিক করেই রেখেছে। নরেশ ডাক্তার আর সতীশবাবু নামছে সিঁড়ি দিয়ে। “ইটস টু লেট ফর টেকিং দ্য প্রিভেন্টিভ স্টেপস নাউ, কিন্তু চিন্তা করিও না , আমি আছি তো। তুমি বরং বাকি দিকগুলো ভেবে রেখো”, নরেশ ডাক্তার জুতোয় পা গলিয়ে বেরিয়ে যান। সতীশবাবুর দ্বিতীয় পক্ষ এসে দাঁড়িয়েছেন দালানের সরাফায়। দ্বিতীয় পক্ষকে একটু সমঝে চলেন সতীশবাবুর মতো মানুষও। কথায় কথায় সতীশবাবুকে দ্বিতীয় পক্ষ মনে করিয়ে দেয় যে তার কাকা কলকতায় ব্যারিস্টারি করেন। সাতচল্লিশের পর প্রায়ই সতীশ বাবুকে মনে করানো হয় অগস্টের বজরার পুরো ভাড়া দ্বিতীয় পক্ষের বাবাই দিয়েছিলেন। এমনকী গুজবের ওই চারদিন রাজমহল থেকে মুঙ্গেরি বন্দুক আর তলোয়ারধারী ত্রিশটা রাজপুতও ভাড়া করে দিয়েছিলেন দ্বিতীয় পক্ষের মামা। সতীশবাবুর এখনকার মুখ দেখে আন্দাজ পায় না শুকরু— কী মুখ করতে হবে। “বাবু পচ্ছিমাক ক্ষীরসাপাতেমে কীরা লাগলেছে”— এই কথার উত্তর এই হতে পারে জানা থাকলে সে ছয় রোজ ধরে বুখার না কমা মেয়েকে নিয়েই আসতো। তার হিসাব ভুল হয়ে গেল। বুরবক ঠেকে নিজেকে। “আপনি নিজের রক্তের অন্যায়ের জন্য গরিব লোকটাকে চড় মারছেন কেন!”, দ্বিতীয় পক্ষ ঝাঁঝ দেখায়। তার মেয়ে আজ এলে নিশ্চিত অনেক পয়সা জুটতো। “চুপ, একদম চুপ”, চুপ হয় সবকিছু, বাবুর গলা পেয়ে।
— আমার বোঝা উচিত ছিল তুমি টের পেলেও কিছু বলবে না।
— বাইশটা ঘরের খাটের নিচে আপনার পুত্র ও আদরের দুলারীটি কী কী লীলা করে বেড়াচ্ছে তা দেখে বেড়াবার ক্ষমতা আমার নেই।
— কিন্তু বাকি চারমাসে তুমি কিছুই টের পাওনি এইটা কী করে সম্ভব! আমি জমিদারি বাঁচাতে একের পর এক উকিলের কাছে যাচ্ছি, সরকারি দপ্তরে দৌড়াচ্ছি । তুমি ভারতীর মা, কঙ্কার মা দু'টো ঝি-কেই টাকা দিয়েছো, স্বীকার করো নইলে আমার কানে খবর আসতোই।
— নিজের সন্তানদের কীর্তি ঢাকতে আমাকে শিখণ্ডি দাঁড় করাতেন চাইছেন শেষে?
— একমাত্র লিগ্যাল এয়ার না হলে আই উড কিল দ্যাট ফাকিং বাস্টার্ড।
— কেন কন্যাটিকে ছাড় দিচ্ছেন কেন? সতেরো বছর হয়ে গেলেও আইবুড়ো করে রেখেছেন কেন? ওকে দেখলে কারও কথা মনে পড়ে যায় বলে?
— চুপ, একদম চুপ।
— চুপ করব কেন! আমার বাপের বাড়িতে এই খবর গেলে কোন লজ্জায় মুখ দেখাব?
— তুমি কি গোটা পৃথিবীকে জানাতে চাও? তুমি এই বাড়ির একজন। বাড়ির সম্মান কি তোমার উপরে নির্ভর করছে না?
— বলুন কীভাবে আপনার পুত্র-কন্যার কলঙ্ক ধামাচাপা দিব? দোতালায় কি কাজের লোকেরা উঠবে না? তারা কি ওর চেহারা দেখে কিছু টের পাবে না?
— সব কয়টা কাজের লোককে ছয় মাসের মাইনা দিয়ে বিদায় করো। নতুন লোক আমি বাইরে থেকে আনাচ্ছি। তাদের এই কয়মাস দোতালায় উঠতে দেবে না। নরেশ বাকি সবকিছু সামলে দেবে। এইটুকু তো পারবে?
— পারতে হবেই আপনার সম্মানের জন্য।
— সম্মানের জন্য এইটুকু আমাদের করতেই হবে।
— সম্মানের জন্য চুপ হয় সবকিছু।
এত কথার মধ্যেও এক মনে পান ছেঁচে চলেন সতীশ বাবুর বড়মা। সতীশবাবুর বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রী । সন্তানহীন । সবকিছু সামলাবার আত্মবিশ্বাস জমলে শুকরুর হাতে কিছু পয়সা দেন সতীশবাবু। “মলম কিনিকে আনিন দাবাখানা সে” । আরো কিছু পয়সা বার করেন। “ বেটিকেলেল লবঞ্চুস কিনিকি আনিন”। যাক তার বেটির কথা মনে রেখেছেন বাবু।
আশ্বিনা বাগান ৭ বিঘা--- ---- ধানী জমি ১৬ বিঘা --- ছোটকা জোলা-- তারপর ৭৫টা শিশু গাছের বাগিচা---বিপিনশা বাগান ৫ বিঘা---- দিয়ারাটোলার গঙ্গাজলী গমের ক্ষেত ১১ বিঘার মধ্যে শুকরুকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫ বিঘা ---- বড়কা জোলা--- খাসমহলের বাগান ১৮ বিঘা --- ৬১টা গামারি আর মেহগনি গাছ--- ভাদোই ধানের জমি ৮ বিঘা--- বালু------------- গঙ্গা--- ধুকপুক করে চলেছে শুধু জল। বিকাল বিকালেই এসেছিল তারা বড়কা জোলার পাশে। আলো থাকতেই ফিরে যাওয়ার কথা দিয়ারাটোলায়। দিনের শেষতক আলোকে যে শুকরু এভাবে কাজে লাগাবে ভাবে নি লতিফ। চুপ করে শুকরু কেবল তাকিয়ে আছে। খানিক দূরে পানি শুকাতে শুরু করা জোলা। মরা মাছের মতো বু নাকে ঝাঁস মারে। শুকরুকে কিছু না বলে লতিফই কাম শুরু করে। খুব বেশি কিছু তো না। অল্পতেই হয়ে যাবে। হয়ে যায়। শেষ আলো দিনের মুছে আসছে। জানাজার রেওয়াজ এতটুকুন বাচ্চা মরলে নাই এখানে। লতিফ এইবার হাঁক পারে, “হ্য রে শুকরু!সাঁঝ হয়ি গেল। জলদি জলদি যাইল হইত। জোলাকা ভূত ধরলে সে হামারারিও মইরে যাইবো। জলদি কর”। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ততটা তাড়াতাড়িই শুকরু লাল গামছাটায় শোয়ানো বেটির বুকে মাথা দিয়ে শেষ শব্দটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে। ছোট্টো শরীরটা গামছায় মুড়ে যায়। মোড়ার আগে একটা কমলা লজেন্সে আর একটা ঝাল লজেন্স গামছায় রেখে দেয় সে। বুকটা কুত্তার মতো আকুলিবিকুলি করে। কোদাল দিয়ে মাটি বসিয়ে দেয়। গোরস্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসে দু’জন। “চল ”, লতিফ হাঁকে। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। এখান থেকে জোরসে হাঁটলেও বিশ মিনিট। “বাতচিত কর। ডর লাগেছো”, লতিফের গলায় বুক ঢিবঢিব। যখন শুকরুর মেয়ের বুখার খুব, তখন শুকরুকে বাগানে খুঁজতে না গিয়ে তার কি মাদ্রাসি হাকিমকে ডাকা উচিত ছিল? লতিফ তো পারত। করল না কেন? একটা দমচাপা বাতাস লতিফের বুকে পাক খেতেই থাকে। “ শুকরু বাতচিত কর”। শুকরু চুপ। অচেনা আঁধার অনেক কম ভয়াল। আন্দাজই পাওয়া যায় না চারপাশে কী? চেনা আঁধারে সমস্ত ভয় আধ-চেনা হয়ে থাকে। আধ-জানা সব টুকরোগুলো জুড়তে থাকে। লতিফ শুনেছে বড়কা জোলার দখল উপাধ্যায়দের এনে দিতে তার বড়দাদাকে নাকি বিশটা টুকরা করে দিয়েছিল সমারু। কেউ দেখেনি। অথচ বলে সবাই। প্রতিটা টুকরা নাকি পেয়েছিল জোলার চিতলরা। ছমারু নাকি বিশটা টুকরা ফেলেছিল জোলার তলে। অন্ধকার নেমে এলে নাকি সেই টুকরাগুলো উবে যাওয়া চিতলগুলোর পেট থেকে বেরিয়ে জোলার পাঁকে ফিরে আসে। জোড়া লাগতে চায়। “পানি, পানি”, বলে ডাক দেয়। কেউ নাকি দেখেছে দু'টা পায়ের পাতা পাঁক মেখে পানি চেয়ে এগোচ্ছে। আঙুল মুড়ে থাকা কাটা একটা হাতের পাঞ্জা জোলার পাঁক থেকে শামুকের মতো এগিয়ে আসছে চাঁদের আলোয়। কেউ নাকি দেখেছে। ছমারু নাকি ছটপটাতে থাকা শরীরটাকে এক ফোঁটা জল দেয়নি। লতিফের বরাবর মনে হয় সাঁঝ নামার আগে এ পথ পেরিয়ে না গেলে তার বড়দাদার বিশটা টুকরার অনেক কয়টাই জুড়ে তার কাছে আসবেই। এক বুক পিপাসা নিয়ে মরা বড়দাদার “পোতা রে! পানি দে”, আকুতিতে সে মরেও যেতে পারে। পিছনে ভুউউস ভুউউস করে কীসের আওয়াজ? মনের ভুল তো না, শুকরুও থেমেছে। দঅঅঅপ শব্দে আলো জ্বলে ওঠে। পিছু ফেরা দরকার ডর লাগলেও। মাটি থেকে পাঁচ-ছয় হাত উঁচুতে আলো জ্বলছে। খানিক আশমানের রঙ নিয়ে বড়ো হচ্ছে। ভুল্লা। দু’জনেই জানে জোলার ধারে কাল দু'জনের লাশ পড়ে থাকবে কাদায় উপুড় হয়ে। শুকরুর বড়দাদা সমারুকে নাকি ভুল্লায় ধরেছিল। সারারাত-সারাদিন ধরে ঘোরার পর উবে গিয়েছিল সমারু। কেউ কেউ নাকি জানে সেসব কথা। লতিফ আর শুকরু দু’জনাই প্রথম পড়লো ভুল্লার খপ্পরে। শুকরুর ভুল্লাকে দেখতে চিনা লন্ঠনের মতো লাগছে। ভুল্লা এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। দু’জনে একসাথে গাঁয়ের দিকে ফিরল। বাঁচবে না জেনেও বাঁচার আশা ছেড়েছে কবে মানুষ? ভুল্লা তাদের পাশে। পা চলছে না যেন। ভুল্লার আলোয় এখন আধ-স্পষ্ট হয়ে উঠছে পথ। বড় মোলায়েম লাগছে দু’জনকে এই আলোয়। ডরের চোটে প্রায় মরতে বসা মানুষ দেখতে খুবই অসহায়, করুণা আসে। করুণাযোগ্য দু'টি মানুষ ভুতুড়ে আলোকে পাশে নিয়ে হাঁটছে। একটা বাচ্চা মেয়েকে খানিক আগে কবরে শুইয়ে খানিক পরের বাড়ির ভাতের জন্য তারা হাঁটছে। মরে যাবে জেনেও হাঁটা ছাড়তে পারছে না কিছুতেই। কেউ কারও সাথে কোনও কথা বলছে না। চুপ করে খালি হাঁটা। মাঝে মাঝে ভুল্লার দিকে তাকাচ্ছে দু’জন। কেউ কারও সাথে কথা বলতে পারছে না। খানিক দূরে কুপির আলোয় দিয়ারাটোলার রেখা ফুটে উঠছে। একটা পিপুল গাছের নিচে এসে পাক দেয় ভুল্লা। বোঁওও কেটে উঠে যায় গাছে। দপ করে নিভে যায় ভুল্লা। মিশকালো চারপাশে দূরে আলোর একটা রেখার দিকে এগোতে থাকে দু'টি মানুষ। চেত ফিরে আসে। জোর পায়ে হাঁটা দেয় গ্রামের দিকে। গোসল করে বাড়ি ঢুকতে হবে। ইঁদারা থেকে পানি তুলতে তুলতে লতিফ শুকরুকে জিগায়, “ একটা ছোট্ট্যা ছউরি ছেলে না?”। “একদম কোড়েকা। বহুত ছোট্ট্যা।”, শুকরু গায়ে পানি ঢালে। লতিফ আর কিছু বলে না। লন্ঠন হাতে গাঁয়ের মুখ অবধি পৌঁছে দিল শুকরুর মরে যাওয়া বেটি। তারপর পিপুল গাছের পাতা হয়ে গেল। তবু শুকরু চিনতে পারলো না !
সাদা চুল আর সাদা কাপড়টা যেন পরস্পরকে কয়েক জন্ম ধরে চেনে। সতীশবাবুর বড়মা এই বাড়িতে আমসত্ত্ব তৈরিতে প্রথম এবং শেষ কথা বলার মানুষ। উঠোন জুড়ে বিশ-বাইশটা দড়ির খাটিয়া। গরুর গাড়ির চাকা বানাবার সময় বেঁচে যাওয়া তেঁতুল কাঠগুলোর হিল্লে হয়ে যেত এইসব খাটিয়ায়। তেঁতুলবিছনের বন থেকে কেটে তেঁতুল গাছগুলোর বেশিরভাগ ভাট্টিতে ঢুকে ইঁটকে আরো লাল করে তুলত। বাকিটুকু গরুর গাড়ির চাকায়। বাকির বাকিটুকু এইসব খাটিয়ায়। সকলেই জানতো কাঠগুলোতে দুসাধদের হাত লেগে আছে। ওই জঙ্গলে বাবলার কাঁটা সামলে গাছ কাটতে গেলে শুয়োর খাওয়া শক্তি লাগে— সকলেই জানে। ভূঁইয়ারদের হাতে লাথি, জুতা খেয়ে গঙ্গা আর ফুলহর পার করে চলে আসা দুসাধগুলোর দাপটে তেঁতুলবিছন পাল্টাচ্ছিল। কিন্তু সতীশবাবুর বড় মা যদি জানেন যে এইসব খাটে কর্মকার নয়, দুসাধদের হাত লেগে আছে আমসত্ত্ব খাওয়া ঘুচে যাবে এই বাড়ির। এরা দ্বারভাঙিয়া মুসলমান অবধি কোনও রকমে মেনে নিতে পারে গায়ের রঙ আর নাক-চোখের গঠন নিজেদের মতো হওয়ায়। কিন্তু দুসাধ, চাঁড়ালরা এদের জীবনে কোথাও নেই। “ঠিক করিকে আড়াইয়াকা রস নিকল না গে বেটি”, নিঃসন্তান বিধবার গলায় উদ্বেগ। আড়াই দিনে পচে যেতে চলা গোপালভোগের রস একটুও যেন মজে না যায়। ঠিক পাকার আগের গোপালভোগ, পাকা গোপালভোগ, আড়াই দিন পর পচে যাওয়া গোপালভোগের ঠিক থাকা অংশ— আমসত্ত্বের জন্য এই রসই লাগে। বড়মা ওই ঠিক থাকা অংশটুকু ব্যবহার করতে দেন না। তাই তার চিন্তা অনেক বেশি থাকে বাকিদের চেয়ে। বড়মাকে নিয়ে সতীশবাবু ভাবেন বছরে কয়েক বার।
আজ যেমন ভাবছেন বড়মার তদারকিতে আমসত্ত্বের আয়োজনকালীন। ইজি-চেয়ারে গা এলিয়ে বারান্দায় বসে আছেন সতীশ বাবু। যতবারই ভাবতে বসেন কৃতজ্ঞতার ভার আরও বেশি করে বুকে চেপে বসে। এই ভদ্রমহিলার যদি বারবার গর্ভ নষ্ট না হত, সতীশবাবুরা কি পৃথিবীতে থাকতেন? গর্ভে আসা সন্তান বার বার নষ্ট হয়ে যেত। তারপরেই সতীশবাবুর মা’কে এই বাড়িতে নিয়ে আসা হয় বউ করে। খাটিয়াগুলোর উপর কাগজ বিছানো সারা। বিছিয়ে দেওয়া কাগজগুলো জুড়ে নেহরুর বাকতুল্লি আর জমিদারি কীভাবে ক্রোক করা হবে তার খবর। সাদা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় কাগজগুলো। অস্পষ্ট হয়ে জেগে থাকে নেহরুর মুখ। সাদা ন্যাকড়ায় জোরালো মেয়েলি হাতগুলোর চাপে গোপালভোগের রস ঝরতে থাকে সাদা কাপড়গুলোর উপর। ঢেকে যেতে থাকে নেহরুর মুখ। তিনবার ভ্রূণ ঝরে গেলে একজন মহিলা ঠিক কতটা যন্ত্রণা পেতে পারে? তিনি ভাবতেই পারেন না সেই কষ্ট। বড়মা সেই দুঃখ কি ভুলতে পেরেছেন কখনও? তিনি তো পুরুষ। তবু তার এত কষ্ট হল। কষ্টের চেয়ে কি কর্তব্য জরুরি নয়? বড়মা তো সন্তান হারানোর যন্ত্রণা নিয়েও কর্তব্য করে চলেছেন এই বাড়ির প্রতি। গলার কাছে অস্বস্তি আসে সতীশবাবুর। অস্বস্তি কাটাতে কবিতার কাছে আশ্রয় খোঁজেন তিনি। প্রথম পরত পরে গেল আমসত্ত্বের। খাটিয়াগুলোর দু’দিকে দাঁড়িয়ে তালপাতার পাখার হাওয়া দিয়ে মাছিকে বসতে দিচ্ছে না পেশিহীন মজবুত মেয়েলি কাঁধ। বড় মা পান পাতায় চুন লাগাচ্ছেন সবকিছুর দিকে নজর রেখে। দেশ স্বাধীন হবে কংগ্রেস নেতারা তখন অবধি ভাবতে পারছে না। সতীশবাবু আইএ-এর ছাত্র তখন। প্রসোডিতে দখল দুর্দান্ত। স্ক্যান করে নিঁখুত স্ট্রেসে এতদিন পরেও আইএ’র সতীশবাবুকে ফিরিয়ে আনলেন নিজের এই আমসত্ত্বকালীন জৈষ্ঠ্যের শেষ হতে চলা সকালে।
“ ...কাম নাও, টু সার্চ ইয়োর ম্যানহুড
থ্রু অল দ্য থ্যাঙ্কলেস ইয়ারস,
কোল্ড-এজড উইদ ডিয়ার-বট উইজডম,
দ্য জাজমেন্ট অভ ইয়োর পিয়ার্স ”
দ্বিতীয় পরতের আমসত্ত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে। নেহরুর চিহ্নমাত্র নেই এখন। তার দ্বিতীয় বিয়ের তো চাপ নিতে হয়নি তার প্রথম পক্ষ সরলাকে। ছেলের জন্ম দিতে গিয়েই মরল। নিজেকে রেখে গেল মেয়েটার মুখের আদলে। কিন্তু বড়মাকে তো তার মায়ের উপস্থিতি মানতে হয়েছিল একই বাড়িতে? বড়মার কষ্ট হত না? বড়মা কি বাবাকে ভালোবাসতেন আর? একদিক দিয়ে বড়মার জীবন স্বস্তির। তার মতো ভার বহন করতে হয় না বুকের ভিতর। যে ভার তাকে এই কবিতার কাছে নিয়ে আসে। নিজেই নিজেকে মনে করান সতীশবাবু বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে। রুডওয়ার্ড কিপলিং। তারপর ফের বিড়বিড়ান —
“টেক আপ দ্য হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন...”
ভাগ্যিস বড়মাকে এত সব চাপ নিতে হয় না। সতীশবাবুর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মেয়েকে কোলের কাছে বসিয়ে বড্ড যতন করে চুলে গঙ্গার শ্যাওলা মেশা মাটি লাগিয়ে দিচ্ছেন বড়মা পান চিবুতে চিবুতে। সতীশবাবুর কানে আসছে বড়মা বলছে সরলার মেয়েকে , “তোর বয়সে আমার সতীন চলে এসেছে জানিস? আমার বিয়ে হয়েছিল দশ বছর বয়সে। বিয়ের পর পর শাশুড়ি নিজ হাতে হাতিপাউয়া লুচি আর বোঁদে খাইয়ে দিত আমায়। আমার তবু মন খারাপ হত। আমার ছোট্টবেলার বন্ধু লাবণ্যের সাথে কন্যাপুতুল আর খেলতে পারতাম না বলে...” । চুলে গঙ্গামাটি মাখাতে মাখাতে বড়মা কন্যাপুতুল খেলার গল্প বলে চলেন সতীশবাবুর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মেয়েকে। ভাদ্রের গুমোট বিকেলে বড়মার মা হাতিপাউয়া লুচি ভাজত কন্যাপুতুলের বিয়ের খাতিরে। বড়মা আর লাবণ্য বড় যত্নে সাজাতো ভাসিয়ে দেওয়ার ডালা। ঘাস, পাতা, খড়ি, লতা, টগর দিয়ে। খড়ি আর হলুদ দিয়ে আলপনা আঁকত ডালায়। কাপড় দিয়ে একটা ছাউনিও করে দিত। পুতুলগুলো যাতে রোদ জলে কষ্ট না পায় ভাসতে ভাসতে। ডালাটা বড়কা জোলার রোদ গোলা জলে ভাসতে ভাসতে রোদ মতো হয়ে আসত একসময়। বড়মার পরশে মেয়ে আবার গমের রঙ ফিরে পাবে ত্বকে। সতীশবাবুর ছেলে আপাতত সরলার বাপের বাড়িতে। ভারকেও প্রশান্তি ঠেকে এমন সময়। রোদে শুকোতে থাকা আমসত্ত্ব খাসমহলের বাগানের স্মৃতি ধরে রাখছে গন্ধ দিয়ে। সতীশবাবুর চোখ বুঁজে আসে। ঝাঁঝালো একটা গন্ধ পেতে থাকে সে। ভেজা আর সাদা গন্ধ। আঁকুপাঁকু করতে থাকা একটা পুঁটুঁলির ভেতর থেকে আসছিল গন্ধটা। গন্ধটা থেকে বেরোতে হবে। চোখ খুলে যায়। রউফকে তার দরকার।
রউফের মুখ ধাক্কা মারতে থাকে। আবার চোখ বন্ধ করেন সতীশবাবু। রউফ তার সাথে সেই বিকেলে চা খেতে খেতে কি জানতো তার সব কনফিডেন্স উড়তে বড়জোর আর সাঁইত্রিশ দিন? রউফের জায়গায় সে নিজে থাকলে কী হত? সে কেন রউফের জায়গায় থাকবে? সাতচল্লিশেই রউফের বুঝে নেওয়া উচিত ছিল। বারিন্দের সব হিন্দু ভদ্রবাড়িই সরতে শুরু করে দিয়েছিল সাতচল্লিশেই। বাহান্নর ভিতর পুরো বারিন্দ থেকে প্রায় সব হিন্দু ভদ্রলোক এদিকে সরে আসে। কংগ্রসের উপর এত বিশ্বাস ছিল রউফের! নাকি নেহরুর উপর? ইন্ডিয়া ইজ ফর অল। নেহেরু, গান্ধী যেই বলুক সে রউফের জায়গায় থাকলে এত নিশ্চিন্ত হত না। পাকিস্তানে সেটলমেন্টের এক্সিট প্ল্যান অন্তত রাখা উচিত ছিল রউফের। রউফের মতো পয়সাওয়ালারা ওদিকে প্রপার্টি করে সরে পড়ছিল একে একে। আঠারোই অগস্টের পর এক বছরের মধ্যেই পয়সাওয়ালা বাঙালি, বিহারি, পাঠান, দ্বারভাঙিয়া, টাউনে সেটল করা বারেন্দ্রীরা প্রপার্টি জলের দরে বেচে পাকিস্তানে চলে যাচ্ছিল। এদের সবাই তখন খালি মুসলমান বলে। মাড়োয়ারিদের কাছে একের পর এক কম দামে আসছিল মালদার মঞ্জিলগুলো। এই পয়সাওয়ালা মুসলমানদের পালাতে দেখে এদের চাকরবাকররাও পালাতে লাগলো। চাকরবাকরদের পালানোটা এক দেখবার মতো দৃশ্য বটে। বৃদ্ধা, শিশু, গর্ভবতী, ছাগল, বাড়ির পেছনের নিজের হাতে লাগানো ক্ষীরসাপাতির গুঠঠির কলম এইসকল মোহদীপুরের দাখিল দরোয়াজা পার করে সার দিয়ে পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। মাস্টারির সম্মানের লোভটাই রউফদের মতো মুসলমানগুলোকে ডোবাল । সে রউফ না। তাই সে সাতচল্লিশের তেরোই অগস্ট থেকে সতেরোই অগস্ট অবধি চারটা বজরা রেডি রেখেছিল গঙ্গার মানিকচক ঘাটে। র্যাডক্লিফের নোট এলেই অবস্থা বুঝে রাজমহলের গঙ্গা দিয়ে সাহেবগঞ্জ চলে যাবে পুরো বাড়ি বজরা করে। সেখান থেকে জামশেদপুর। বাড়ির বেশ কিছু ছেলে, জামাই, শালা, ভায়রাভাই টাটাতে চাকরি করে । ধীরেসুস্থে সেটল করে নেওয়া যাবে। জমিজমা রউফের মারফত বেচে দেওয়া হবে সুবিধা মতো । এইসবের আগেই জুলাইয়ে জামশেদপুরের মাঙ্গোতে সুবর্ণরেখার ধারে পছন্দসই একটা জায়গা কিনে ফেলে রেখেছে এখনো সে। পুরো মালদার ওপারে চলে যাওয়ার গুজবের চারদিন রউফ তাকে বুঝিয়েছিল পাকিস্তানে থেকে গেলেও তার প্রতিপত্তি কিছু কমবে না। সে রউফ না। সে জানে এগুলো সব কথার কথা। আঠারোই অগস্ট মালদা কাটাকুটি হয়ে দু’দিকেই গেল খানিক খানিক । শ্বশুরকে বলে বজরাগুলোকে তারপরেও এক সপ্তাহ রেখেছিল সে। সে কোথাও রিফিউজি হত না। সে রিফিউজি হতে শেখেনি। আইহো, বুলবুলচণ্ডী, মঙ্গলবাড়ি, মালদা টাউনের এক নং কলোনিতে সে রিফিউজিদের দেখেছে। রউফ তো এখন ঢাকায়। রাজশাহীতে সেটল করতে পারলে তা-ও দেশের কাছাকাছি থাকতো। এদিকের বাঙালগুলোর মতোই কি কাটাচ্ছে দিন? ওদিকে কী বলে রউফদের? সে রউফকে বুদ্ধিমান ভাবতো। বাহান্নতে ভোট দিয়ে রউফ ভেবে নিয়েছিল আর চিন্তা নেই। নেহরুর সই করা ‘কুইট ইন্ডিয়া’ নোটিশ যখন এল তখন বুরবক হয়ে নিজের আম্মার সামনেই ভুল করে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিল। দৌড়াদৌড়ি করে জানল, আটচল্লিশ সালে ভারত সরকারকে না জানিয়ে রাজশাহী থেকে ছেঁচল্লিশ সালের মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। থেকেছে প্রায় মাস দশেক। তারপর মালদায় ফিরে বড় নিশ্চিন্তে সেই সার্টিফিকেট দিয়ে মাস্টারিতে ঢুকে গেছে। সবই তো চেনাজানা লোক। কেউই কোনও আপত্তি করেনি। রাজশাহীকে অন্য দেশ কেউ কি ভাবে এখনো? মানুষ যাচ্ছে। বিয়ে হচ্ছে। জল দিয়ে আম যাচ্ছে। কোথাও তো কেউ আপত্তি করছে না। ছেঁচল্লিশে শুরু হওয়া কোর্স আটচল্লিশে শেষ করতে এখান থেকে রাজশাহী যাবে না লোকে! রউফের এই ব্যাপারটা নিয়ে সরকারে রিপোর্ট কোনও চেনা লোক ছাড়া কি কেউ করবে? আর শুধু সার্টিফিকেট নিয়ে রিপোর্ট করলে কেবল চাকরিটা যেত। দশ মাস যে সরকারকে না জানিয়ে রাজশাহীতে থেকেছে তার সাক্ষীও দিয়ে দিল ইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটি। তার কারণে পাকিস্তানের চর বলে দিল রউফকে! ‘কুইট ইন্ডিয়া’ নোটিস হাতে ধরিয়ে সাত দিনের মধ্যে বিবি-বাচ্চা-সহ দেশ ছাড়া করালো। এখানেই থেকে যেতে হল রউফের আম্মা আর ভাইয়ের পরিবারকে। ম্যানেজিং কমিটিকে রউফ আবার চোখ বুজে বিশ্বাস করত। নিজের পাশের মানুষটিকে বিশ্বাস করে রউফকে দেশ হারাতে হল। রউফের মতো অনেক পয়সাওয়ালা মুসলমানকেই যে প্ল্যান করে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ দেওয়া হচ্ছে এখন সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে। শুকরু ছাড়া বিশ্বাস সে কাউকে খুব একটা করতে পারে না। একটা মাছি না কী এসে বসলে চোখ খুলেন সতীশবাবু। খোলা চোখে সতীশবাবু নিজেকে রউফের জায়গায় ফেলে দেখতে চান। তিনি রউফ নন। রউফদের চেয়ে তিনি আলাদা। সেই ঝুটঝামেলার অগস্টে বিকালে চা খেতে মজা করেই রউফ তাকে জিজ্ঞেস করেছিল
— বাংলা তো মাতৃভাষা হয়ে গেছে তোমাদের এখন। পশ্চিমে মানাতে পারবে আর?
—মাতৃভাষা থাকে দুর্বলদের রউফ। সবলরা ভাষার দখল নেয়।”
অস্বস্তিতে ভরে গিয়েছিল চা-এর স্বাদ। সতীশবাবুর চোখ বুজতে থাকে আবার।
পাপ নয় সবল হওয়া। সবল হয়ে কি পাপ করেছে সে? সবলের যা করা দরকার তাই করেছে সে। “তেলবড়িমে এত্তা চিনি ক্যানা দেইছেন?”— রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে সতীশবাবুর দ্বিতীয় পক্ষের অথোরিটি। গরমের দুপুরের ভাতের সাথে খেতে চলা তেলবড়ির টকের স্বাদ খানিক নষ্ট হতে চলেছে ভেবে সতীশবাবুরও খানিক রাগ হয়। চোখ খোলেন। বড়মার তার মেয়েকে চুলে গঙ্গামাটি মাখানোর স্নেহঘন দৃশ্যটি সেই রাগকে জমতে দেয় না। চোখ বন্ধ করেন আবার । আমসত্ত্বের গন্ধে ঘন হচ্ছে দুপুর। সে ভাবে খাসমহলের বাগানের মাটিতে থাকা সবকিছুর পুষ্টি নিয়ে কীভাবে আমসত্ত্ব এমন মায়াময় গন্ধ তৈরি করে! জীবনকে নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেই কি এমন মায়াময় ছায়া দেওয়া যায়? সতীশবাবু চোখ মেলেন। খাসমহলের বাগান, বড়মা এরা আসলে একই রকম। অসহায় এবং ছায়াময়। জীবন ভালো লাগছে তার। মাটিতে পুঁতে আসা দেবী তারাকে প্রণাম করেন তিনি। আরও বছর তিন-চার পর অবস্থা বুঝে মাটি থেকে তুলে আনবেন মা’কে। স্নান করতে হবে এবার। উঠে পড়েন।
শুকরু আস্তে আস্তে নিশ্চিত হচ্ছিল তার জন্যই তার বেটির ইন্তেকাল হয়েছে। সে ছাড়া আর কেউই জিম্মেদার নয় তার বেটির মরার। যা কিছু গুনাহ সেটা সেই করেছে। সে নিজেই নিজের কাছে কবুল করে এইসব। জাড়ের সময় শুরু হওয়া তক বুখার আসে, বুখার যায়। হাগতে গেলে কষ্ট হয় বেটির। রক্ত পড়ে ফোঁটা ফোঁটা হাগার সময়। মাদ্রাসি দাবাখানায় গিয়ে খালি দাবা নিয়ে এসে আর খাইয়ে দেয়। তার তো দরকার ছিল অন্তত সরকারি দাবাখানায় যাওয়া, তাই না? নরেশ ডাক্তারের দাবাখানায় যাওয়ার সাহস হত না তার। সতীশবাবু নরেশ ডাক্তারকে বলে দিলে দেখানো যেত। সে সতীশবাবুকে বলল না কেন? সতীশবাবুর সামনে যাওয়ার সাহস তার হয়নি প্রায় দু’মাস সেই রাতের পর। সেই রাতে খাসমহলের বাগানে সে জ্বিন দেখেছিল। চিনা লণ্ঠন হয়ে দুলতে দুলতে এসেছিল জ্বিন। জ্বিনের হাতের একটা পুঁটুলি ছিল কি? কিছু পরে জ্বিন তার হাত ধরে তার ভিতরে ঢুকে গেল। জ্বিন ভেতরে ঢোকার পর সে কী কী করছিল তার ঠিকঠাক মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে মাটিতে অনেকবার হাত ঘষেও জ্বিনের চ্যাটচ্যাটা ভাবটা তার হাত থেকে যাচ্ছিল না। হাটের এই ভিড়ে পিঁয়াজু খেতে খেতেও শুকরুর মনে হচ্ছিল, জ্বিনের হাত না ধরলে ওই থকথকা দিয়ে জ্বিন তাকে বাগে আনতে পারত না। জ্বিন একবার চড়ে বসলে কি আর সহজে ছাড় দেয়? জ্বিন কি ফজরের নামাজের সময় ভেগে গিয়েছিল? তাহলে সে গোটা দিন বাগানের মাটিতে শুয়ে শুয়ে গাছের পাতা দেখছিল কেন? বুখার নিয়ে মা-মরা বেটি ঘরে পড়ে আছে, তবুও সে শরীল উঠাতে পারেনি দোপহরের আগ আগ। লতিফের বিবি খানা দিয়ে গিয়েছিল। খেসারির ডাল, আলুপিঁয়াজ ভাজি, ভাদোইয়ের ভাত, ছোলার শাক। ছোলার শাক দিয়ে ভাত খেতে বড় ভালো লাগছিল। তবে ডালটায় শুরা পোকা ছিল পাকের পরেও। গা গুলাচ্ছিলো। নইলে মুখ খারাপ কি করে সে? বেটির চুলের গন্ধ নিতে নিতে সাঁঝিবেলা তক নিদ দিল সে। জ্বিনটা কি তার সাথেই এসেছিল খাসমহলের বাগান থেকে?আসলে কি জ্বিনটা ফজরের সময় যায়নি? জ্বিনটা কি তার চোখ দিয়ে পুরা রোজ ধরে আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আশমানের মাপ নিচ্ছিল? তার মেয়ের চুলের বাস সে নিচ্ছিল নাকি জ্বিনটা?
লতিফের বিবির কথা না হলে তো সে শুনত। কত্তবার তাকে ঠ্যাংকাট্টা পীরের ওখানে যেতে বলেছিল লতিফের বউ। সে আজ রোজ ভেবেছে, কাল রোজ যাব। কাল রোজ ভেবেছে, তরশু রোজ যাব। বাপ হলে কি আর কেউ এমন করে? জ্বিনই তাকে জড়িয়ে আছে পুরা। জ্বিন না জড়িয়ে থাকলে বাগানে গিয়ে কেউ ওইসব চিজ করে? তার শরীল জুড়ে কী জানি কী এক অস্বস্তি পাক মারে। বাগানে অন্য কোন মানুষ না থাকলে সে দু'পায়ে হাঁটতে পারত না আর বেশ কিছু রোজ । হামগুড়ির চেয়েও আপন ছিল ব্যাঙের মত চলা । তার চেয়েও কাছের ঠেকে ন্যাংটো হয়ে সারা শরীরে ঘাস মেখে গাছেদের সাথে লুকোচুরি খেলা । হামাগুড়ি দিয়ে যে গাছটার নিচে মূর্তিটা গোর দেওয়া ছিল তার কাছে গেল আরও কিছু রোজ পর । তারপর গলা উঁচু করে কুকুরের মত কেঁদে নিল খানিক । এক রোজ...দু রোজ... কয়েক রোজ । তারপর আবার ব্যাঙ আর ঘাস ঘাস খেলা। এগুলো জ্বিন ধরা লোক ছাড়া আর কেউ করে? জ্বিনই কি তাকে ঠ্যাংকাট্টার মাজারে যেতে দিল না? জ্বিনই কি তাহলে তাকে ছমারুর বাতচিত শোনায়? সেদিন রাতে জ্বিনটার হাত থেকে পুঁটুঁলিটা না নিলে কি তার ভিতর জ্বিন ঢুকত না? পুঁটুঁলিটা সে নিল জ্বিনের কাছ থেকে। “গারি দে”, জ্বিনটা সতীশ বাবুর গলায় বাতলাল। তারপর হাওয়া হয়ে গেল চিনা লন্ঠন হয়ে দুলতে দুলতে। পুঁটুঁলিটা মানুষের মতো নরম। তার ভালো লাগে হাত বুলাতে। কী দিয়ে বানানো এই ভগবানটা? সে খুলে ফেলে। সে যদি না খুলতো তাহলে কি তার বেটি মরতো না? বাভণদের দেবী এমনও হয়! তারপর ডরে শুকিয়ে গেল ছাতি। এত গেঁড়ি সে আগে কখনো হাতে নেয়নি। এত গেঁড়ি যে হাত কোনঠে, পা কোনঠে সমঝে আসে না। ইন্তেকাল হয়ে যাওয়া একটা মেয়ে তার হাতে। কোথায় পুঁতবে সে? এটা গাড়ার জন্য সে বড়কা জোলা যেতে পারবে না এত রাতে। বাগানেই গেড়ে দিবে ভাবে।
ভাবাটা কি ঠিক হয়নি তার? এখন তার মনে হয়। যে গাছের তলে তারার মূর্তি আছে সেটাই কোদারি আর শাবল দিয়ে ফের খুঁড়লো। চ্যাটচ্যাটা গেঁড়িটার গায়ে মায়া ভরে ভালো করে হাত বুলালো। জ্বিনটা তারপরেই তাকে জাপটে নিল। গেঁড়িটার সারা গা নইলে কেন শুঁকতে লাগলো সে? বাভণদের আসল গন্ধ কেমন? এটা বাভণই তো? সতীশবাবু দিয়ে গেছেন। বাভণ না হলে নিজে আসতেন না সতীশবাবু। এইটা কার বাচ্চা? সতীশ বাবুর তো কোনও মাগী নাই টাউনে। থাকলে কি সে জানতো না? সতীশ বাবুদের মতো লোক গঙ্গার ধারের ডোমদের টোলায় যাবে না। কিছু কিছু বাভণ সেই টোলায় লুকিয়ে লুকিয়ে যায়। কিন্তু সেগুলো তো খালি নামে বাভণ। খালি জনেউ আছে গায়ে। পয়সাকড়ি নাই তেমন, চাকরিবাকরিও নাই। জ্বিন ততক্ষণে কি তাকে পুরাপুরি কব্জা করে নিয়েছিল? সে গেঁড়িটার গন্ধ নিতে লাগলো কুত্তার মতো। পানির বু চেনা। মুতের বু চেনা। গেঁড়িটা কি হেগেওছিল? ঝাঁঝাঁলো একটা অচেনা বু। এইটা কি নরেশ ডাক্তারের দাবাখানার বু? মাথা ঝিমঝিম শুরু হয় তার। আবার মন দিয়ে মরে যাওয়ার গন্ধ শুঁকতে থাকে সে। বাভণপাড়ার কোনো গন্ধই সে পাচ্ছে না এই শরীলে। তাহলে কি বাভণদের বাভণ বু থাকে না পয়দার সময়? নাকি মরে গেছে বলে বাভণ বু চলে গেছে?
জ্বিনটা তাকে আরো লেপ্টে ধরে। চোখে ঝাঁস লাগছে। মাচানা থেকে টলতে টলতে বড়কা চাকুটা আনে। একটু আগেই তো মরেছে। খুনে নিশ্চয় বাভণ বু থাকবে। থাকবে না? হাতের মতো দেখতে কিছু একটাতে চাকু মারে সে। গঙ্গার ভাঙনের আওয়াজের চেয়েও ভয় ধরায় হুট করে একবার চিল্লে উঠে ফের চুপ হয়ে যাওয়া গেঁড়ির গলা। এইটা মড়া ছিল না? মরেনি ওটা? সতীশ বাবু হয়ে জ্বিন কী দিয়ে গিয়েছিল তার হাতে? আর দেরি না করে গেঁড়িটাকে কাটা হাত-সহ গর্তে ফেলে দেয় সে । মাটি ভরে দেয় গর্তে ঝিমঝিম চোখে। দেবী তারার সাথে মাটিতে শুয়ে থাকে খুন বইতে থাকা একটা আজকের রোজের গেঁড়ি। মরে গেছে তো ওটা? ফজরের আজান কানপট্টিতে আসছে নাকি? সে নিজেও নিজের কাছে মেনে নেয় সে নিজেই আসলে জালিম এক জ্বিন। সে-ই খুন করেছে । আর তার করা গুনাহের জন্যই তার বেটি মরেছে। সে যদি খুন না করত বেটিকে গোর দিয়ে আসার রোজে ওই গেঁড়িটা পিছু নিত? ভুল্লার চিনা লন্ঠনের ভিতরে লেপ্টে থাকতো পুরাটা পথ?
লতিফ তো টেরই পায়নি গেঁড়িটা তাদের সাথে সাথে আসছে। বেটিকে কবরে শুইয়ে খানিক এগোতেই পিছনে ভুউউস ভুউউস করে কীসের আওয়াজ? মনের ভুল তো না, লতিফও থেমেছে। দঅঅঅপ শব্দে আলো জ্বলে ওঠে। পিছু ফেরা দরকার ডর লাগলেও। মাটি থেকে পাঁচ ছয় হাত উঁচুতে আলো জ্বলছে। খানিক কচি আমপাতার রঙ নিয়ে বড়ো হচ্ছে। ভুল্লা। দু’জনেই জানে জোলার ধারে কাল দু'জনের লাশ পড়ে থাকবে কাদায় উপুড় হয়ে। শুকরুর ভুল্লাকে দেখতে চিনা লন্ঠনের মতো লাগছে। ভুল্লা এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। দু’জনে একসাথে গাঁয়ের দিকে ফিরলো। বাঁচার কোনও মানে নাই জেনেও বাঁচার আশ ছেড়েছে কবে মানুষ? ভুল্লা তাদের পাশে পাশে। খুবই দ্রুত চলছে পা। ভুল্লার আলোয় এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে পথ। বড় জালিম লাগছে দু’জনকে এই আলোয়। নিজেকে জালিম মেনে নেওয়া মানুষ দেখতে খুবই ডরপোক ঠেকে। দু'টি ডরপোক মানুষ ভুতুড়ে আলোকে পাশে নিয়ে হাঁটছে। একটা বাচ্চা মেয়েকে খানিক আগে কবরে শুইয়ে খানিক পরের বাড়ির ভাতের জন্য তারা হাঁটছে। বাঁচতে হবে জেনেই হাঁটা ছাড়তে পারছে না কিছুতেই। কেউ কারও সাথে কোনো কথা বলছে না। চুপ করে খালি হাঁটা। মাঝে মাঝে ভুল্লার দিকে তাকাচ্ছে দু’জন। কেউ কারও সাথে কথা বলতে পারছে না। খানিক দূরে কুপির আলোয় দিয়ারাটোলার রেখা ফুটে উঠছে। একটা পিপুল গাছের নিচে এসে পাক দেয় ভুল্লা। বোঁওও কেটে উঠে যায় গাছে। দপ করে নিভে যায় ভুল্লা। মিশকালো চারপাশে দূরে আলোর একটা রেখার দিকে এগোতে থাকে দু'টি মানুষ। চেত ফিরে আসে। হাঁটার বেগ কমে আসে। গোসল করে বাড়ি ঢুকতে হবে। ইঁদারা থেকে পানি তুলতে তুলতে লতিফ শুকরুকে জিগায়, “ একটা ছোট্ট ছউরি মানুষ ছইল না?”। “একদম কোড়েকা। একদম ছোট্টা”, শুকরু গায়ে পানি ঢালে। শুকরু আর কিছু বলে না। লন্ঠনের ভিতর গায়ে লেপ্টে গাঁয়ের মুখ অবধি এল পুঁতে দেওয়া সেই গেঁড়ি । তারপর পিপুল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উপরে গিয়ে বাদুড় হয়ে উড়ে গেল খাসমহলের বাগানের দিকে। তবু লতিফ বললো ছোট্ট বেটি মানুষ!
আরও পড়ুন: বুবি ও তেঁতুলভূতের গল্প : অমৃতা ভট্টাচার্য
আশ্বিনা বাগান ৭ বিঘা--- ---- ধানী জমি ১৬ বিঘা --- ছোটকা জোলা-- তারপর ৭৫টা শিশু গাছের বাগিচা---বিপিনশা বাগান ৫ বিঘা---- দিয়ারাটোলার গঙ্গাজলী গমের ক্ষেত ১১ বিঘা---- বড়কা জোলা--- খাসমহলের বাগান ৬ বিঘা --- ৬১টা গামারি আর মেহেগণি গাছ--- বালু------------- গঙ্গা--- ধুকপুক করে চলেছে শুধু জল। জিন্দা থাকতে নিজের বেটিকে সে অত গায়ে লাগায়নি হয়তো, যতটা গায়ে লাগাতে থাকল এই বাগানের মাটির তলে গেঁড়িটাকে গেড়ে দিয়ে। পাতা ঝুরে আবার, পাতা জুড়ে ফের। শুকরু কানপট্টি পেতে শুনতে চাইত গাছটার বুকে মাথা দিয়ে। শুনতে চাইত তার বেটিকে । ফিসফিস গলায় আব্বা আব্বা ডেকে কেউ ঘুরপাক খাচ্ছে কিনা ভিতর-গাছে ঠাওরাবার চেষ্টা করত । কোদারির আওয়াজ, লন্ঠন জ্বালানোর জন্য দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ , বড়কা চাকু দিয়ে জবাইয়ের সময় বাঁচতে চাওয়া কান্নার শব্দ, সতীশ বাবুর “গারি দে” সব শুনতে পেত। খালি আব্বা বলে কেউ ডেকে উঠতো না। সতীশবাবু বাগানে এলে ঠিকঠাক হয়ে যেত শুকরু। বাগানটাও ঠিকঠাক হয়ে যেত সতীশবাবুকে দেখলেই। সতীশবাবু চলে গেলে জায়গাটার সামনে ব্যাঙ হয়ে বসে সে। আজানের পর আজান ভেসে আসে দূর থেকে । পাছা উপুড় করে যেখানে দেবী তারা আর গেঁড়িটাকে পুঁতে দিয়েছে। শুয়ে থাকে। ঘাসগুলোতে গরম ভাপ লাগে। কিছু রোজ পর সব আওয়াজ ছাপিয়ে শুকরু জল কেটে যাওয়া বজরার আওয়াজ শুনতে পায় মাটির ভিতর । সব বজরা জল কেটে চলে গেলে পড়ে থাকে গাছ, মাটি, মাটিতে প্রায় মিশে যাওয়া এক সদ্যোজাতের দেহ ,দেবী মূর্তি আর মনকেমন এক বাল। সমারু জানে আর কয়েকমাস মাটির তল দিয়ে বজরা ছাড়া আর কিছুরই আওয়াজ পাবে না শুকরু। ভাগ্যিস শুকরু দেখতে শেখেনি । তাই সতীশবাবুও আন্দাজ পাবেন না সময়ের চেয়ে আগেই গঙ্গার এগিয়ে আসার। রইসুন বেঁচে থাকলে বলে দিত গঙ্গায় তার খুব চেনা রঙ ধরছে। খাসমহলের বাগান গঙ্গায় যেতে খুব বেশি হলে এই সনের ভাদ্র ।