বিয়োগফল : ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Bengali Short Story: প্রতি বছর এই সময় মালতী কাজে যায় না। সারাটা দিন ঘরেই থাকতে হয়। কয়েক জন আসে, সেদিনের জন্য খাবার দেয়, জলের প্যাকেট দেয়।

ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো দেখেই মালতী ধড়াক করে উঠে বসল। মেঝেতে একটা ছেঁড়া শাড়ি পেতেই শুতে হয়। পাশে শুয়ে তিন বছরের ছেলে কড়ি এখনও ঘুমে কাদা। মালতী মাথার পিছনে থাকা মোবাইলে সময়টা দেখে নেয়। গত মাসে বৌদি মোবাইলটা দিয়ে বলেছিল, "এই নে, যেদিন আসতে পারবি না, বা কোনও অসুবিধা হবে, জানিয়ে দিবি।" কীভাবে মোবাইল ব্যবহার করতে হয় সেটাও শিখিয়ে দিয়েছিল।

সেই মোবাইলে সময়টা দেখে একটা ছোট শ্বাস ছাড়ে। যাক এখনও ছ'টা বাজেনি। তার পরেই আবার মনে পড়ে যায়, "এই রে আলো ফুটলে তো ওদিকে লাইন পড়ে যাবে।"

প্রতিদিন অন্ধকার থাকতেই বাইরে বেরিয়ে সকালের কাজগুলো সেরে নিতে হয়। ছেলেটাকে ড্রেনে বসাতে পারে, কিন্তু নিজে কীভাবে বসবে? এই বস্তিতে সবাই একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে। বেশিরভাগ রাত করেই বাড়ি ফেরে। মালতীর মতো যারা আছে তাদের অনেকেই ডবল শিফটের কাজ করে। একমাত্র মালতীই কাজ করে ফিরে সন্ধের সময় ঘরে থাকে। এই নিয়ে তার একটা গর্বও আছে।

চোখ দুটো কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখে। চোখের সামনে দেওয়ালে একটা মা কালীর ফটো ঝুলছে। মালতী হাত তুলে একবার প্রণাম করলেও মনে মনে বলে, "মাগো কয়েকটা দিন আমার সঙ্গে তোকেও এই ঘর ছাড়তে হবে।"

ঘরের একদিকে কয়েকটা পোঁটলায় নিজেদের কিছু জিনিস বাঁধা আছে। জিনিস বলতে ওই একটা স্টোভ, কয়েকটা শাড়ি, ব্লাউজ এই সব। এবার ক’দিন বাইরে থাকতে হবে কে জানে? ছেলেটার মাথায় একবার হাত বোলায়। একটু আগেও মালতীর গলা ধরে ঘুমাচ্ছিল। ছোট থেকে এরও এক কপাল হয়েছে।

মালতী মুখে ‘জয় মা’ বলে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই দেখে কলতলাতেও বেশ লাইন পড়ে গেছে। চারটে পায়খানাঘরও বন্ধ। দরজার পাশ থেকে বালতিটা নিয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে আসতেই উল্টো দিকের ফারজানা বলে ওঠে, "কী রে আজকের দিনেই ঘুমিয়ে গেলি?"

মালতী হালকা করে উত্তর দেয়, "হ্যাঁগো মাসি, ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গেছিলাম, রাতে ঘুম আসছিল না। কে জানে এবারে আবার কতদিন বাইরে থাকতে হবে?"

- তুই কি এবারেও স্টেশনে থাকবি?

- তাছাড়া আর কোথায় যাব? আগেরবার দেখলে না, স্কুলের পিছন দিকে থাকতে আরম্ভ করেছিলাম। তারপরেও মাঝখানে সব ছেড়ে আবার সেই স্টেশনেই ফিরে যেতে হল, তোমরা কোথায় থাকবে?

- আমরা এবার বাসস্ট্যান্ডে থাকছি, এরাই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

- তাই! আমাকেও বলতে পারতে।

- খুব ছোট জায়গা, তারপরে তুই তো সারাটা দিন ঘরে থাকিস না, সেই সময়েই সব কিছু হয়ে যায়। তোর ছেলেটাও কি তোর সঙ্গেই থাকবে?

- তাছাড়া আর কোথায় যাবে বল? তোমাদের তাও ঘরের লোকটা আছে, আমার তো যা করব আমি নিজে।

কথাগুলো বলবার মাঝেই একটা পায়খানাঘর খালি হতেই ফারজানা বালতি হাতে ভিতরে ঢুকে যায়। বাইরে একাই দাঁড়িয়ে থাকে মালতী।

এখানে বিয়ে হয়ে আসার দু’বছর পর থেকেই এই উপদ্রবটা আরম্ভ হয়েছে। দু’ তিন বছর পরপর এই বস্তির সবাইকেই এক মাসের জন্য এই জায়গাটা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে হয়। সেই সময় এই জায়গাটা ভেঙে ফেলবার একটা নাটক চলে। বড় বড় গাড়ি আসে, পুলিশ আসে, পৌরসভার লোক আসে। প্রথম প্রথম ওরাই ঘরের ভিতর থেকে জিনিসপত্র বাইরে বের করে দিত। এখন অবশ্য ওরা বলে দেয়, "মাত্র তো কয়েকটা দিনের ব্যাপার, নিজেরা একটু অন্য কোথাও থাকো, একটু ঠান্ডা হয়ে গেলেই আবার চলে আসবে।" মালতীরা অনেকের কাছে গেছে। মিছিলে হেঁটেছে, ভোটের সময় বেশি বেশি ভোট দিয়েছে। কিন্তু কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা কেউ করতে পারেনি। তবে এখন আগে থেকে বলে দেয়। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে, "আমরা কী করব বল, যা করতে বলে আমরা তাই করি! তবে তোমরা একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্তে থেকো, এখান থেকে তোমাদের কেউ উঠিয়ে দেবে না। হয়তো কয়েকদিন অন্য কোথাও থাকতে হতে পারে, একটু ঠান্ডা হলে আবার এসে থাকবে। তবে চেষ্টা করবে যাতে টিন ফিন দিয়ে ছোটখাটো বাড়ি করা যায়।"

এইরকম ভাবেই এখানে পঞ্চাশটা ঘর আছে। বেশিরভাগ মানুষ এর ওর বাড়ি কাজ করেই সংসার চালায়। বাড়ির লোকগুলো কেউ রিকশা চালায়, কেউ বা অন্য কিছু। কয়েকজনের আবার বাড়িতে কোনও পুরুষ মানুষ নেই। তাদের মধ্যেই এই মালতী পড়ে। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বরটার আরেক জনকে মনে ধরল। মালতী কিছু জানতেও পারেনি। এক রাতে কাউকে কিছু না বলে ফুরুৎ হয়ে যাবার পরে মালতী জানতে পারে আমিনার কথা। কোন এক খালপাড়ের ধারে থাকে। ওরও বর মরে গেছে। কীভাবে দু'জনের আলাপ হল কে জানে। মালতী জানতে পেরে নিজেই ওর বাড়ি গেছিল। তখন অবশ্য বিয়েটিয়ে সব হয়ে গেছে। মালতীকে দেখতে পেয়ে বর বলে, "তুইও থাকতে পারিস, তবে এর সঙ্গেই তোকে থাকতে হবে।"

‘সতীনের সঙ্গে ঘর? যখন তোমার সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলাম তখন তো একবারের জন্যও বলোনি। এখন এই সব কথা বললে কেমন করে হবে?"

মালতী খুব চিৎকার করেছিল। কিন্তু ওর চিৎকার কেই বা শোনে। কাঁদতে কাঁদতে ওই খালপাড় থেকে এই রেলপাড়ের ধারে চলে আসে, আসতে হয়। পেটে তখন তিন মাসের বাচ্চা। সেদিন ঘরটাতে ঢুকেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছিল। কীভাবে চালাবে, নিজের পেট, একজন আসছে তার পেট আছে। লোকটা নিজে রিকশা চালাত, এখন পেট বানিয়ে পালালো।

তখন বাইরে বেরোতে না হলেও এখন মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে। শুধু মনে হয় ঠিক কার কাছে একটা ভালো কাজের ব্যবস্থা হবে? এমনি কাজের অনেক জায়গা। অনেকেই কানে কানে ফিসফিস করে বলে ওঠে, "পেটের টাকে মেরে দে, তোর আবার কাজের অভাব হবে নাকি? এই রকম রূপ, টকটকে যৌবন। শুধু...."

মালতী তাদের থামিয়ে দেয়। এইরকম ভাবে তো অনেকেই বাঁচতে পারে, কিন্তু এটা কি বাঁচা বলে? আস্তে আস্তে পেটে কড়ি থাকা অবস্থাতেই লোকের বাড়ি বাড়ি বাসন মাজা, কাপড় কাচার কাজ আরম্ভ করে। এক বাড়ি দু’বাড়ি করে এক বছরের মধ্যে পাঁচ বাড়ি কাজ হয়। তারপরেই এই নতুন বৌদির বাড়ি কাজ আরম্ভ করে। নতুন বৌদি বলে দেয়,"কাজ সেরকম কিছুই নেই, তোমাকে শুধু ঘরে থাকতে হবে, টুকটাক বাসন মাজা, রান্না করা আছে, তবে আসল কথা হলো তোমাকে ফ্ল্যাটটাতে থাকতে হবে। আসলে আমরা দু'জনেই চাকরি করি তো, ফ্ল্যাটে একা বয়স্ক শাশুড়ি মা থাকবেন, তোমাকে শুধু তাঁকে দেখতে হবে। টাকা পয়সার জন্যে কোনও চিন্তা করতে হবে না। যা বলবে তাই পাবে।"

মালতীর প্রথম থেকেই দাদা বৌদিকে খুব ভালো লেগে যায়। মালতীকেও ওরা খুব ভালোবাসে, কড়িকেও। প্রথম প্রথম কড়িকে নিয়ে যেত না, লক্ষ্মী মাসির কাছে বস্তিতেই রেখে যেত। বৌদি জানতে পেরেই বলে, "সেকি, তোমার ছেলে, তাকে রেখে আসবে কেন? নিয়ে এসো। এখানেই থাকুক। ঘরে তো সারাদিন শাশুড়ি মা ছাড়া আর কেউ থাকে না। তোমার ছেলেটা থাকলে তারও ভালো লাগবে।"

বৌদি কড়িকে একটা নতুন নামও দেয়,সবুজ।

দাদা বৌদি দু'জনই খুব ভালো। মালতী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যতক্ষণ থাকে ঘরটাকে নিজেরই মনে হয়। ফ্রিজ খুলে খাবার বের করে, স্নান করে। টিভি দেখে, কেউ কিছু বলে না। কড়িও সারাটা ঘরে ছোটাছুটি করে। কখনও বৌদির বুড়ি শাশুড়ির কাছে যায়। বুড়িটা সারাদিন বিছানার উপরেই থাকে। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়। বাকি সব কিছু বিছানার উপরে। মালতীর বুড়িটাকে দেখে খুব কষ্ট হয়। সে কষ্ট দাদা বৌদিকে দেখেও হয়। বেচারা, দশ বছর বিয়ে হয়ে গেলেও এখনও ছেলে মেয়ে হয়নি। বৌদিকে মাঝে মাঝে আড়ালে কাঁদতেও দেখেছে।

আরও পড়ুন- গোটা শাড়ির গন্ধ: ঋভু চট্টোপাধ্যায়

- কড়ি এই কড়ি, ওঠ বাবা, আমাদের যেতে হবে না! আজ স্টেশন হয়ে তারপর বৌদির বাড়ি যাব। তাড়াতাড়ি কর।

মালতী কথাগুলো বলবার সময়েই বাইরে একটা চিৎকার শুনতে পায়। বাইরে বেরিয়ে দেখে, পাড়ার কয়েকটা ছেলে বস্তির ঘরগুলোর টিন খুলতে আরম্ভ করে দিয়েছে। ঘরের চাল, চারদিকের দেওয়াল খুলে সব টিনগুলো একসঙ্গে জড়ো করে একপাশে রেখে দেয়। ভাঙার বড় গাড়ি বা লোকজন আসার আগেই সব এক্কেবারে গোটানো হয়ে যায়। ওরা কিছু সময় থাকে, গাড়িটা সামনে এনে একটা ছবি তোলে, কাগজের লোক আসে। তারাও ফটো নেয়। বস্তির দু’এক জনের সঙ্গে কথা হয়। তারপর আবার সব আগের মতো।

প্রতি বছর এই সময় মালতী কাজে যায় না। সারাটা দিন ঘরেই থাকতে হয়। কয়েক জন আসে, সেদিনের জন্য খাবার দেয়, জলের প্যাকেট দেয়। কয়েকটা পোঁটলা করে নিজেদের জিনিসপত্রগুলো কাছের স্টেশনে রেখে আসতে হয়। ছেলেটা আগে সেই লক্ষ্মীদির বস্তিতেই থাকত। ওদের বস্তিটা বেশ ভালো, কেউ ভাঙতে আসে না। ওদের নাকি নিজেদের মালিকানা আছে, তবে এবারে আর কড়িকে লক্ষ্মীদির কাছে রেখে আসতে হয়নি। বৌদি ঘর ভাঙার খবরটা শুনেই বলে ওঠে, "না না, তুমি সবুজকে অন্য কারও কাছে রাখবে কেন, যতদিন না সব কিছু ঠিক হচ্ছে ততদিন এখানেই থাকো। এমনিতে তুমি তো সারাটা দিনই থাকো, শুধু রাতটুকুর জন্যই তো ঘরে যাও। সেটাও যেতে হবে না।"

দাদাও বৌদির সঙ্গে গলা মেলান। সব ঠিক আছে, কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও তো সেই একটা কাগজে সই করাবে। তার সঙ্গে খাবার দাবার তো আছেই। সেইমতো কথাবার্তার পরে ঠিক হয় যতদিন মালতীর ঘরের অবস্থা স্বাভাবিক না হচ্ছে ততদিন সবুজ বৌদির বাড়িতেই থাকবে।

বৌদি এই কথাগুলো বলবার পরেও বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। “প্রয়োজনে আমি ছুটি নিয়ে নেব, আমাদের সবুজ এখানে ভালোই থাকবে।" কড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, "কী রে থাকতে পারবি না?" সবুজ এক গাল হেসে মাথা নেড়ে, 'হ্যাঁ' জানায়। তারপরের দিন কাজে যেতেই বৌদি মালতীর দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে বলে, "তুমি তো জানো আমাদের এখানকার সোসাইটি খুব কড়া। কে কোথা থেকে কী বলবে, তার থেকে তুমি এই কাগজটাতে সই করে দাও। কেউ এলে আমরাও দেখিয়ে বলতে পারব সবুজকে আমরা শুধু মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য রেখেছি।"

মালতী কাগজটাতে সই করে দেয়। বৌদি সেই মাসে মাইনে ছাড়াও আরও কিছু টাকা দিয়ে বলে, "এই নাও, তুমি কিছু কিনে নেবে।"

মালতী প্রথমটাতে একটু অবাক হলেও পরে নিজেকে বোঝায়। বৌদির ঘরে কাজ করবার পর থেকে খাবারের ব্যাপারে সেরকম চিন্তা না থাকলেও এই কয়েকটা দিন তো চিন্তা হবেই। নিজে বা কড়ি কোথায় থাকবে, খাবে, সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। কড়ি বৌদিদের কাছে থাকলে এই কয়েকদিন তার তো থাকা খাওয়ার কোনও চিন্তা থাকবে না। অসুবিধা একটাই, কড়িকে কাছছাড়া করেই থাকতে হবে।

 

মাথার উপর দিয়ে একটা ঝড় গেল। অন্যবার গাড়ি আসে, ঘর ভাঙার একটা অভিনয় করে, এবারে ঘর ভাঙার পর সব ভাঙা টিনগুলোও ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেল। বস্তির সবাইকে কয়েকটা দিন খোলা আকাশের নিচেই থাকতে হচ্ছিল। কেউ বা বাসস্ট্যান্ডে থাকল। মালতীর মতো কয়েকজনকে রেল স্টেশনের ভিতরেই থাকতে হল। খাবার ও জল পেলেও মাথার উপরে ছাদ পেল না। ঝগড়া, ঝামেলা, বাস-রাস্তা-রেল লাইন সব কিছু অবরোধ চলল। পুলিশের লাঠিতে কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তিও হতে হল। বিভিন্ন রঙের পতাকা বস্তির চারধারে দেখা গেল। তারপর আস্তে আস্তে সব কিছু শান্ত হলো। বস্তির পুরনো সবাই, পুরনো ও নতুন টিন দিয়ে আবার ঘর তৈরি করে থাকতে আরম্ভ করল। সবার চোখে মুখে শান্তির ছাপ। যাক! আবার বছর দুই তিনের জন্য নিশ্চিন্ত। মালতী মাঝে কয়েকবার বৌদিকে ফোন করে কড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, তার সঙ্গে কথাও বলেছে। বৌদিকে বলেছে, "আমি কয়েকদিনের মধ্যেই কড়িকে নিয়ে আসব।" এই কয়েকটা দিন মালতি বৌদির ওখানে কাজ করতে যায়নি।

আরও পড়ুন- চন্দ্রবিন্দু ডট কম: অমৃতা ভট্টাচার্য

সকাল থেকেই বস্তির সবাই একটু ব্যস্ত। যারা ভাঙতে বলে তারাই আবার এসে টিন, পেরেক সব কিছু দিয়ে ফের ঘরগুলো তৈরি করতে বলে গেছে। কয়েকজন লোককেও দিয়েছে। মালতীর ঘরটাকেও ওরাই তৈরি করে দেবে বলেছে। স্টেশন থেকে নিজের জিনিসের পুঁটুলিগুলো এনে একটা জায়গায় রেখে শান্তির শ্বাস নিয়েছে। "যাক বাবা, রাত থেকে নিজের ঘরেই ঘুমানো যাবে, এর থেকে বড় তৃপ্তি আর নেই।"

এবার কড়িকে ঘরে নিয়ে এলেই সব কিছু মিটে যাবে। মালতি বৌদিদের কমপ্লেক্সে যায়। টুকটাক যা কাজ আছে শেষ করে কড়িকে তাড়াতাড়ি নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। কমপ্লেক্সের গেটের কাছে যেতেই একটু ধাক্কা খায়। দারোয়ানটা মালতীকে আটকে নানা রকমের প্রশ্ন করে। একটু অবাক হয় মালতী, এই সপ্তাহ দুই আগে তো এখানে প্রতিদিন এসেছে। দারোয়ান প্রথম দিন শুধু একবার নাম আর কোথায় কাজ করতে যাচ্ছে এটাই জিজ্ঞেস করেছিল। তারপর কমপ্লেক্সে ঢুকত, বেরোত; কোনওদিন তো কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু এখন দারোয়ানটা বলে উঠল, "ওসব বদলে গেছে, এখন আমাদের সংস্থা এই কমপ্লেক্সের দায়িত্ব নিয়েছে।"

"দু' সপ্তাহের মধ্যে সব এমন বদলে গেল?" মালতী খুব অবাক হয়ে যায়। চিৎকার করে, বোঝাতে চায়।

কোনও উপায় না দেখে মালতী বৌদির কথা বলে, দাদার পরিচয় দেয়। দারোয়ান অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মালতী আর কোনও উপায় না পেয়ে বৌদিকে ফোন করতেই সুইচড অফ পায়। এবার মালতীর হাত-পা কাঁপতে থাকে, পেট ফুঁড়ে কান্না আসে। কড়ি ঠিক আছে তো, শরীর খারাপ হয়ে যায়নি তো? সেই সময় টুম্পার সঙ্গে দেখা হয়। একই কমপ্লেক্সের অন্য আরেকটা ফ্ল্যাটে ও কাজ করে। মালতী অস্থির হয়ে তার কাছে গিয়ে বলে, “এই দ্যাখ না, আমাকে এরা ভিতরে যেতে দিচ্ছে না, দাদার নাম শুনে বলছে এই নামে এখন কেউ থাকে না। এবার আমি কী করব বল?”

– ওরা তো গত পরশুই চলে গেছে, ফ্ল্যাটটা বন্ধ। এখানে তো সবাই বদলির চাকরি করে। ওই দাদা বৌদিও মনে হয় বদলি...

শেষের কথাগুলো আর মালতীর কানে ঢোকে না। তাহলে কড়ি? ওরা কি তাহলে... নাকি টুম্পা...

- তুই মিথ্যা কথা বলছিস টুম্পা। মালতী চিৎকার করে ওঠে।

টুম্পা কিছু উত্তর দেবার আগেই গার্ড বলে ওঠে, "এই এখানে এক্কেবারে চিৎকার করবে না। এটা ভদ্রলোকের পাড়া।"

মালতীর মুখের সামনে কমপ্লেক্সের ছোট গেটটাও বন্ধ করে দেয়। সেই সময়েই মালতীর ফোন বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে বস্তির ওখান থেকেই রামুদা ফোন করছে। এখানে আসবার সময় শুনে এসেছিল বস্তিতে নতুন টিনের ঘর হচ্ছে, রাতে একটা ফিস্টি হবে। মালতীর মুখের সামনে বৌদিদের কমপ্লেক্সের দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়, বৌদির ফোনও বন্ধ। মালতীর হাত, পা সব পাথর হতে আরম্ভ করে। কমপ্লেক্সের গেটের পাশে বসে থাকে। হাতে ফোনটা রিং হয়ে যায়। বৌদি... কড়ি....

More Articles