মোবাইল বেড়েছে, যোগাযোগ কমেছে! মুছে গিয়েছে ফোনবুথের অপেক্ষারা...
PCO Booth Nostalgia: ২০০৯-এ চিরদিনই-র সাফল্যের পর যে শীতঘুমে গেছিলাম সেই সুযোগে মানবসভ্যতা মুছে দিয়েছে আমার পুরনো বন্ধু ফোনবুথকে।
অপেক্ষাদের কেমন দেখতে বলুন তো? আমাদের প্রজন্মের অনেকেই এক নিঃশ্বাসে বলবে ল্যান্ডলাইন ফোনের মতো। আর ল্যান্ডফোন আমাদের বেশিরভাগেরই ছিল না, সব সময় টাকার জন্য নয়। লাইন পাওয়ার জন্য করতে হতো অনন্ত অপেক্ষা। ধরুন, ছেলের অন্নপ্রাশনের সময় দরখাস্ত করলেন, এল ছেলের পৈতেতে। পৈতেতে দরখাস্ত করলেন, এল বিয়েতে- এরম আর কী! তাই আমাদের যাদের ল্যান্ডফোন ছিল না তাদের ইনকামিং ছিল প্রতিবেশীর ভরসা, এসটিডি বুথ ছিল আউটগোইংয়ের আশ্রয়। লোকাল ক্লাবে ফোন থাকলে তাতে লক থাকাও বাধ্যতামূলক ছিল। প্রতিবেশীদের বাড়িতে ফোন তুলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মন-মাথার কথা ভাবতে হতো। ধরুন, তাদের বাড়িতে আত্মীয়বিয়োগ হয়েছে, তা সত্ত্বেও তারা আপনাকে ডেকে দিয়েছে। অথচ আপনি গিয়ে ফোনে দুর্গাপুরের দাদার বিয়ের খবর পেয়ে ও বাড়ির বৃদ্ধা দিদাকে জড়িয়ে ধরে একপাক নেচে দিলেন, এ তো হয় না! কিন্তু মুশকিল হয় যখন ফোনে সদ্য প্রেমের প্রস্তাব পাওয়া স্লোমো হয়ে যাওয়া কিশোরকে ফোনের বাড়ির জেঠু কোমরে হওয়া পাঁচড়া দেখাতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। সে কিশোর কী করে বোঝাবে প্রেম ও পাঁচড়ার ঐতিহাসিকভাবেই সহাবস্থান সম্ভব নয়। কিন্তু যার নেই ফোন তার আবার কীসের মন? অগত্যা মনে প্রেমিকার মুখ আর হাতে বোরিক তুলো নিয়ে জেঠুর কোমরের দিকে তাকাতে হয়।
এসব তো ফোন ধরার ঝঞ্ঝাট, কিন্তু খেলা জমত এসটিডি বুথে। নাহ, বলা ভালো এসটিডি বুথ আর লোকাল টেলিফোনের দোকানে। আচ্ছা, এই প্রজন্মের জন্য ফারাকটা বুঝিয়ে বলি। এসটিডি বুথ থেকে এসটিডি করা যায় অর্থাৎ বাইরে ফোন করা যায়। আর তখন এমনকী শিলিগুড়িও এসটিডির আওতায়।এসটিডি বুথ একটু খরচাসাপেক্ষ, তার জন্য আলাদা কাচের বুথ লাগে, ডিসপ্লে লাগে, যাতে কতক্ষণ কথা বলে কত খরচ হয়েছে তা জানতে পারেন খদ্দের। লোকাল ফোন বুথের সে দায় নেই, চিলতে ঘরে একটা ফোন লাগিয়ে দিলেই হল। দুটোর রেটও আলাদা ছিল। এসটিডি বুথে পাঁচ মিনিটে ২ টাকা, লোকাল বুথে ৩ মিনিটে দেড় টাকা। ডিসপ্লে না থাকার দরুণ খদ্দেরের সঙ্গে দর কষাকষিও হতো বিস্তর লোকাল ফোন বুথে! "কী বলছ? ৩ মিনিট হয়ে গেল? কই খুট করে যে আওয়াজ হয় তা তো পেলাম না?” এ আমাদের প্রজন্মের সবাই কম বেশি শুনেছে বা বলেছে। আর একটা জিনিস আজ ভাবতে বসে মনে পড়ল, লোকাল ফোন বুথের মালিকানা পেতে গেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী হলে কিছু সুবিধে মিলত বোধহয়, কারণ আমাদের পাড়ার এবং বাইরের পাড়ারও লোকাল ফোনের দোকানে অধিকাংশ সময় শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদেরই বসতে দেখতাম। আমি যখন বড় হচ্ছি, ততদিনে শহর কলকাতায় টেলিগ্রাম আসা বিরল হয়ে গেছে, মুদির দোকানের খামখেয়ালি টাকা চাওয়া ফোনের জায়গায় বাজারের প্রয়োজনে জন্ম হচ্ছে ফোনবুথের। ফোন হয়ে উঠছে আমাদের মূল যোগাযোগ মাধ্যম।
আরও পড়ুন- জামা ছিঁড়ে খালি গায়ে রঙ খেলার কাছে হাজার গোলে হেরে যায় তিন আঙুলের আবিরের দোল
আজ যখন ফিরে ভাবতে বসি, ওই ক'টা বছর ফোনবুথ আসলে কী জরুরি হয়ে উঠেছিল জীবনে, ভাবতে অবাক লাগে। আমার ক্লাস এইট, লাইব্রেরি থেকে সন্ধ্যেবেলা বই নিয়ে ফিরছি, হঠাৎ দেখি আমার দিদার বোন গীতাদি এসটিডি বুথের সামনে বসে কাঁপছে। দৌড়ে কাছে যেতে খবর পেলাম, হাসপাতাল থেকে ফোন করতে বলেছিল, দাদু ভর্তি আছেন। এখন ফোন করেছে গীতাদি, ওরা কী বলছে গীতাদি কিছুই বুঝতে পারছে না! হাসপাতাল নাকি বলছে আমার দাদু আর নেই! নেই মানে নেই? গতকাল যার বেডের পাশে বসে, হাসপাতাল থেকে দেওয়া তাঁর ভাগের ছানা তাঁর হাসিমুখের সামনে বসে খেয়ে এলাম সে আর নেই? আমার জীবনে কাছ থেকে দেখা প্রথম মৃত্যু সেটা, গীতাদির মতোই আমিও কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শুধু টের পাচ্ছিলাম আমার শৈশবের একটা অধ্যায় শেষ হচ্ছে, ফোনবুথের সামনে।
অভিনয় করতে পারায় একটা বয়সে বন্ধুদের মধ্যে আমার আকাশ ছোঁওয়া চাহিদা হয়েছিল। আসলে আমাদে দু' দেড় টাকা খুব দামি ছিল, তা সুযোগের হাতে ছাড়ার সুযোগ আমাদের ছিল না। কে ফোন তুলবে, কে তা বলবে? তাই আমাকে মেয়ের গলা করে বন্ধুর প্রেমিকার বান্ধবী সেজে বন্ধুকে উদ্ধার করতে হতো।নিজেকেও উদ্ধার করতাম একই উপায়ে। একটা ফোনবুথেই জীবনে প্রথমবার টের পেয়ে ছিলাম আমি যথেষ্ট ভালো নই প্রেমিক হিসেবে। আবার এই ফোনবুথই স্রোতে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছে এই বলে যে, আমি অভিনেতা হিসেবে নেহাত খারাপ নই। আমার প্রথম অডিশন ক্র্যাক করা থেকে দাদার চাকরি, বাবার একটা সিনেমায় রোলের চেষ্টা থেকে মায়ের নালিশ- কী না শুনেছে ফোনবুথ।
২০১৫-১৬ হবে, হায়দরাবাদ শহরে ফোন হারিয়ে গেল। অচেনা শহর, তায় হাতের মোবাইল খোওয়া গেছে। মা চিন্তা করছে, একান্তই জানানো দরকার যে পৌঁছে গেছি। গোটা শহর ঘুরে টের পেলাম ২০০৯-এ চিরদিনই-র সাফল্যের পর যে শীতঘুমে গেছিলাম সেই সুযোগে মানবসভ্যতা মুছে দিয়েছে আমার পুরনো বন্ধু ফোনবুথকে। অগত্যা নতুন মোবাইল কিনতে হলো। পাসওয়ার্ড দিলাম, "একদিন তুমিও থাকবে না”।