টু অশোক রায়, ডিয়ার স্যার : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
Bengali Short Story : এই সেদিন হাত ধুতে ধুতে অশোকবাবুর মনে হলো, অশোকবাবুর বাঁ হাতের আঙুলগুলো ডান হাতের আঙুলের থেকে ছোট।
অশোক রায়ের ঠিকানায় আর কোনও চিঠি আসে না।
মানে গত দু'মাস অশোক রায়ের লেটার বক্স ফাঁকা। রোজ অন্তত তিনবার করে বক্স খুলে দেখেন অশোকবাবু। যদিও তিনি জানেন, পোস্টম্যান দুপুরের দিকেই আসে এবং দিনে ওই একবারই আসে। তবু, অশোকবাবু দিনে তিনবার লেটার বক্স খুলে দেখেন। বলা যায় না, যদি কোনওদিন পোস্টম্যান দুপুর পেরিয়ে আসে? কোনও কোনও দিন পোস্টম্যানেরও ভুল হতে পারে। অশোকবাবু প্রায় দু'মাস পোস্টম্যানের ভুলের অপেক্ষা করেন। সকালে, দুপুরে আর বিকেলে। ওষুধের মতো। এমনিতে অশোকবাবুকে চিঠি লেখার মতো তেমন কেউ খুব একটা নেই। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সকলেই হয় মারা গেছে বা ছেড়ে গেছে। বেশ কিছু বছর সংসার করার পরে অশোকবাবুর স্ত্রীও সূর্যশেখরের সঙ্গে অন্য ঘর বেঁধেছে। ঠিক কী কারণে চন্দ্রিমা ছেড়ে গেছিল সেটা এত বছর পরে অশোকবাবু মনেও করতে পারেন না। মাঝেমাঝেই বিভিন্ন রকমের কারণ মনে পড়ে। এই সেদিন হাত ধুতে ধুতে অশোকবাবুর মনে হলো, অশোকবাবুর বাঁ হাতের আঙুলগুলো ডান হাতের আঙুলের থেকে ছোট। হয়তো এটা অশোকবাবুর আগেই চন্দ্রিমা খেয়াল করেছিল। অমন ছোট আঙুলের অশোকবাবুর সঙ্গে সংসার করা কি কোনওদিন সম্ভব? সূর্যশেখরের বাঁ হাতের আঙুলগুলো কেমন অশোকবাবু জানেন না। কোনওদিন দেখেননি। যদি সুযোগ পান তাহলেও হয়তো দেখবেন না। এড়িয়ে যাবেন।
কিংবা এটাও তো হতে পারে, অশোকবাবু জুতো না পরে চটি পরেন বলেই চন্দ্রিমা ছেড়ে গেল। কিন্তু সূর্যশেখরবাবুও তো মাঝে মাঝে চটি পরেন। অশোকবাবু নিজের চোখে দেখেছেন। হয়তো চটি বা আঙুল নয়, অন্য কোনও আরও কঠিন কারণে চন্দ্রিমা অশোকবাবুকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো চন্দ্রিমার খুবই কষ্ট হয়েছে। হয়তো সূর্যশেখরবাবুকে জড়িয়ে ধরে চন্দ্রিমা একদিন অশোকবাবুর জন্যই খুব কেঁদেছে। কী ঠিক হয়েছিল, অশোকবাবু মনে করতে পারেন না আর এখন। অত মনে করার সময়ও পান না। দিনে দু'বার বাজার যাওয়া, একবার ব্যাঙ্কে যাওয়া ছাড়াও এখন অশোকবাবুর নতুন কাজ হয়েছে তিনবার লেটার বক্স খুলে দেখা, কোনও চিঠি এল কিনা।
আরও পড়ুন- পোলিং পার্টি ১৩৫ : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
মাঝে মাঝে অশোকবাবু খুবই অবাক হন। তিনি ভেবেও পান না, মাত্র দু'বছর আগে যখন অশোকবাবুর অফিস ছিল তখন এই কাজগুলো না করে কী করে চলত! তখন তো সপ্তাহে দু'দিন বাজার আর মাসে একবার ব্যাঙ্ক গেলেই চলে যেত। কিন্তু কী করেই বা চলত? আর এই দু'বছর রিটায়ার করার পরে কেনই বা অশোকবাবুকে রোজ দু'বার বাজার যেতেই হয়? কেনই বা রোজ কিছু না কিছু ভুলে যাবেনই? আর অশোকবাবু ব্যাঙ্কে গিয়ে কী করেন সেটা অবশ্য আমিও জানি না। কিছু একটা করেন নিশ্চয়ই। কেউ কেউ বলে, অশোকবাবু নাকি রোজ ব্যাঙ্কে গিয়ে রোজের খরচটুকু তুলে আনেন। রোজ একশো টাকা। যদি একশো টাকা থেকে কিছু বেঁচে থাকে তাহলে পরের দিন সেটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আবার একশো টাকা তোলেন। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার এই নিয়ে খুবই বিরক্ত। কিন্তু অশোকবাবুও ব্যাঙ্কের অনেক নিয়ম জেনে তারপরেই গেছেন। ম্যানেজার বাধ্য, কিন্তু চন্দ্রিমা তো বাধ্য ছিল না। অশোকবাবুর এই অভ্যাসের জন্যই যে চন্দ্রিমা ছেড়ে যায়নি এমন কেউ বলতে পারে না। তবে সেটা নাও হতে পারে। এই মাত্র দু'বছর আগেও তো অশোকবাবু রোজ কেন, মাসে একবারও ব্যাঙ্কে যেতে পারতেন কিনা সন্দেহ। আর চন্দ্রিমার চলে যাওয়া তো প্রায় পনের বছর পেরিয়ে গেল। পনের বছর পরে সে-সব মনে রাখা কঠিন। বরং এখন অশোকবাবুর আসল দুশ্চিন্তা চিঠি। প্রায় দু'মাস অশোকবাবুর নামে কোনও চিঠি আসে না।
শেষ চিঠি এসেছিল ইনসিওরেন্স কোম্পানি থেকে। ঠিকানায় লেখা ছিল, টু অশোক রায়, জি. আর. সরণী, সিউড়ি, বীরভূম। চিঠি খোলার পরেই 'ডিয়ার স্যার'। অশোকবাবুর চোখ আটকে যেত ওখানেই। টু অশোক রায়। ডিয়ার স্যার। গোটা ঘর জুড়ে উড়ে বেড়াত ডিয়ার স্যার। যেন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্যারেড স্যালুট করে যাচ্ছে অশোক রায়কে। যেন মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে "মিস্টার অশোক রায়, ডিয়ার স্যার"। তারপর কী লেখা থাকত, কী থাকত না অশোকবাবু খেয়ালও করতেন না। কখনও ব্যাঙ্কের থেকে, কখনও ইনসিওরেন্স থেকে, কখনও কোনও কোম্পানির থেকে ডিয়ার স্যার লেখা চিঠি আসত। অশোকবাবু এই দু'বছরের সমস্ত চিঠি জমিয়ে রেখেছেন। এক বাক্সভর্তি চিঠি। শুধু এই চিঠি পাওয়ার লোভে অশোকবাবু কত কত কোম্পানিতে কত রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে চিঠি পাঠাতেন। ফার্নিচার কোম্পানিকে চল্লিশ জোড়া চেয়ারের দাম জানতে চেয়ে, পাবলিশারকে পাঁচ হাজার বই ছাপানোর খরচ জানতে চেয়ে, ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর কোম্পানিকে ইওরোপ ঘোরার ডিটেলস জানতে চেয়ে অশোকবাবু চিঠি লিখতেন। তারপর সমস্ত উত্তরের 'ডিয়ার স্যার'-টুকুই অশোকবাবু হাত বুলিয়ে বুলিয়ে পড়তেন। বাকি চিঠি পড়ার কোনও দরকারই ছিল না কোনওদিন। তারপর আর কোনও কোম্পানিকেই উত্তর দিতেন না তিনি। ছোটবেলায় অচেনা বাড়ির দরজায় কলিংবেল বাজিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো। অশোকবাবুও ওই 'ডিয়ার স্যার'-টুকু নিয়ে পালিয়ে যেতেন। আবার অন্য কোনও কোম্পানিকে অন্য কোনও প্রসঙ্গে চিঠি লিখে উত্তরের অপেক্ষা করতেন। কিন্তু দু'মাস হয়ে গেল অশোকবাবুর ঠিকানায় কোনও চিঠির কোনও উত্তরই আসে না আর।
আরও পড়ুন- আয়না ভবন : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
দু'মাস অপেক্ষা করার পরে অশোকবাবু একদিন সোজা পোস্টঅফিসেই গিয়ে পৌঁছন। পুরনো পোস্টম্যান পালটে গেছে। এখন নাকি নতুন একজন এসেছেন। খুঁজে খুঁজে অশোকবাবু বার করেন কোন পোস্টম্যান এখন জি. আর সরণীতে চিঠি দিতে যান। অবাক কাণ্ড! তিনি তো এই দু'মাসে প্রায় কুড়িটা চিঠি অশোকবাবুর ঠিকানায় নিজে হাতে দিয়ে এসেছেন। টু অশোক রায়, জি. আর. সরণী, সিউড়ি, বীরভূম। তাহলে? অশোকবাবু পাচ্ছেন না কেন? কেউ কি অশোকবাবুর চিঠিগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে? পরপর তিনদিন অশোকবাবু দুপুর থেকে বিকেল অব্দি ছাদে লুকিয়ে লুকিয়ে পাহারা দেন। পোস্টম্যানকে বলা আছে, যেদিন অশোকবাবুর নামে চিঠি থাকবে সেদিন ওই গলিতে ঢুকেই পোস্টম্যান হাত নাড়বে। অবশেষে পোস্টম্যান একদিন হাতও নাড়ে। তখুনি ছাদ থেকে প্রায় দৌড়ে অশোকবাবু নীচে নামেন। এ কী! লেটারবক্স ফাঁকা। পোস্টম্যান এখনও বেশিদূর যায়নি হয়তো। অশোকবাবু খালি পায়েই রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। ওই তো পোস্টম্যান! প্রায় দৌড়েই অশোকবাবু পোস্টম্যানের কাছে পৌঁছন।
"আরে আমার চিঠি কই? হাত নাড়লেন যে।"
"হ্যাঁ, দিলাম তো। আপনার লেটারবাক্সে দিয়ে এলাম যে। অশোক রায়, জি. আর. সরণী, সিউড়ি, বীরভূম।"
"কই চিঠি? চলুন দেখবেন!"
পোস্টম্যান ফিরে এসে অশোকবাবুকে তার পাশের বাড়ির লেটারবক্স দেখিয়ে যান। "ওই তো আপনার চিঠি।"
"এই লেটারবাক্সে কেন রেখেছেন আমার চিঠি? ওই পাশের বাড়িটা তো আমার।"
যাক, অন্তত এতদিন পরে আবার একটা চিঠি। ভেতরে আবার 'ডিয়ার স্যার'। যেন বিউগল বেজে উঠছে। প্যারেড এগিয়ে আসছে। প্যারেড করে এগিয়ে আসছে চন্দ্রিমা, সূর্যশেখর, পোস্টম্যান সবাই। অশোকবাবু চিঠিটা নিতে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তেই পাশের বাড়ির দরজা খুলে এক ভদ্রলোক। অশোকবাবু অবাক হন অল্প। এই ভদ্রলোককে কোনওদিন দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।
"নমস্কার। আসলে আমার চিঠিটা ভুল করে আপনার বাক্সে। আপনি?"
"হ্যাঁ। নতুন ভাড়ায় এসেছি। আমার নাম অশোক রায়।"
আরেকজন অশোক রায়! তাহলে কি এই চিঠিটা নতুন অশোক রায়ের? সেটাই হয়তো হবে। এত ডিয়ার স্যার, এতদিনের ডিয়ার স্যার অশোকবাবুর হতে পারে না। চন্দ্রিমা, পোস্টম্যান, ঠিকানা কোনওকিছুই পুরোপুরি অশোকবাবুর হতে পারে না। নিজের জীবনে নিজেই যেন চুরি করে ঢুকে পড়েছেন অশোকবাবু। এই ঠিকানাটাও হয়তো অশোকবাবুর প্রাপ্য নয়। যদিও তার কী কারণ সেকথা অশোকবাবু জানেন না। জানতে চানও না। তাই চিঠিটা না খুলেই নতুন অশোক রায়ের কাছেই রেখে ফিরে আসেন অশোকবাবু। ভাবেন আরেকবার ফিরে যাওয়া উচিত হবে কিনা। এভাবে কি কাউকে বলা যায়, "আপনার বাঁ হাতের আঙুলগুলো দেখাবেন একটু?"