অদিতি যে ক'টি ভাষায় কথা বলে : অলোকপর্ণা

Bengali Short Story: সুপরিচিত ট্যাটুশিল্পী অদিতিকে জিজ্ঞেস করে, “Who is B? And who is S?” অদিতি মুখ টিপে হাসে।

অদিতিকে অনুবাদ করতে পারে এরকম দু' তিনজন এখনও টিকে আছে শহরে। মাঝে মাঝে অবুঝ হলে অদিতি তাদের কাছে যায়, অনুদিত হয় কয়েক ঘণ্টা এবং সফল অনুবাদ শেষে ফিরে আসে। তখন তার গা-হাত-পা ভরে থাকে ডোরা ডোরা অক্ষরে। অদিতির সারা শরীর জুড়ে শব্দরা ঘুরঘুর করে, কচুরিপানার মতো অদিতির চামড়ায় এদিক ওদিক ভেসে বেরায়। অদিতির সুড়সুড়ি লাগে ঘাড়ে, গলায়, কানের পিছনের নরম ত্বকে। টুঁটি কামড়ে ধরে থাকা শব্দদের যাতনা সহ্য করে জন্মদিনের আগে সে সারাটা রাত, ঘুমের মধ্যে। আর অদিতির বর শোনে ঘুমন্ত অদিতি স্বপ্নের ভিতর কথা বলে চলেছে নিজের সঙ্গে,

• “কেউ যদি বলে কখনও সমুদ্র দেখেনি, আমার মন খারাপ করে তার জন্য।”
• “কত মন খারাপ? খুউব মন খারাপ।”

লোকটা পাশ ফিরে শোয়। অদিতি শূন্যে হাত বাড়ায়। অদিতির হাত কোথাও পৌঁছতে পারে না ঘুমের ঘোরে।

অনুবাদক ১ পুরুষটি অদিতির সঙ্গে আকণ্ঠ মদ পান করে শ্যামবাজার থেকে টলতে টলতে কাশীপুর অবধি গিয়েছিল গত শনিবার রাত আটটার পর। পথে কালীপ্রসন্ন সিংহ রোডের কাছে এসে পুরুষ অনুবাদক সুলভ শৌচালয়ে হালকা হতে ঢুকেছিল। অদিতিও হালকা হতে যায় স্ত্রী শৌচালয়ে এবং দেখতে পায় হলুদ দেওয়ালে লাল দিয়ে লেখা b+s। ভারী ভালো লাগে তার, হলদে দেওয়ালে রাঙা অক্ষরদুটো। হালকা হতে হতে সে দু' চোখ ভরে লেখাটা দেখে।

হালকা হয়ে বেরিয়ে এলে খেয়াল হয়, একে অপরকে তাদের ছোঁয়া হয়নি সেই সন্ধায় একবারও, অতঃপর অন্ধকারে ফুটপাথের একপাশে বোগেনভিলিয়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অদিতিকে অনুবাদক পুরুষটি একটি খোলতাই চুম্বন উপহার দেয়। অদিতিরা এরপর ফের টলতে টলতে কাশীপুরের দিকে এগিয়ে চলে এবং তারা কাশীপুরের অস্ত্র কারখানা সম্পর্কে গভীর আলোচনায় মগ্ন হয়। এই সময় অদিতি অনুবাদকের ব্যক্তিগত অস্ত্রের প্রতি আগ্রহ দেখালে তারা স্থির করে রাতটি একসঙ্গে কাটাবে। কিছু পরে অনুবাদকের বিছানায় অনুদিত হতে হতে অদিতি খেয়াল করে দেওয়াল থেকে ঝুলে থাকা ছবিতে অনুবাদকের মৃত মায়ের মুখটি তার ভীষণ পরিচিত। কিন্তু আজকাল স্মৃতি বেইমানি করছে বলে অদিতির আক্ষেপ হয় সেই মুহূর্তে। অদিতি প্রাণপণ চেষ্টা করে, তবু স্মৃতি ফসকে যায়।

আরও পড়ুন- কবিতা ও তার মাকড়সা: অলোকপর্ণা

সকাল হলে অনুবাদক আগত জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে অদিতিকে রিকশায় তুলে দিয়ে বলে, “সাবধানে যাস।”

অদিতি সাবধানে যায় দ্বিতীয় অনুবাদকের কাছে।

রবিবার দুপুর দুপুর অদিতি আর অনুবাদক ২ মেয়েটি পাশাপাশি হাঁটে অনেকক্ষণ। মেয়েটি তাকে একটি শূন্য, রিক্ত মাঠে নিয়ে গিয়ে বলে বসে, “শুভ জন্মদিন”। ঘেয়ো কুকুরের মতো রিক্ত মাঠ, তবু তাকে ঋণী করে সোনালি বৃষ্টি পড়ে অকস্মাৎ। অদিতি হাত তুলে মেয়েটিকে সেই বৃষ্টি দেখায়। তারা বৃষ্টি দেখে একত্রে। মেয়েটি সাহস করে অদিতির দিকে হাত বাড়ায় আর ধরে ফেলে অদিতির হাত। তারা অনেক অন্ধকার অবধি হাত ধরে হাঁটে, যোধপুর পার্ক থেকে যাদবপুর এইট বি অবধি। মাঝ রাস্তায় সিগারেটের দোকান দেখে অনুবাদক থামে, আগুন খোঁজে অনুবাদক, অদিতি আগুনের সন্ধান দেয়। এই প্রসঙ্গে কথা এগোলে অদিতিকে আলিঙ্গন করে অনুবাদক, অদিতির থেকে কিছুটা আঁচ নেয় সে পথের আঁধারে মশাল হবে বলে। তারা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একে অপরকে দখিনা চাঁদ দেখায়। তারা পাহাড়ের কথা, জঙ্গলের কথা, সমুদ্রের কথা বলে।

অনুবাদক ২ বলে, “কেউ যদি বলে কখনও সমুদ্র দেখেনি, আমার মন খারাপ করে তার জন্য।”
অদিতি- “কত মন খারাপ?”
অনুবাদক ২- “খুউব মন খারাপ।”

অদিতি ট্যাক্সি ডাকে সোচ্চারে, ট্যাক্সিতে উঠে ঘন হয়ে বসে অনুবাদক মেয়েটির হাত নিজের হাতে নিয়ে খুব করে কচলাতে থাকে, মেয়েটির গলায় মুখ গুঁজে দেয়। অনুবাদক মেয়েটি অদিতির চুলে নাক ডুবিয়ে গন্ধ শোঁকে বুক ভরে, অনুবাদক মেয়েটি অদিতির আঁচে উষ্ণ হয়ে ওঠে। তারা উল্টোডাঙা এসে পৌঁছলে অদিতি নেমে যায়।

রাস্তা পার হবে অদিতি, এই সময় দেখে চেয়ে দেখে, মিষ্টির দোকানের উর্ধ্বে, ফুটব্রিজের গায়ে বশীকরণ, সরকারি চাকুরি, প্রেমে বিফলতা ইত্যাদি মুশকিলের আসান “মা মাতঙ্গী”র বিরাট এক বিজ্ঞাপন, মুখটি অবিকল অনুবাদক ১ এর মায়ের দেওয়াল থেকে ঝুলে থাকা ছবির মুখের মতো।

স্মৃতি খসে যাওয়ার আগে অনুবাদক ১ কে দেখাবে বলে অদিতি বিজ্ঞাপনের ছবি তুলে রাখে। এরপরের দিন অনূদিত হওয়ার সময় ছবিটি একান্তে জাহির করা যাবে।

আরও পড়ুন- বড়দিন : অলোকপর্ণা

বাড়ি ফিরে অদিতি একটু বেড়াল ঘাঁটে। একটু রান্নাঘরে যায়। চিজ অমলেট খেতে খেতে অদিতির মুখ থেকে আনন্দের শীৎকার নির্গত হয়। ক্ষুধার অতীত ক্ষুরধার তৃপ্তির সন্ধান অদিতি পায়নি এখনও অবধি। সে নিজের আঙুল চাটে কুকুরের মতো। অদিতি নিজের চুল মুঠো করে নিজের নাকে মুখে চেপে ধরে, তারপর রান্নাঘরে টুলে বসেই অদিতি নিজেকে অনুবাদ করে বেশ কিছুক্ষণ। বারোটা বাজলে অদিতি নিজেকে “শুভ জন্মদিন” বলে।

জন্মদিনের সকাল এগারোটায় অদিতি ট্যাটু পার্লারে যায়, গিয়ে কবজিতে ছোট করে b+s লেখায়। সুপরিচিত ট্যাটুশিল্পী অদিতিকে জিজ্ঞেস করে, “Who is B? And who is S?”

অদিতি মুখ টিপে হাসে। জবাব দেয়, “কেউ না। তবে, তাদের মধ্যে ভাব আছে, ভালোবাসা আছে।” ট্যাটুশিল্পী হেসে জানতে চায়, “বয়স কত হলো তোমার অদিতি?” “তিনশত পাঁচ বৎসর!” হাসতে হাসতে নিজের ভাষায় জবাব দেয় সে।

More Articles