লেনন ওয়াল: স্বাতী গুহ
Bangla Short Story: প্রাগ শহরের এক অখ্যাত পাড়ায় সকালের নহবৎ বেজে ওঠে। সুরে মিলে যান বিসমিল্লা আর লেনন।
সকাল সকাল বিভ্রাট। মাঝরাত থেকে খুব বৃষ্টি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে নতুন ঠিকানা খুঁজে বের করা সহজ হবে না ভেবে একটা ফাঁকা চেয়ার পেয়ে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। তেরেজাকে একটা ফোন করলেই সময়টা কিছুটা অন্যরকম হতে পারত। নীনার মাথার ভিতর সারাটা সময় শুধু বাজছিল - ‘অল ইউ নিড ইজ লাভ'! গত কয়েক বছর থেকে নীনা এই ‘ইউ’-টাকে ‘উই’ করে নিচ্ছিল নিজের মাথার ভিতর। ঘিলুর ভিতর। প্রতিটা নিউরোনে চারিয়ে দিতে চাইছিল। এখনও চাইছে। কারণ, এখনও পারছে না। অনেকটা বাকি। তেরজার সঙ্গে গত চার-পাঁচ বছর। একটাই অ্যাজেন্ডা ঘুরে ফিরে। কিন্তু বারবার ভেঙে যাচ্ছে পৃথিবীটা। পাসপোর্টে পাতা শেষ হয়ে গেছে এর মধ্যে কয়েকবার। তবু কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না কিছুই।
য়ুভালের কথাই আসলে ঠিক। অন্তত আজকাল বড় বেশি সত্যি মনে হয়। মানুষ আসলে কিছু গল্পে বাঁচে। নীনাও কি তাই? একটা গল্প থেকে আর একটা গল্পের জন্ম হবে বলে সারা রাত নিজেকেই যেন তা দেয় । ডানা দুটো বড্ড ভারী লাগে ওর মাঝেমাঝে। মনে হয় মায়ের আলমারির হ্যাঙারে ঝোলানো শাড়ির মতো ঝুলে থাকে। যেন কেউ কোনোদিন আর সে শাড়ির ভাঁজ খুলে দেখবে না। কিংবা খুললেই চোখে পড়বে পরতে পরতে পিঁজে গেছে শাড়ির শরীর! নীনা আর তেরেজার গল্প তেমন নয়। অন্তত সেই আকুতিতেই বারবার দেখা হয়। কিংবা দেখা হয় না। সবটাই সেই স্যুরিয়াল! কিছু একটা আছে। কোথাও একটা আছে।
আরও পড়ুন-হনুমান চর্চা : বেবী সাউ
প্রাগ শহরে প্রথমবার এসেছিল চালর্স ব্রিজের টানে। ভয়ংকর উত্তেজনা ছিল সেবার। কাফকার বাড়ি । জানালা থেকে দেখা নদীটার শুয়ে থাকা শরীরে কেমন একটা টান। কিন্তু এবারে একেবারে অন্য ভাব। অন্য ভাবনা! কার্লভ মস্ত-এ থাকার জায়গা। অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা। যার বাড়িতে থাকা, তার সঙ্গে দেখা তো দূরস্ত, কথাও হয় না। অথচ সব তথ্য আদানপ্রদান চলে। অথচ দামেক ওর সব খবর জানে। এয়ারবিএনবি জানে নীনার ঠিকুজি-কুষ্ঠি। তবু সকালে পৌঁছে ফোনের ই-মেল ঘেঁটে একটা নম্বর খুঁজে পেতে কেমন নার্ভাস লাগে। মনে হয় যদি না খুঁজে পায় তো কী হবে! তেরেজাকে আবার অনেক ধকল পোহাতে হবে। নীনা সেটা চায় না। এই এক আশ্চর্য খেয়াল ওর। যাকে ভালোবাসে তাকে কিছুতেই জ্বালাতে চায় না। সারাক্ষণ ভাবে কীভাবে ঝামেলা এড়ানো যায়। হয় না। তবু ভাবে। আবার ই-মেল খোলে। পরতে পরতে তথ্যের আদান-প্রদান। হঠাৎ একটা নতুন ই-মেল। সেখানে ওপিটি। দরজায় লাগানো মেশিনে মাত্র ছ'টি নম্বর ডায়াল করতেই একটা ছোট্ট স্ক্রিন আলো হয়ে ওঠে। একজন মানুষের মুখ আকার। মুখ নয়। গলায় অনেকটা মিঠে ঢেলে বলে, ‘এখনও দু'ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আগের অতিথি ওভারস্টে করেছে। নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ সারা হতে দু'ঘন্টা সময় চাই। নীনা কিছু উত্তর কিংবা জিজ্ঞাসা উচ্চারণ করার আগেই স্ক্রিনের আলো নিভে যায়। সেখানে তখন লেখা ছিল শুধু, ‘সরি ফর ইনকনভিনিয়েন্স'!
নীনা জানে, এর পর আর কোনও কথা চলে না। তেরেজার ফোন নম্বর ডায়াল করে। সম্ভাষণবিহীন তেরেজা কেঁদে ফেলে, 'আমার মনে হয়েছে তুমি হারিয়ে গেছো। আর কোনোদিন তোমাকে শোনা হবে না আমার। দেখাও হবে না।' লেননের গানের সুর তখনও মাথার মধ্যে। ঝিমঝিম করে কী যেন একটা ঝরে পড়ে। তেরেজা কথা বলেই চলে। নীনা কিছু শোনে। কিছু শোনে না। শুধু বোঝে। কিংবা বুঝে উঠতে চায়। সকালের প্রাগ শহরে একটু একটু করে আলো ফুটে উঠতে থাকে। দু'একটা গাড়ি রাস্তা পেরোয় দ্রুত। তেরেজার কান্না কিছুটা শ্লথ হয়ে এলে নীনা শুধু বলে,‘আমি অপেক্ষা করছি।' পার্কের একটা পাথরের চেয়ারে এসে বসে। কোনও ক্লান্তি নেই। কোনও রাগও নেই এয়ারবিএনবি-র আহাম্মক ছায়ামানুষের ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার কলা-কৌশলে! যেন সবটাই স্বাভাবিক। যেন সবটাই ক্ষমা করে দেওয়ার।
‘আইসোলেশন’ বড্ড পছন্দের নীনার। লেননের সঙ্গে মনে মনে খুব ঝগড়া তার। কিন্তু তেরেজাকেও বলতে চায় না সে, এই একা থাকাও বড় আরামের । একাকিত্বও বড় ভালোবাসার! তবু লেননের কথা মতো একটা ঘরের জন্য তাকে প্রাগ শহরের পার্কে অপেক্ষা করতে হবে দুটি ঘন্টা। যেন এটাই ওর নিজস্ব সময়। ওই ঘর, ঘরের দরজা, দেয়াল, বিছানাপত্র, রান্নাঘর – সবকিছু যেন দামেকের। যে দামেককে সে দেখতে পাবে না এক মুহূর্তও। অথচ, সেই মানুষটা নীনাকে পুরোটা তক্কে তক্কে রাখবে । সামান্য পান থেকে চুল খসলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে। একটা জলের গ্লাস ভেঙে ফেললেও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজে চলে আসবে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ। ঘর ছেড়ে বেরোতে পারবে না তুমি সবটা ঋণ না চুকিয়ে-বুকিয়ে দিয়ে। অথচ, কত ঋণ যে সে মকুব করেছে সারাজীবন! ভুলে গেছে কি সব? না । অতটা সহজ নয় বাঁচা! মানুষ ভুলতে চায়। নীনাও। কিন্তু কেমন যেন সব পায়ে পায়ে চলে।
তেরেজার সঙ্গে এক একটা দিন সেসব কথা নিয়ে গভীর গল্প জমে। তেরেজা এখন ও তেমন একজন মানুষ, যে সেসব গল্পকে কেমন মিথের মতো ভাবে। সবটাই মনে হয় ওর ‘এমনই হওয়ার কথা !' তখন নীনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, আরও কিছুটা হাঁটা যায়। পৃথিবীটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে যখন তখন ও য়ুভালের সেই ফিক্শনের তত্ত্বকে নতুন করে লিখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে প্যালেস্টাইনের ক্রমশ চেপটে যাওয়া মানচিত্রটাকে ভার্টিক্যালি দেওয়ালের মতো দাঁড় করিয়ে দিতে। শুয়ে পড়া মানুষের মাথা আর একবার কি তবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া সম্ভব হতে পারে! সকালের মিঠে হাওয়ার ভিজতে ভিজতে লেনন-ই যেন বাঁচিয়ে দেয় ওকে। সত্যিই তো নীনা আর একবার আশা করে না কেউ ওকে বুঝুক।
আরও পড়ুন- টু অশোক রায়, ডিয়ার স্যার : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোটবেলার সেই বীরভূম জেলার লালমাটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সকালের স্কুলে যে গান গাইত ওরা সবাই মিলে, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু...', অর্চণাদির গলায় সত্যি হয়ে উঠত শেষতম অনুভব ‘তবু আনন্দ, তবু আনন্দ জাগে...'! লেননের ছোটবেলাটাও বারবার ধস্ত হয়েছে। সমুদ্রপ্রেমিক বাবার গায়ের গন্ধে যে নোনা আস্বাদ, ভুলে যেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু মাসির বাড়ির ছবির বই, মিউজিক্যাল ইনসট্রুমেন্ট, সমবয়সি ভাইবোনদের সঙ্গে বেড়ে উঠতে উঠতে কখনও কখনও রাত রাত জেগে ওকেও তো খুঁজতে হয়েছে আলোর রঙগুলিকে। তাই কি বড় হয়েও লিখতে হল, ‘উই আর অ্যাফ্রেড অফ এভরি ওয়ান/ অ্যাফ্রেড অফ সান...’? ফিরে ফিরে এসেছে একাকী কিংবা একাকিত্বের ঘ্রাণ। কলেজ স্কোয়ারের জল ঘেঁষে পেতে রাখা লোহার বেঞ্চে দিনদুপুরে অফিস পালিয়ে বসে থাকতে হত মাল্যবানকে। কেন? সেও কি তবে ভয় পেত সূর্যকে? সূর্যের আলোর তীক্ষ্ণতাকে! নীনার মাথার মধ্যে এসব ঘোট পাকায় দিন-রাত। রাত- দিন!
দিনের আলোর চাপ বাড়তে থাকে একটু একটু করে। গাড়ির গতি শ্লথ কখনও কখনও। তেরেজা এসে পড়বে যে কোনও মুহূর্তে। তবু একা থাকা যেন একা থাকা নয়। জন্মাবধি যে সব ঘটনা ঘটে গেল সামনে-পিছনে, আড়ালে-আবডালে তার সবটুকু নিংড়ে নিয়ে মাথার পরতে পরতে যেন এক অন্য বর্ণমালা। অন্য অধোগঠন । অন্য অধিগঠন! নীনার খুব ইচ্ছে করে চিৎকার করে ডেকে উঠতে। আজ যার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। সেই লেননকে। বলতে ইচ্ছে করে, ‘শুনুন, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, ‘দ্য সান উইল নেভার ডিসঅ্যাপিয়ার/ বাট দ্য ওয়ার্লাড মে নট হ্যাভ মেনি ইয়ার্স..’ এটাই আমাদের একাকিত্ব। মনে হয়, লেনন এটা আমাদের সামগ্রিক একাকিত্ব!
প্রাগ আরেক শহরের আর একটা কোণে তেরেজার বাড়ি। বাড়ি ছিল। এখন ও নিজেকে আর কোনও একটি শহরের মানুষ বলে ভাবে না। সরকারি হিসেবে তিনটি দেশের পাসপোর্ট আছে যদিও। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব অস্থির হয়ে ওঠে তেরেজা এই ডিজিট্যাল হিউম্যান সত্তা নিয়ে। নীনা জানে, সে যে এখানে আজ, তা জানে তার দেশের র্যাডার। সেখানে সে একটা নম্বরমাত্র। রক্তকরবীর ক্লাসে একদিন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল নীনা। মানুষ কখনও এমন হয় ‘ঞ’ কিংবা ‘ঙ’! হয়। হয়। তখনও জানা ছিল না। নীলকার্নির হিসেবনিকেশ। সেও তো কোনও এক ‘ঞ’ কিংবা ‘ঙ’। অথচ মানুষকে মানুষের নামে চেনা নিয়ে কত না যুদ্ধ, কত না লড়াই। শেষ হয়নি আজও। কিন্তু কোনও একটা নাম নিয়েই তো যাবতীয় যুদ্ধের শুরু। সেই নাম কোনও একটা গাছের। কোনও একটা পাথরের টুকরোর। কোনো একটা নদীর। কোনও একটা রঙের।
তেরেজার বাবা ফিরে আসেননি কোনও একদিন। অনেক খুঁজেও কোনও হদিশ পায়নি ওরা কেউ। তেরেজার মায়ের প্রেমিক ওর মায়ের আড়ালে তেরেজার ছোট্ট শরীরটার দখল নিয়েছে গেরিলা সৈনিকের মতো। সমস্ত ভাঁজ-খাঁজের অন্ধকারে আরও বেশি অন্ধকার ঢেলে দিয়েছে সেই পুরুষ। মা জেনেছে। নীরব থেকেছে। তেরেজা ঘর ছেড়েছে সেই কোন কালে। আর ফেরেনি। নিজের ইচ্ছেয় নিজের শরীরকে মুক্ত করতে চেয়েছে সে। তবু এই শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে নিজেকে মেলে দিতে শিখেছে সে আরব্যরজনীর রমণীর মতো। আসলে ওই সূর্যটা বেঁচে যাচ্ছিল তবু। মরে যাচ্ছিল ওই পৃথিবীটা। ঠিক তখন নীনাকে পেয়েছে সে। মৃত্যুকে ‘মরণ' বলে যে দেশের মানুষ। সেই দেশটাকে জানতে চাইছিল সে সেদিন থেকে।
তেরেজা পার্কের ঢুকতে ঢুকতে লক্ষ করছিল নীনার বসে থাকার আশ্চর্য ভঙ্গিটা। যেন কোনো ক্লান্তি নেই। অভিযোগ নেই। অভিমানও নেই। যেন অপেক্ষার আলোটুকু আছে শুধু।
এটাই দেখেছিল সে প্রথমবার বিটলস আশ্রমে। একেবারে নিভৃতে বসে থাকা একজন মানুষের চেহারায় যেন একাকিত্ব শব্দটাকে ভাস্করের মতো ছুঁয়ে-ছেনে দেখা যায়। নিজে থেকে আলাপ করার আগে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করেছিল সে-ও। সেই মানুষের পিছনে পিছনে হেঁটে। নদীর শরীর ঘেঁষে অনেটা পথ সেদিন হেঁটেছিল তেরেজা। নীনা যেন টের পাচ্ছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু পিছন ফিরে দেখা সে ছেড়ে দিয়েছিল ততদিনে। শুধু সামনে থেকে যতটা দেখা যায়, ততটাই দেখতে চাইত সে। কখনও কখনও কিছুটা ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে। প্যানোরামিক দৃশ্যে ততটা দেখতে চাইত, যতটা নিজেকে বাদ দিয়ে দেখা সম্ভব! তাই দুপুর গড়ালে যখন এসে বসেছিল সে জার্মান বেকারির তার নিজস্ব কোনটিতে, তখন প্রচন্ড একটা খিদে আর তেষ্টা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি জীবিত ছিল না তার সেই আপাত সময়ে। নদীটার ভর্তি শরীরের জল যেমন একা একা উত্তর থেকে দক্ষিণে গড়িয়ে চলেছিল, ঠিক তেমনিই নীনা খাবারের অর্ডার দিয়ে চোখ রেখেছিল আগের রাতের বুকমার্ক সরিয়ে ‘ইন হিজ ওন রাইট'-এর ছেড়ে আসা লাইনগুলোতে। আশ্চর্য লাগছিল নীনার। মাত্র চব্বিশ বছরের এক যুবক তখন লেনন। সঙ্গ সঙ্গেই মনে পড়ছিল সুকুমার রায়ের কথা। ‘ননসেন্স’ আর ‘ফানি’ -এ দুটো বিশেষণ ঘুরে ফিরে আসছিল সুকুমার রায়ের লেখা নিয়ে কথা বলায়। ওঁর ও তখন বয়স তেমনই। নীনা একা একা চেখে নিচ্ছিল সবটুকু রস। কফি এসে রোজকার মতো ঠান্ডা হচ্ছিল অপেক্ষা করতে করতে। ঠিক সেসময় তেরেজা ওর চেক-ইংরিজি উচ্চারণে অনুমতি চেয়েছিল উল্টোদিকের ফাঁকা চেয়ারে বসার। বই-এর পাতায় অর্ধেক দৃষ্টি সেঁটে রেখে সামান্য ইশারা করেছিল নীনা, ‘কোনো আপত্তি নেই', এটুকু বোঝাতে।
সেদিন সন্ধে পেরোতে পেরোতেই ঠিক হয়েছিল আজকের দিনটার। লেনন ওয়াল-এ নিজেদের ভিতরের কথাগুলো গেঁথে দেওয়ার পরিকল্পনা। নিজের কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটার পর একটা ছবির পরত খুলে মেলে দিয়েছিল তেরেজা। নীনা বইটাকে দু'হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে চালান হয়ে গিয়েছিল মনে মনে সেই দেওয়ালটার সামনে। যেন কেউ নেই সেখানে আর। কেউ না। তেরেজাও না। শুধু নীনা। যেন লেনন আর সে একা। মুখোমুখি। সেই মানুষের কথা মনে পড়েছিল নীনার সেদিন। যে মানুষ আখ মাড়াইয়ের মেশিনের মতো নিঃস্ব করে ছেড়ে গেছে তাকে বারবার। তবু কি শূন্য হাত তার ? তাই কি সে লেননের গানের কথার মতো সে সব কিছুকে পিছনে ছেড়ে আসতে পেরেছে? বারবার ধুয়ে নিতে চেয়েছে নিজেরই রক্তাক্ত হাত গঙ্গায়, সেইনে, ভলতাভায়, নেইল-এ! একটা নদী খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল তাই। ছোট্ট মেয়েটার মতো মনে হয়েছিল নীনার আসলে সামনে যে মানুষটাকে অনেক বড় মনে হয়, আকারে-ইঙ্গিতে-দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে, সে আসলে তত বড় নয় । তাই সেই মানুষের দেওয়া দুঃখ কষ্টও কখনও ততটা বড় হতে পারে না। যা, এই একলা পার্কে, একলা সকালে বসে বসে নীনাকে অপেক্ষা করায়। সে তো শুধু সুখ। সে তো শুধু আনন্দ। তেরেজার আলিঙ্গন গাঢ় হয়। গাঢ়তর সেই সকালের মুখ থেকে আরও কিছুটা আবছায়া ভাব সরে যেতে থাকে।
আরও পড়ুন- কলমি বিরিয়ানি: অমর মিত্র
প্রাগ শহরের এক অখ্যাত পাড়ায় সকালের নহবৎ বেজে ওঠে। সুরে মিলে যান বিসমিল্লা আর লেনন। দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিত্তির রং চড়ে। মোটা তুলিতে আঁচড় কাটে নীনা, তেরেজার মতো হাজারও মানুষ। কিভ শহরে, কিংবা গাজার ভাঙা দেওয়ালে ইঁটের পরত জুড়ে জুড়ে লেখার নতুন বোর্ড তৈরি করার স্বপ্ন দেখার শেষ হয় না। কিন্তু সত্যি কি বন্দুকের নলে চকোলেট কিংবা ফুল বর্ষাবে কোনোদিন? কোনোদিন কি সেই কুচকাওয়াজ শিখে নেবে পৃথিবীর তাবৎ সৈনিক, যেখান লেনন গাইবেন, ‘লাভ ইজ ইউ/ ইউ অ্যান্ড মি / লাভ ইজ নোয়িং/ উই ক্যান বি !' আলিঙ্গনের গভীর থেকে শুধু সেই কথাগুলি ঘুরে ঘুরে 'জলের মতো একা কথা কয়', কিংবা একই কথা কয়, ভালোবাসা তো স্পর্শমাত্র, স্পর্শই ভালোবাসা/ ভালোবাসা তো পৌঁছোতে চাওয়া, পৌঁছোনো ভালোবাসা/ ভালোবাসা শুধু সেই জিজ্ঞাসা ভালোবাসা ফিরে পাওয়া!'
নীনার বাসার দরজা খোলার সময় হয়ে আসে। কিন্তু দিনটা আরও বড় এক চাহিদার বিজ্ঞাপন যেন। অনেকটা পথ পেরোনো বাকি। লেনন ওয়াল। লেনন ওয়াল। নীনা আর তেরেজাকে পৌঁছোতে হবে সেখানে আজ। আরও অনেক নীনা, তেরেজা, দেমক, জোসেফ, ক্যাটরিনা সেখানে জড় হয় রোজ, প্রতিদিন। প্রতিদিন অপেক্ষা করে সেই কেয়ামতের, যখন আকাশের দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে দিতে পারে তারা ‘লাভ ইজ ফ্রি, ফ্রি ইজ লাভ/ লাভ ইজ লিভিং, লিভিং ইজ লাভ...' একে কী বলা যাবে তবে ? মৃত্যু থেকে মুক্তির ইস্তেহার ? রাস্তা পেরোনোর সময় খুব শক্ত করে নীনার পাঁচ আঙুলের মুঠো আঁকড়ে থাকে তেরেজা। ভালোবাসা সত্যি। সত্যিই ভালোবাসা- লিখতে লিখতে এক একজন মানুষ চোখের তারায় আলো ধরে থাকেন। সব মুখ মানুষের মুখ হয়ে ওঠে। নীনা হৃষিকেশের রাস্তায় ফেলে আসা সমস্ত রংগুলোকে দু-হাতের মুঠোয় নিয়ে লেপে দিতে থাকে দেওয়ালে। কান্না থামে না। কাশ্মীরে, সরাইকেলায়, কুরুক্ষেত্রে, পানিপথে, ইরানে ইরাকে, ভিয়েতনামে ছেড়ে যাওয়া মানুষের শবে কান্না ফুলে ফুলে ওঠে। এক একটা শব্দ কালো রং-এ ঢেকে যায়। কোনো একদিন ফিরে এসে ওদের আলোতে মুক্ত করে দেওয়ার স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখে শুধু নীনা-তেরেজারা।