জুলুস : অমৃতা সরকার

Bengali Short Story: নিজেদের ধর্মের লোকই না চারপাশে! ভয়টা কীসের তাইলে! দেশের প্রধানমন্ত্রী হিন্দু। বাহান্ন সন থেকে তারা এই চরের বাসিন্দা।

নতুন করে ঝামেলায় পড়তে চায় না আর এই এলাকার মানুষ। মাতব্বরদের কথায় সায় দিয়েই তাদের এইখানে আসা। এই বিভুঁয়ে এসে হালচাষ দেওয়া, ঘর, বারিন্দা, তুলসিমঞ্চ বানানো। নইলে এখানে ব্রহ্মপুত্র ছাড়া আর কী আছে তাদের আগের থেকে চেনা! তাও কি চেনা যায়! ময়মনসিংহের মিয়ানো জলের ধারা তেজে ফুটতেছে এইখানে! একমুঠি কলাই কী ধান যাই ছড়াও মাথা তুলবেই জমিনের ভিতর থেকে। এমন নাছোড়, এমন নিলাজ, এমন লোভী যে সারটুকুও চায় না। ব্রহ্মপুত্র কম কিছু দেয়নি এদের। ব্রহ্মপুত্র ছাড়া আর কেউ কিছুই দেয়নি এদের। সেই সোহাগ তারা ফিরিয়েও দিয়েছে সহস্রগুণে। ফকফকা জ্যোৎস্নায় কোথায় চরের শেষ আর আকাশের শুরু যখন তলাশ করা যায় না এমন এক রাতে কালো পিঁপড়ার সারের মতো এইখানে এসে পা রেখেছে তারা। সেদিনের সেই চর আজকে খুঁজলে পাওয়া যাবে? যাবে না। খালি ক্ষেতের সবুজের রকমফের ছেনালি দেখে মন ডগমগ করবে। তাহলে এই চাঁড়াল পাড়ায় তো মানুষের এই সময়ে ঘুমানোর কথা। গভীর ঘুমে এক পাক ঘুরে আসার কথা ব্রহ্মপুত্রের অন্য আরেকপারে, অন্য আরেক দেশে। যেই দেশ থেকে এক রাতে এক কাপড়ে অন্ধকারের মধ্যে আরো অন্ধকার হয়ে প্রায় মিলায়ে গিয়ে ক্ষেতপাথালি ধরে পালিয়ে এসেছে। সেই দেশের জলের বাস্না নাকে আসে তাদের গভীর ঘুমের ভিতর। বাস্নার পিছু ধরেই না তাদের এদ্দূর আসা। কিন্তু চাঁড়াল পাড়ার লোকেরা আজ ঘুমায় না। সবাই শলা করতে এসেছে উপেন হালদারের উঠানে।

“এই বার আর পলানো যায় না।"

“না পলাইলে কি জানটা দিব?”

“পুলা মাইয়াগুলার কথা ভাবার দরকার নাই?”

“অদের লিগ্যাই কই, আর কয় বার পলাইবা?”

“তাইলে সমাধান কী, আপনারাই কন।“

“লাঠি ধরতে লাগবো।"

“লাঠি ধইরা পারবেন? মিয়াগো লগে? হ্যারা বন্দুক রাখসে জানেন?”

“আমাদের টাঙ্গি নাই?”

“হ, টাঙ্গি দিয়া মাথা ফাঁক করার আগে, বন্দুক দিয়া কলিজা ফাড়বে।"

“ঝাড় থেইক্যা বাঁশ কাট, লাঠি বানা, মদ্দা মাইষ্যের মুখে মেয়েলোকের মতন কথা ক্যান? ডর লাগে?”

মাতব্বরেরা ইচ্ছা করেই এই কথা বলেন। ডর লাগার মতো পরিস্থিতি হলেও ডরের কথা বললে কেউ চুপ থাকবে না। যে হাতে লাঙল ধরে, হাল দেয়, চিড়ল চিড়ল সিঁথি কাটে ক্ষেতে, বিছন ছড়ায় মাপ মতো সেই হাত পাকা বাঁশের লাঠি দিয়ে বাতাস কাটতে শিখেছে জন্মেরও আগ থেকে। হয়তো শেখেওনি, লাঠিই নিয়ন্তা হাতের। মাতব্বররা নিজেরাও জানে না।

আরও পড়ুন- সাইকেল: অমৃতা সরকার

বছর চারেক আগে চাঁড়াল পাড়ায় যখন টাঙ্গির কোপে খুলি উড়ল বীরেন সর্দারের, তাও আবার তারই জমিনে,কেউ অপেক্ষা করেনি আর একটা রাত। আরও পুবে সিলকিঝাড়ের  দিকে হাঁটা ধরেছিল।  খানিক দিন গা ঢাকা দিয়ে ফের পিঁপড়ার সারির মতো একের পিছনে আরেক ফিরে এসেছিল নিজ নিজ ভিটায়। আজকে যে উঠানে জমায়েত সেইখানে ভিটির মাটি সমান করে  উঠান জোড়া বেগুনের ক্ষেত করে দিয়ে গেছিল আসামিয়ারা। উপেন হালদার আর তার মা, বউ আট দিন ধরে খালি বেগুনের গাছ উপড়েছে। ভিটা পুড়তে সময় লাগেনি গোটাগুটি তিন ঘণ্টা, খাড়া করতে লেগেছে আড়াই মাস। উপেনের মা বাঁশের বাতা বুনতে পারে সটাসট। চাল ছাইতে উপেন একাই দুইয়ের অধিক। মোষের মতো শক্তি গায়ে গতরে, চেকনাইও সেরকম। তুলনায় তার বউ সনকা নতুন বেগুনের ফুলের মতো পলকা। তবু তারা উঠান ঘিরে দাঁড় করায় একে একে ঘর, বারিন্দা, তুলসিমঞ্চ। চালের  গুঁড়ার আলপনা রাতে ফুটে থাকে ভুঁই চাঁপার মতো।

মিয়ারা কী জানি কী মনে করে সুপারি গাছ গুলানকে রেহাই দিয়েছিল। মাতব্বরদের কথা মতো সুপারি গাছ কাটা পড়তে লাগল। উপেনের মায়ের মায়া হয় ফলন্ত সুপারি গাছের গায়ে কোপ বসাতে। নিজেকেই কয়, এই যাত্রা বাঁচলে, আবার হবে, অনেক হবে। যেমন প্রতিবার বলে, মন্তরের মতোন। সুপারির লম্বা কাণ্ড মাঝখান দিয়ে ফেড়ে তৈরি হয় বল্লম। সনকা পাকঘরের আধা খোলা দরজা দিয়ে শাশুড়ির হাতের দা চালানো দেখে। ফোড়নের পিঁয়াজ-কালোজিরা পুড়ে গন্ধ  বেরোয়, মুসুরির ডাল কড়াইয়ে ঢালতে দেরি হয়ে যায়।  

“আবাগির বেটি, ডাল পোড়া বাস্না বেরোয় ক্যান?”,শাশুড়ির চোপা শুনে আবাগির বেটির ডাল চল্কে হাতেও পড়ে। আওয়াজ করে না সনকা। গলা দিয়ে আওয়াজ তার এমনি সময়েও কম বেরোয়। আজকে পুরা এলাকাই সনকার মতো থম মারা। চরের প্রতিটা রোমকূপ, প্রতিটা ধান সিধা হয়ে আছে। ভেতর দিয়ে বাতাস চলতেও দেবে না। ক্ষেতের শেষ মাথা গড়ান দিয়ে যেখানে নদীর দিকে যায় সেখানের বেআব্রু পলি লালচে রঙ ধরে। বেলা ডুবছে।বাঁশঝাড়গুলার মাথা  মিশে যাচ্ছে একের পিঠে দুই। “জাগনা থাইকো”, মানুষের গলা পাওয়া যায়। দিকের হদিশ পাওয়া যায় না। আজকের রাতের মতোন রাত দেখে নাই তারা, যারা সজাগ টান টান? কিশোরগঞ্জে এমন রাত এসেছে। চাঁড়াল পাড়ার এক চালে আগুন ধরেছে। তারপর বিনা আয়াসে গোটা গ্রাম জ্বলে গেছে। কিন্তু সে তো হলো গিয়ে এখন মুসল্লিদের দেশ। সাতচল্লিশে সোজা হিসাব হয়ে গেছে। এখন এই হিন্দুর দেশে তাইলে একই রকমে রাত জাগে ক্যান চাঁড়াল পাড়া? গোরেশ্বরে এসেও তাদের সজাগ রাত ঘুমের মধ্যে তলায় না। আনাচ কানাচে সজারুর কাটার ঝুমঝুমিতে মেয়ে বউয়ের হাঁটাচলা টের পাওয়া যায়। একটা বাতিও টিমটিমায় না। বাতির দরকারও পড়ে না। বাকি কাজটুকু সারতে চোখ লাগে না কারুর। অন্ধকারের তোয়াক্কা করে না হাত। হাতের দা। সনকা আর তার শাশুড়ি পাড়ায় বাকি মেয়ে মদ্দ বাতি ছাড়াই বাঁশের ফলা দা চালিয়ে সূচালো করে যায়। ডাং গুলি হাতের মুঠায় পাকড়ে শন শন করে ঘোরায় পুরুষেরা। উপেনের মায়ের মনে হয়, আরও কয়েকটা ছাওয়াল থাকলে, আরও ডাং বানাইতে হতো। মাজায় জোর পাওয়া যাইত। বল ভরসার জন্য জন বাড়ানো ছাড়া আর কোন উপায়। তার ব্যাটার বউ এই কথা বোঝে কিনা, সে বোঝে না। নাইলে এই ডামাডোলের মধ্যেও বছর ঘুরলো একই ভিটায়।মোটের উপর  ভরপেট খায়ে, মাইখে, তাও আবাগির বেটি একটা পোলা বিয়াইতে পারে নাই। সনকার ষোল বছরের অকম্মার ঢেঁকি শরীরটা অন্ধকারে ঠাহর করে তার গা জ্বালা করে।

শাশুড়ির মতোন কায়দায় বাঁশ ছুঁলতে না পারলেও সনকার হাত চলতে থাকে। গোরেশ্বরে বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক সে এমন রাত দেখে নাই। কিছু একটা যে হবে তার আভাস ছিল। অনেক দিন ধরে ছিল। এত দিন যে সবাই আস্তে আস্তে এই কিছু একটা হবের সঙ্গে ঘর বসত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। কী হবে আবার, রাতের বেলা ঘরে দোরে আগুন দেবে? পালাতে হবে? পালানোর কথা ভাবলে সনকার হাত চালানোর গতি বাড়ে। সুবল করাতিদের বাড়ি যখন রেডিও শুনতে যেত, সবাই বলাবলি করতো এইখানের বাস তুলতে লাগবে। আসামিয়ারা সব বাঙালিরে খ্যাদাবে। আসাম খালি আসামিয়াদের। পূব পাকিস্তানের মাইনষ্যের এইখানে কুনো জায়গা নাই। এই সব বলাবলি চলত। চলতে চলতে থিতু হতো। ধানের রঙ বদলালেই এই সব বলাবলি হালকা হয়ে যায়। “শিষ দেখে বিশ দিন, কাটতে মারতে দশ দিন”, মেয়ে মদ্দ জানে সবাই। এই কয়দিন ভয় পাওয়ার মতোন সময়ও থাকে না। কিন্তু  সনকাকে ছাড়ে না ভয়। সব চেয়ে বেশি ভয় লাগে তার রাতের ব্যপারটায়। উপেন যখন তার ফনফনা লাউ ডগার মতো শরীরটা চপরচপর করে চিবাতে চায় তার হাত পা কাঠের তক্তা হয়ে থাকে। তক্তার উপর দাপিয়ে সুখ হয় না উপেনের। দুই চারটা খিস্তি করে পাশ ফিরে ঘুমায় মোষের মতো। সনকার আজি তাকে এত কাহিনি বলে গেল। বুড়ি কখনও রাতের ব্যাপারটার কথা কয় নাই। রোয়া গাড়া, ধান সিদ্ধ, উনান বানানো সবই শিখাইল। এমনকী পাকা বাঁশে সিন্দুরের রঙ ধরা যে মেয়ের গায়ের চামড়া, সেই কন্যা তার চিক্কুর শুকাইতে আসে ভরা দুপুর বেলায় বাঁশ ঝাড়ের  আলো আন্ধারে তার কথাও কইল বুড়ি। খালি রাইতের ব্যাপারটায় যে এত জ্বালা যন্ত্রণা সেই কথা কইতে ভুলল।

নদীর দিকের বেহিসাবী বাতাস এসে এ পাড়ার লোকের হিসাবে ভুল করায়। ভিজা হাওয়ায় সবার চোখে ঘুমের আস্তর পড়ে। রাতও শেষের দিকে। খালি উপেন দাঁত কিড়মিড় করে বউকে একটা কুনুইয়ের গুঁতা দেয়। সনকা ভাবেও নাই এই ভয়ের রাত তাকে অন্য ভয়ের থেকে রেহাই দেবে না। তার শক্ত  হওয়া অঙ্গ আজকে আরও বেশি করে জ্বলন সহ্য করে। আজকে রাতে মিয়াঁদের হামলা করার কথা ছিল। তাদের আটকাতে যত শক্তি জমানো ছিল উপেনের, সনকার উপর সবটা খরচ করতে করতে ভোর হয়ে যায়। উঠানময় ছড়ানো ছিটানো অপুষ্ট সুপারি দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সকলে। আর তিনটা মাস গাছে রাখলে, গোরেশ্বর বাজারে গুয়া সুপারির দাম উঠতো মেলা। অকালে গাছগুলা কাটার জন্য আফসোস যত না তার চেয়ে বেশি রাগ হতে লাগলো মাতব্বরদের উপর। আরে এই হিন্দুর দেশে তাদের খ্যাদাবে কারা? নিজেদের ধর্মের লোকই না চারপাশে! ভয়টা কীসের তাইলে! দেশের প্রধানমন্ত্রী হিন্দু। বাহান্ন সন থেকে তারা এই চরের বাসিন্দা। ভোট দেওয়ার অধিকার তাদের দেওয়া হবে। রেডিও তারা শোনে নাই! হ্যাঁ, এই কথা সত্য যে সাত আট বছর হয়ে গেছে এখনও হয় নাই সেটা। কিন্তু সব বড় কাজেই তো একটুকু ধৈর্য ধরতে লাগে। তারা যখন ধানের বিছন ফেলে, রাত পুইলেই তো গাছ বের হয় না। ওইটুক ধৈর্য তাই ধরতে লাগে। তাই বলে কি রাত বিরাতে জাগনা বসে কাটাতে হবে! মোল্লারা এখানে কত আর? বেশি তো তাদের নিজেদের মানুষই। সকালে যখন ফের মাতব্বরদের শলা পরামর্শর সভা বসে, মেয়ে মদ্দ সকলে উসখুস করে। বেলা উপরদিকে ওঠার আগে কাজে যাওন  লাগবে। একটা নির্ঘুম রাতের স্মৃতি কেউ আর মনে রাখতে চায় না।

আরও পড়ুন- জিহাদের বিষয়-আশয়: অভিষেক ঝা

হ্যারিক্যানের কাঁচটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুখের ভাপ দেয় সনকা। আঁচলের কোণা দিয়ে মোছে, দুই হাতের থাবায় ধরে সাবধানে। গেরস্থালির চারটা জিনিসের মধ্যে এইটাই সবচে দামি তার কাছে। ডাঙ্গি ক্যাম্পে আসার পয়লা হপ্তায় সকল পরিবারকে একটা করে হ্যারিক্যান দিয়েছে গরমেন্ট। কম মানুষেরটাই আস্ত আছে এখনও। সনকারটা আছে। সেইদিকে নজরও আছে কয়েকজনের। রোজ রাতে মাথার সিথানে শাশুড়ির সুপারিকাটা জাঁতিটা মনে করে রাখে সনকা। হ্যারিক্যানের দিকে হাত বাড়ালে জাতি দিয়ে আঙুল কয়টা নামাতে দেরি লাগবে না। ডাঙ্গিক্যাম্প তার ভালো লাগে। তপসিকাটা হাইস্কুলের যে ক্যাম্পে তারা প্রথমে ছিল দেড় মাস মতোন সেখানে বরদলুই, ডিমাপুর কই কই থেকে লোক আসতেই লাগছিল। ইসকুলের হাতায় পুকুরেই খাওয়া হাগার জল। আন্ত্রিক ধরল। উপেনের মা ওই ক্যাম্পেই মরল। আরও কয়েকজনা মরতে, ওই ক্যাম্প থেকে তাদের সরানো হলো ডাঙ্গি ক্যাম্পে। সনকার এখানে কোনও কাজ নেই। ক্যাম্পে লপসি দেয় অঢেল। দুইবেলা তার আর উপেনের পেট খালি থাকে না। দুপুরের দিকে সে অন্য মেয়েলোকদের সঙ্গে জটলা করে।

“কুনঠে আসিচেন মাও?”

“তপশিকাটা ক্যম্পের থন, আফনে?”

“আমরা আসচি মঙ্গলদই থিক্যা।"

“হামার ঘর ছিল মরিগাও।"

“বঙ্গাইগাও আমাগো বাসা আসিল।“

“তপশিকাটা ক্যাম্পত আসার আগে কুন্ঠে আছিলেন?”

“গোরেশ্বর।“

ক্যাম্পের কালো ত্রিপলের ঢেউয়ে মাঠের আসল রঙ চাপা পড়ে গেছে। মাঠ পার হলে চা পাতা বাগানের শুরু। থোপা থোপা চা গাছ , তার খেতের পর খেত। একটা আন গন্ধ নাক থেকে সরে না। ভালো কি খারাপ তাও বুঝা যায় না, এতটাই নতুন। কোথায় জানি এরোপ্লেন নামে চা খেতের কোনখানে, পাতা নিতে আসে আসে সেই সব এরোপ্লেন। এইসব বলাবলি করে ক্যাম্পের মেয়েরা। একদিন দেখতে যাওয়ার হাউস রাখে। ওইতে কইরেই নাকি একদিন ইন্দিরা গান্ধী আসবে। তাদের ক্যাম্পে। সেদিন আরও হ্যারিক্যান বিতরণ হবে। সনকা শোনে। রাতের বেলায় উপেনের পাশে ঘন হয়ে শুয়ে তাকেও বলে সেই কথা। আলিপুরদুয়ার জাংশনের ট্রেনের আওয়াজ আসে। কাপড় আলগা করে সনকা। উপেনের গায়ে আরও লেপ্টে শোয়। রাইতের ব্যাপারে ভয় নাই আর। জন বাড়াতে হবে। দিনের বেলায় লাঠি ধরার জন। সেদিন তাদের উঠানে সব লাঠি ঢেড় হয়ে পড়েছিল। রাতের আগে ডাং গুলার কোনও দরকার নেই এই কথা তারা অভ্যাসের বশেই জানে। পাকিস্তানে যখন বাড়ি ঘরে হামলা হতো তখন বহুকালের পড়শি মিয়ারা একটু আন্ধারের আড়াল নিত। সেই দিন সকালে তাই মতব্বরদের আসর ভাঙার পর গোরেশ্বর বাজারে নিশ্চিন্তে সবাই হাটে বেচা কেনা করছিল। পুরা হপ্তার মালপত্র। আশপাশের গঞ্জের মধ্যে গোরেশ্বরেই সবচেয়ে বড় হাট বসে। হালের গরু মোষ থেকে শুরু করে লুঙ্গি, গামছা, মশলা, বিছন কোন জিনিসটা না পাওয়া যায়! রোদের তেজ বাড়ছিল তার সঙ্গে মানুষের গলা। দোকানি বোঝাচ্ছিল তার মালের গুণ, কেনার মতো দামদর করছিল কিনতে আসা মানুষ। সবার কান মাথা বেবাক করে ব্যান্ড পার্টি বাজারের মুখটায় ঢুকছিল। বাজনা কানে আসতে রাতজাগা লোকগুলার স্নায়ু টানটান হয়ে গেছিল। জুলুস দেখতে গিয়ে ক্রেতা বিক্রেতা সকলেরই হাতের কাজ থামে। জুলুসের ল্যাজা মুড়া কিছুই থা পাওয়া যায় না। কীসের জুলুস তাও বোঝা যায় না। লম্বা লম্বা বাঁশের ডগায় লাল সবুজ  নিশান ধন্দে ফেলে। জনতা দুই দিকে ভাগ হয়ে জুলুস এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দেয়। নিশানের সঙ্গে বাঁধা বল্লম নজর করতে পারেনি কেউ। বল্লম খেলাচ্ছলে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যায়, হদিশ পায় না। হাটের জমাট ভিড়টা প্রথম নড়াচড়া করতে শুরু করে যখন সুবল করাতির ফার্নিচারের দোকানে কেরোসিন ঢালা শুরু হয়, জুলুসের একটা অংশ মণি বিশ্বাসের সাইকেল মেরামতির দোকানে ঢুকে তার নলিতে কোপ বসায়। “বঙ্গালি খ্যাদাও” রবটা বাজনার তালে তালে বাজতে থাকে। পিঁপড়ার সারির মতোই গোটা চাঁড়াল পাড়াকে পিষে ফেলতে আধবেলাও লাগে না। গঞ্জের রাস্তায় আধা পোড়া মালপত্র আর কাটা মানুষের ঢিপ জমে যায়। মানুষগুলির মুখজোড়া খালি চোখ। নাক মুখের জায়গা দখল নিয়েছে ফেটে পড়া চোখ। জুলুস মোল্লাদের না ভট্টদের!

ব্যান্ডের বাজনা  থামে না।

 

More Articles