বুবি ও তেঁতুলভূতের গল্প : অমৃতা ভট্টাচার্য

Bengali Short Story: তার দিকে তাকিয়ে ঘাসের ওপর হেলে সেই হাসিটা হাসল বুবি। কাঁধ থেকে আঁচলটা খসে পড়ল … ভরন্ত দীঘিতে দুটো শাপলা হাসছে …

(১)

বাঁকের মুখে এসে অভ্যেসমতো তেঁতুলগাছটার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন নির্মল মাস্টার। প্যাডেল থেকে পা নামিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে হেঁটে বাঁকটা পার করে ঝোপের মুখে দাঁড়ালেন। ঝাড় ঝাড় কাঁটাফল নিয়ে ওপাশে জলের দিকে নুয়ে আছে গুল্মের দল। টলটলে পুকুর। কালচে শ্যাওলা জল বিকেলের রোদে ঘন হয়েছে আরও। বেলা শেষে জলও ক্লান্ত হয়। পুকুরের ওপাশে বিপুল আয়তনের তেঁতুল গাছটা ডালপালা বিছিয়ে যেন কাছে ডাকছে আরও। শুধু কাছে ডাকাই নয়, মাস তিনেক ধরে এই তেঁতুল গাছটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে নির্মল মাস্টারকে।

সাইকেল ধরে হাঁটতে হাঁটতে আবার একটা বাঁকের কাছে এলেন মাস্টার। একটু এগোলেই রাস্তার ওপর তেঁতুল গাছটার ছায়া। রাস্তায় ছায়ার দিকে তাকিয়ে সাইকেলটা টেনে নির্মল মাস্টার প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন গাছটার দিকে। বুকের ভিতর কি যেন একটা ওঠাপড়া করছে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত সরে সরে যাচ্ছে। নির্মল মাস্টার বুঝতে পারছেন ঘাম শুধু হাতের চেটোতেই নয়, সাদা কুর্তার ভিতর থেকেও বিন্দু বিন্দু ভিজে উঠছে শরীর। চোখের মণি তিন-চারবার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললেন মাস্টার। নাহ! কাছে পিঠে কেউ নেই। দৃষ্টি সটান তেঁতুল গাছের মাথায় রেখে ধীরে ধীরে গাছ বরাবর চোখ নামাতে লাগলেন মাস্টার। যথারীতি … উফফ! উপরের পাটির দাঁত দিয়ে বাঁদিকের ঠোঁটের কোণটা আচমকা কামড়ে ধরলেন। বুবি ঠিক একভাবে দু-পা ছড়িয়ে বসে আছে তেঁতুলগাছের নীচে। চোখ সরিয়ে আবার রাস্তায় গাছের ছায়াটার দিকে তাকালেন নির্মল মাস্টার। এখন ছায়াটার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ছায়াটা রাস্তা ছেড়ে এখন সাইকেলের হ্যান্ডেলে আর তার হাতের ওপর দুলছে। গাছটা কি দুলছে? পাতাগুলো? নাহ! সেরকম কিছু চোখে পড়ছে না। সে নিজেও স্থির। তাহলে ছায়াটা দুলছে কেন? ঝুরঝুরে পাতার ছায়াটা একবার সাইকেলের হ্যান্ডেলে তার নিজের হাতে উঠে বসছে, আবার পরক্ষণেই রাস্তায় নেমে যাচ্ছে টায়ারের বেশ কিছুটা আগে। মাঝে বাতাস দুলছে নিশ্চয়ই। কিন্তু শুধু বাতাস দুললে ছায়া দোলে? নির্মল মাস্টার আবার তাকালেন বুবির দিকে। একদিকে ঘাড় হেলিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে বুবি। এখন তিনি একবার যাবেন ওর কাছে? নির্মল মাস্টার জিভ বুলিয়ে নিলেন শুকনো ঠোঁটের উপর। জিভটাও শুকনো। নাহ! এটা বারবার ঠিক হচ্ছেনা। চাকাটা অল্প একটু বাঁকিয়ে সাইকেলে ওঠার কথা ভাবলেন নির্মল মাস্টার। গাছের ছায়াটা আবার উঠে এল হাতে। মাস্টার আবার তাকালেন বুবির দিকে। তারপর হঠাৎ ক্ষিপ্র পায়ে সাইকেল-স্ট্যান্ডটা সোজা করে রাস্তায় সাইকেল রেখে পড়িমরি করে দৌড়ে গেলেন বুবির দিকে।

আরও পড়ুন- একটা ফ্লাইওভার ও আলোর গল্প: অমৃতা ভট্টাচার্য

বড় শহরে জন্ম থেকে আটত্রিশ বছর কাটিয়ে অবশেষে শ্রীপুরের মতো এই গণ্ডগ্রামের একটা প্রাইমারী স্কুলে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন নির্মল মাস্টার। তা-ও প্রায় আট বছর হয়ে গেল। গ্রামের লোকজন তাকে বেশ মান্যি-গণ্যি করে। আসলে চাকরিটা আছে পেট চালানোর জন্যে। নির্মল মাস্টারের আসল কাজ গল্প লেখা। গল্পকার হিসাবে তাঁর এখনই বেশ নামডাক। শহরের সবচেয়ে বড় পত্রিকাগুলো নিয়মিত গল্প ছাপে তাঁর। গোটা পাঁচেক গল্পের বইয়ের পাশাপাশি দুটো জবরদস্ত উপন্যাসও বেরিয়েছে। লেখার বাজারে যথেষ্ট ধরপাকড়, ইঁদুর দৌড়। কিন্তু এসব ছাড়িয়ে নির্মল মাস্টার এই গণ্ডগ্রামে থেকেও যে এতটা বাজার পেয়েছেন, তার কারণ লেখার প্রতি তাঁর মনোযোগ। লেখার ব্যাপারে কোনও ফাঁকিবাজি নেই তাঁর। গল্পকে নিজের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় ধারণ না করে তিনি পাতার সামনে বসেন না। এই জন্যেই সংখ্যায় কম হলেও তাঁর গল্প পাঠকমহলে বেশ প্রভাবশালী। কিন্তু ইদানীং একটা অদ্ভুত সমস্যা তাড়া করে বেড়াচ্ছে নির্মল মাস্টারকে। এই তেঁতুল গাছটা। ভুল হলো, এই তেঁতুল গাছের গল্পটা। গত তিনমাস ধরে এই রাস্তায় তাঁর যাতায়াত। বড় রাস্তা ভেঙে হাইওয়ে হচ্ছে। ঘুরতি পথে এই রাস্তাটা প্রথমদিন থেকে অদ্ভুত! একটা আখাম্বা তেঁতুল গাছ রাস্তার পাশে। নীচে একটা মেয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকে সকাল-বিকেল। আশেপাশে কোনও বাড়ি নজরে পড়ে না। মেয়েটা আসে কোথা থেকে? দু-তিনদিন ধরে এই এক দৃশ্য দেখার পর একদিন ওই রাস্তায় বটুক মিস্ত্রিকে খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছিলেন নির্মল মাস্টার। বটুক ইলেকট্রিকের কাজ করে। বটুক বলেছিল এই তেঁতুল গাছে বহুবছর ধরে ভূত থাকে। গাঁয়ের মানুষ এ রাস্তায় আসতো না আগে। এখন দায়ে পড়ে আসে। নির্মল মাস্টার বুবির দিকে আঙুল তুলে ক্ষীণ গলায় বলেছিলেন, “ও কে?”

– “ও তো বুবি। কানে শুনতে পায়নে। কথাও বলতে পারেনে। ওর বর হাবা, তা-ও কানে একটু শোনে – সে-ও কথা বলেনে, তা-ও একটু আওয়াজ বেরোয় মুখ দিয়ে। ওওওওই দিগের জমিতে খাটে। মেয়েদের মত চলা- ফেরা সঅঅঅঅব – খবর আচে ছেলে দেকলে হাবা ছুক ছুক করে। বউটাকে বোধহয় তেঁতুল ভূতে ধরে” বলেই চোখ টিপে সাইকেলের উঠল বটুক।

– “তেঁতুল ভূত?” মাস্টার আবার তাকালেন গাছটার দিকে।

– “ওই জলে মাঝে মাঝে ছায়া পড়ে – দেখেচে অনেকে ” — সাইকেলের গতি বাড়াল বটুক।

হাবা ছেলেটাকে আগে দেখেছিলেন নির্মল মাস্টার। শহর হলে হয়ত ওকে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হত না। শহরের অলিতেগলিতে আজকাল সমকামীদের দিকে আর কেউ তাকায় না। সব স্বাভাবিক। দু-একদিন দূর থেকে লক্ষ্য করে একদিন বুবির কাছে গেলেন নির্মল মাস্টার। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকাল বুবি। চমকে উঠেছিলেন মাস্টার। এত সপ্রতিভ চোখ আগে চোখে পড়েনি। সুগোল শ্যামলা শরীর ভরন্ত। একগোছা শাপলার মত বুবি চোখ তুলে আছে আলোর দিকে। এ মেয়ে নাকি বলতে পারে না, শুনতে পায় না! সহজভাবে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে মাস্টারের সারা শরীরে চোখ বোলাল বুবি। তারপর নিঃশব্দে হাসল। হাসার সময় চোখ দুটো ছোট করে তীক্ষ্ণ তাকাল নির্মল মাস্টারের দিকে। তারপর ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো ডুকরে ডুকরে হাসতে লাগল বুবি। মাস্টারের মনে হল, তার সবকিছু ভেদ করে ভিতরটা দেখতে পাচ্ছে বুবি। এ দৃষ্টি এড়ানো সহজ নয়। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাত-পা অস্থির অথচ ঝিমঝিম করতে লাগল মাস্টারের। আড়চোখে বুবির দিকে তাকাতে তাকাতে অসংলগ্ন পা ফেলে রাস্তায় এসে কাঁপা কাঁপা হাতে সাইকেল চড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন নির্মল মাস্টার।

সেই শুরু। তারপর সকালে ইস্কুল যাবার রাস্তায় আর বিকেলে ফেরার রাস্তায় সাইকেল দাঁড় করিয়ে বুবির পাশে গিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়েছেন নির্মল মাস্টার। বুবির সেই এক দৃষ্টি, এক হাসি। মাস্টারের দিকে তাকিয়ে ঘাসের ওপর হেলে পড়ে বুবি। কাঁধ থেকে কাপড় সরে যায়। মাস্টার আবার কাঁপা কাঁপা পায়ে ফিরে যান সাইকেলে।

আজ বুবির পাশে দাঁড়িয়ে পুকুরের জলের দিকে তাকালেন নির্মল মাস্টার। তেঁতুল গাছের ঘন ছায়া জলে পড়ে ছোট ছোট তরঙ্গে কাঁপছে। সবাই বলে, বুবিকে তেঁতুলভূতে ধরে। তেঁতুল ভূতের ছায়া কি জলে পড়ে? নির্মল মাস্টার একদৃষ্টে তাকান জলের দিকে। তেঁতুল গাছের ছায়া কাঁপছে তিরতির করে।

(২)

রাত চারটের নমাজ শুরু হল মসজিদে। শোবার ঘরের পাশে এক চিলতে বারান্দায় ছোট কাঠের টেবিল পাতা। সামনে একটা বেতের উঁচু চেয়ারে নির্মল মাস্টার বসে আছেন। টেবিল ল্যাম্পের জোরালো আলোটা এই শেষ রাতে কেমন নির্লজ্জ সাদা হয়ে আসে! নির্মল মাস্টার একবার আলোর দিকে তাকালেন, আর একবার সামনে খাতার সাদা পাতার দিকে। গত তিনমাস ধরে একটা গল্পও এগোয়নি। কোনও গল্প নিয়ে এগোনোর মত মানসিক অবস্থা এই মুহূর্তে মাস্টারের নেই। এই এক গল্প নির্মল মাস্টারকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বুবি আর তেঁতুলভূতের গল্প। কিন্তু গল্পটা যে কি নিয়ে সেটাই বুঝতে পারছেন না নির্মল মাস্টার। কার গল্প লিখবেন? বুবির কথা তো কিছুই বোঝা যায় না। বুবিকে যে ভূতে ধরেছে সেই তেঁতুলভূতকে কোনওদিন দ্যাখেননি মাস্টার। গল্পটা ঠিক কি? কার গল্প তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁকে? কোথায় পাওয়া যাবে গল্পটা?

Bengali Short Story By Amrita Bhattacharya 'Bubi O TentulBhuter Golpo' Robibarer Royak

ঘরের ভিতর থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বাড়ছে। এই ভোরের দিকে কষ্ট বাড়ে ঈশানীর। বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় সেই যে পড়ল, তারপর বিছানা থেকে আর উঠতে পারল না। বিয়েটা চাকরি পাওয়ার পর একটু দেরিতেই করেছিলেন নির্মল মাস্টার। ভালোবেসে এক বছর প্রেম, তার পর বিয়ে। দাম্পত্য বলতে পাঁচ মাসের কিছুটা সময়। ঈশানীর নাচের কেরিয়ারটা সবে একটু ঠিকঠাক হচ্ছিল। সেটা ছেড়ে তখন মাস্টারের সঙ্গে শ্রীপুরে আসতে মত করেনি ঈশানী। ঈশানীকে বাগবাজারে বাবা মা-র সঙ্গে রেখে দিয়ে শ্রীপুরে এক কামরার ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিলেন তিনি। পাঁচ মাসের মাথায় হঠাৎ করে মেরুদণ্ডে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল ঈশানী। তিনটে পর পর সাংঘাতিক সার্জারির পর আঠারো দিনের কোমা। কোমা থেকে বেরোনোর পর গত চার বছরে একবারও উঠে বসেনি ঈশানী। বাড়িতে রেখে এক বছরে চিকিৎসায় কোনও উন্নতি হওয়া তো দূর, পরিস্থিতি রোজ খারাপ হয়। ওদিকে বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। ঈশানীর নিজের বলতে এক খুড়তুতো দিদি। সে-ও এড়িয়ে গেল। তারপর ঈশানীকে শ্রীপুরে এনে রাখা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। সারাদিন একজন মাসি দেখাশোনা করে। সন্ধের পর মাস্টার নিজেই খাইয়ে, বাথরুম করিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে দেন। সবই তো বিছানায়। ন্যাপথালিন দিয়ে রাখেন, বেডসোরের ওষুধ লাগান। ঘরের অন্য দিকে একটা সিঙ্গেল খাটে নির্মল মাস্টার নিজের শোওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। ঈশানী দিনরাত চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে পড়ে থাকে। শুধু ভোরের দিকে একটা অদ্ভুত গোঁ গোঁ আওয়াজ করে। সকাল হওয়া পর্যন্ত আওয়াজটা বাড়তে থাকে। একটু রোদ উঠলে আবার ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ সব। ভোরের পর আর ঘুম হয় না নির্মল মাস্টারের। ঈশানী আওয়াজ শুরু করলেই তাঁকে জল খাইয়ে বাথরুম করিয়ে বারান্দায় টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে লিখতে বসেন তিনি। আজ সারা রাত বারান্দাতেই কাটল। এই সাদা পাতার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অস্থির , আরও অস্থির হচ্ছে সময়। গল্পটা আসলে কিসের? মাথাটা দু'হাতে ধরে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়েন নির্মল মাস্টার। এমন কখনও হয়নি আগে। আর কি কোনওদিন কোনও লেখা আসবে না তাঁর কাছে? ঝটকা দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে ঘরের মধ্যে গেলেন নির্মল মাস্টার।

জোরালো আলোর পর নাইটল্যাম্পের সবুজ আলোটা চোখে পড়ে না প্রথমে। অভ্যেসমত ঈশানীর খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন নির্মল মাস্টার। খাটের ওপর কুঁকড়ে শুয়ে আছে ঈশানী। নাইটি থেকে বেরিয়ে আছে জীর্ণ হাত পা। চার বছর আগের সেই মোমের শরীরের হাড় ক'খানা বিছানার উপর গুটিয়ে পড়ে আছে। ডান হাতটা ধরতেই হাল্কা নড়ে উঠল ঈশানী। ঠাণ্ডা কাঠির মত দু'টো হাত। গোঁ গোঁ শব্দটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে আবার শুরু হল ধীরে ধীরে। গায়ের চাদরটা ভালো করে টেনে দিয়ে আবার বারান্দায় এলেন মাস্টার।

বাইরে অল্প অল্প আলো ফুটেছে। হঠাৎ ছটফট করে উঠলেন মাস্টার। সাদা পাতার দিকে তাকালেন। কি অদ্ভুত! সাদা পাতার উপর যেন পর্দার মত সরে গেল বুবির চোখ দু'টো। তাঁর দিকে তাকিয়ে ঘাসের ওপর হেলে সেই হাসিটা হাসল বুবি। কাঁধ থেকে আঁচলটা খসে পড়ল … ভরন্ত দীঘিতে দু'টো শাপলা হাসছে …

আরও পড়ুন: কালো বোতলের জল : অমৃতা ভট্টাচার্য

মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল মাস্টারের চোখে। বাড়ির স্লিপারটা পরেই ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে সাইকেলটা বের করলেন নির্মল মাস্টার। ঊর্ধ্বশ্বাসে প্যাডেল চালালেন তেঁতুল গাছটার দিকে।

(৩)

সাইকেল রাস্তায় রেখে গাছের গোড়ার কাছে জলের ধারে দাঁড়ালেন মাস্টার। তেঁতুল গাছটার কাছে কিছুটা অন্ধকার পড়ে আছে এখনও। এই নির্জন ভোরে তেঁতুল ভূত দেখা যেতে পারে না? বুবিকে তো এই ভূতেই ধরে! এই প্রথম বুবি ছাড়া তেঁতুল গাছটা দেখলেন মাস্টার। বুবি এখনও আসেনি। ভোরের হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে পুকুরের জল। ধীরপায়ে এগিয়ে জলের দিকে ঝুঁকলেন মাস্টার। এত ভোরে জলে তেঁতুল গাছটার ছায়া নেই। কী অদ্ভুত! এই আবছা আলোতেও জলের ওপর তার নিজের মুখের ছায়া বেশ পরিষ্কার। জলের দিকে আরও ঝুঁকলেন তিনি। আলো-আঁধারি জলের ওপর কাঁপতে থাকা নিজের অস্থির মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে রইলেন নির্মল মাস্টার।

(৪)

শ্রীপুরে বুবিকে আর দেখা যায়নি কখনও। রোজ সকালে একটা একটা লাল পিঁপড়ে ঝেড়ে ফেলে ঈশানীর শরীরের চারপাশে একধরণের তীব্র গন্ধের পাউডার ছড়িয়ে দেন মাষ্টার। লেখালেখির পাঠ কবেই চুকে গেছে মাস্টারের! সকালে স্কুলের পর মাঝে মাঝেই কোথায় যেন উধাও হয়ে যান তিনি। নিঝুম দুপুরে পথ চলতি অনেকেই দেখেছে তেঁতুলগাছের নীচে দু-পা ছড়িয়ে বসে আছেন নির্মল মাস্টার। কেউ ডাকলে তিনি শুনতে পাচ্ছেন বলে মনে হয় না। নির্মল মাস্টারের শূন্য দৃষ্টি কালচে শ্যাওলা জলের দিকে স্থির। সাইকেলটা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার ধারে।

More Articles