নিম গাছতলার হাওয়া : অলোকপর্ণা
Bangla Short Story: বারান্দার চৌকাঠ বাঘার পার করা হয়নি। বারান্দায় সে যেখানে বসে থাকতো সেখানে দেওয়ালে তার পিঠের ছাপ পড়ে গেছিল। তাই বলে তার হিংস্রতা কমেছে, এমনটা ভাবা ভুল
শেষদিকে এরা খাওয়া বন্ধ করে দেয়, শিমুল এমনটাই দেখে এসেছে। মুখের কাছে খাবার এগিয়ে দিলেও অনীহা চেপে বসে এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মুখ ফিরিয়ে নেয়। হাত-পা অবশ হয়ে এলিয়ে থাকে, যেন চার ভাই বোন, অনেকটা ক্রোশ পাড়ি দেওয়ার পর এ ওর গায়ে পড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। চোখের জ্যোতি কমে আসে, শত্রুর প্রতি বাৎসল্য জন্মায়। শিমুল দেখেছিল বাঘার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে মদনমোহন। তিনদিন আগেও তাদের সাপে নেউলে সম্পর্ক, এ ওকে দেখলে তেড়ে যায়, বাগে পেলে শিকার পর্যন্ত করে ফেলে। মদনমোহন চুপ করে বাঘার পাশে বসে ধুঁকেছিল, তারপর নিজেকে টেনেহিঁচড়ে লোকচক্ষুর আড়াল করেছিল। শেষদিকে এরা নির্জনতা চায়, শিমুল দেখেছে। সন্ন্যাসীর মতো নিভৃতে এরা শেষ করতে পছন্দ করে।
বাঘাকে কখনই এবাড়ির কেউ তেমন লাই দেয়নি, কারণ মদনমোহনের সঙ্গে তার বরাবরের চুলোচুলির সম্পর্ক। জনাকীর্ণে কিশোর মদনমোহনকে পেলেই বাঘা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রোশ মেটাত। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দাবার চাল উলটে গেল, মদনমোহন কেবল বাঘাই নয়, হীরালাল, গুড়গুড়ি, বিধু প্রত্যেককে পায়ের তলায় রাখা শুরু করে দিল। তার জীবনে লড়াইয়ের অভাব ঘটেনি, সে লড়াই জরুরি হোক বা না হোক। এত লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতে তার এক চোখ গেল কানা হয়ে, হাত-পা সে মাঝেমধ্যেই ভেঙে থাকত। মদনমোহনের স্বাস্থ্যভঙ্গ হলো প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়।
তারপর থেকে বাঘা একা।
বিধুর সঙ্গে তার মধুর সংসার। ছোট ছোট সন্তান, তাদের সব বাঘার মতো দেখতে। অসম্ভব সম্ভাবনাময় তারা প্রত্যেকে। তাকে দিনরাত ঘিরে থাকে। বাঘার বাৎসল্য দেখে এবাড়ির সবাই সন্তানস্নেহ শিখছিল।
শিমুল চেষ্টা করেছে মদনমোহন গত হওয়ার পর বাঘাকে এবাড়িতে আনতে। বাঘা পিছনের বারান্দা অবধি এসে থমকে যেত, ভিতরে ডাকলে কোথাকার সব কফ এসে জড়ো হত তার গলায় আর বিকট কাশি শুরু হত তার। কাশির দমকে বাঘা এগোতে পারত না আর, পিছনের বারান্দায় ধপ করে বসে পড়ত। প্রতিবার সাদরে আমন্ত্রণ আর প্রতিবার বিকট কাশি। এই কাশির উৎস গলা অবধি অভিমান— শিমুলের এমন সন্দেহ হতো।
আরও পড়ুন- অদিতি যে ক’টি ভাষায় কথা বলে : অলোকপর্ণা
অতএব বারান্দার চৌকাঠ বাঘার পার করা হয়নি। বারান্দায় সে যেখানে বসে থাকতো সেখানে দেওয়ালে তার পিঠের ছাপ পড়ে গেছিল।
তাই বলে তার হিংস্রতা কমেছে, এমনটা ভাবা ভুল। হীরালাল এবাড়িতে নিয়মিত হয়ে উঠলে সে পরবর্তী মদনমোহন হয়ে পড়ে। বাঘার সঙ্গে দিবারাত্র তার ডুয়েল তখন। কিছুদিনের মধ্যেই হীরালাল পরাজয় মেনে নেয় এবং চোরের মতো বাঘার নজর এড়িয়ে বাড়িতে যাতায়াত করতে থাকে। তারপরেও কী উপায়ে যেন তার পথ আটকে ধরতো বাঘা। উপায় না থাকায় বাড়ির লোকেরা পথে নামল শেষে। শিমুল, যে একদা বাঘাকে সাদরে গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল, সে পর্যন্ত হাতে লাঠি, মুখে মুখোশ ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত হলো। বাঘার জন্য পাতা হলো ফাঁদ। বাঘা সে ফাঁদে পা দিতেই তার পিঠে, মাথায় করা হলো লাঠির আঘাত।
হীরালাল রক্ষা পেল।
বাঘাকে রাখা হল বাগানে নিম গাছের ছায়ায়। মুখের কাছে খাবার এগিয়ে দিলে সে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার হাত-পা এর ওর সঙ্গে জট পাকিয়ে শিশিরে ভিজছে। বাগানের দিকের দুয়ার দেওয়া হলে বাঘা ওর চৌকো চোখগুলো বন্ধ করল।
ভোররাতে শিমুল বাঘাকে নিম গাছের তলাতেই মাটি দিল।
বেলা বাড়তে শিমুলের গলা ব্যথা।
বিকেলের দিকে মাথা ভার।
রাতে চৌকাঠ পার হতে গেলেই গলা অবধি কফ উঠে সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। কাশতে কাশতে শিমুল বারান্দাতেই বসে পড়ে ধপ করে। জন্মজন্মান্তরের কফ যেন গলা বেয়ে হামা দিয়ে উঠে আসছে। সঙ্গে একনাগাড়ে কাশি। বাড়ির লোকেরা বিরক্ত হয় বিকট কাশির আওয়াজে। কাশতে কাশতে পিঠ বেঁকে গেলে শিমুল দেওয়ালে পিঠ ঠেকায় আর দেখে তার পাশেই বাঘার বসে থাকার চিহ্ন জ্বলে আছে।
দেওয়ালে যাতে আর নতুন ছাপ না পড়ে, শিমুল তাই সরে বাঘার বসার জায়গাতেই বসে।
আর কোনওদিন তার কোনও চৌকাঠ পার করা হয় না।