মমতাও চাইছেন কংগ্রেস-মুক্ত ভারত? ২০২৪-এর অঙ্ক যেভাবে কষছেন তৃণমূল নেত্রী

Mamata Banerjee: নীতীশ-অস্ত্রে বিরোধী ঐক্যে শান দিতে আপত্তি নেই তৃণমূলের, বুঝিয়ে দিচ্ছেন মমতা!

"নরেন্দ্র মোদি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্য এক, দু'জনেই কংগ্রেসমুক্ত ভারত চান।" আরএসএস-ঘনিষ্ঠ পত্রিকা 'স্বস্তিকা'-র একটি প্রতিবেদনে উল্লেখিত এই মন্তব্যে তোলপাড় শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে। তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। স্রোতের অভিমুখ ক্রমশ এগিয়েছে যমুনাপাড়ের দিল্লির দিকে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরেছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবর্তিত হয়েছে মোদি বিরোধিতার রাজনৈতিক গতিপথ। আর এই পথেই সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক খানাখন্দের। যা একই লক্ষ্যে এগোনো একাধিকের অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং রাজনৈতিকভাবে কে বড়, কে ধরবেন মোদি বিরোধিতার ধ্বজা, তাই নিয়ে দ্বন্দ্বকেই প্রকাশ করেছে নিরন্তর। আর এর রেশ ধরেই ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে কংগ্রেস! বলা ভাল, মোদি বিরোধিতা, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে রাজনৈতিকভাবে কংগ্রেসকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কৌশল নিচ্ছেন অন্যান্য বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা।

কেন উঠছে এই প্রশ্ন? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, কংগ্রেসকে অপ্রাসঙ্গিক বা একঘরে করার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। যে দলই তৈরি হয়েছিল বঙ্গের কংগ্রেস ভেঙে। আর আগামী লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে নিজেকে দেশীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তুলে ধরতে চাইছেন মমতা। যে চেষ্টা আগেও যে হয়নি তা বলা ভুল। কারণ, গত লোকসভা নির্বাচনের আগেও 'দিল্লি যাবেন হাওয়াই চটি' অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই স্লোগান সাড়া ফেলেছিল বাংলায়। কিন্তু সফল হননি মমতা। কংগ্রেস প্রভাব ও একাধিক সমমনস্ক দলের ঐক্যের অভাব আর মমতাকে মুখ হিসেবে সকলের মেনে না নেওয়া সার্বিকভাবে সুবিধা দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদিকে। বিরোধী ঐক্যের যত বেশি ফাটল, তত বেশি রাজনৈতিক লাভের দিকে এগিয়েছিল বিজেপি।

কিন্তু এবারের পরিস্থিতি খানিকটা আলাদা। গত জুলাই মাস পর্যন্ত মোদি বিরোধিতায় মমতার উঠে আসার যে প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা নীতিশ কুমারের নতুন চালে। হঠাৎ বিজেপি-সঙ্গ ছেড়ে নীতিশ হাত ধরেছেন লালু-পুত্র তেজস্বী যাদবের দলের। বিহারে বদলেছে সরকার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী থেকে গিয়েছেন নীতিশ-ই। আর তারপর থেকেই একদা মোদির বন্ধু, অলআউট আক্রমণে সরব হচ্ছেন গেরুয়া-বিরুদ্ধে। সম্প্রতি দিল্লিসফরে গিয়ে একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। এখানেই এক সূক্ষ্ম লড়াইয়ের কথা বলছেন কেউ কেউ। মমতা না নীতিশ, কে হবেন দিল্লির মোদি বিরোধিতার মুখ? এই প্রশ্নেই চলছে কাঁটাছেড়া। যদিও এই আবহেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আরএসএস এবং বিজেপির প্রতি নরম মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিজেপির বিরুদ্ধে ঝাঁঝ কমেছে মমতার, এই প্রশ্নেও সরব হচ্ছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন: পিকে বিজেপির গোপন তাস, কেন বলছেন নীতীশ? বিস্ফোরক অভিযোগের আড়ালে কোন সত্যি

তবে শোনা যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ফের ভিন্ন কৌশল নিতে পারেন মমতা নিজেই। মিশন ২০২৪-এর লক্ষ্যপূরণ করতে, রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তি লাভের তাগিদে এই মমতাই পরিবর্তন করতে পারেন রাজনৈতিক কৌশল। এমনই বলছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। কেন?

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল, বিচারকদের সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি যান মমতা। সেখানে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। এই সময় এবং এর আগে-পরে মমতা অথবা তৃণমূল নেতৃত্ব প্রায় প্রতিদিন বিজেপি, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে। দেশজুড়ে মোদির বিপক্ষ মানেই যে মমতা, এই অবস্থান কংগ্রেস বা সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ছাড়িয়ে খানিকটা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল। যেখানে দাঁড়িয়ে জুন মাসে মমতার তিনদিনের দিল্লি সফর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী নিয়ে আলোচনায় একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা, সোনিয়া গান্ধী, অরবিন্দ কেজিওয়াল, এমকে স্তালিন, এমনকী, নবীন পট্টনায়ক-সহ একাধিক নেতাকে চিঠি দেন মমতা। বৈঠকে শরদ পাওয়ার রাষ্ট্রপতি পদে বিরোধী প্রার্থী হিসেবে রাজি না হওয়া, অবশেষে একাধিক নাম ঘুরে মমতার অনুমতিতে, বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে আসা নেতা যশোবন্ত সিংকে প্রার্থী করে বিরোধীরা। প্রতিষ্ঠিত হয় বিরোধী ঐক্য। অর্থাৎ মমতার হাত ধরে মোদি-বিরোধিতার মঞ্চ শক্ত হচ্ছে, এই প্রচারও শুরু হয়। যেখানে কংগ্রেসকে নিষ্ক্রিয় করে বিজেপি-র সঙ্গে পাল্লা দেবে মমতার নেতৃত্বে বিরোধীরা, এই জল্পনাও সামনে আসে। যদিও এই পরিস্থিতির মধ্যেই বদলে যায় প্রেক্ষাপট। বঙ্গের দুর্নীতি, সিবিআই, পার্থ চট্টোপাধ্যায়-গ্রেফতারের আবহে উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূলের নিষ্ক্রিয় থাকা প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। এর মধ্যেই অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে মমতার প্রায় ঝাঁঝহীন দিল্লি সফর। মোদি-সাক্ষাৎ ফের মমতার মোদি-বিরোধিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

এর মধ্যেই মমতার পরিবর্তে সুবিধে পাবে কংগ্রেস, মুখ হবেন রাহুল গান্ধী- এই জল্পনা শুরু হয়। কংগ্রেসের অন্দরের সভাপতি নির্বাচন নিয়ে অশান্তি, দলের মুখ হিসেবে রাহুল গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং একাধিক আঞ্চলিক দলের কংগ্রেস অসন্তোষের মধ্যেও মমতা-ইস্যুকে ঢাল করে ফের সামনে আসার সুযোগ পায় কংগ্রেস। কিন্তু এখানেই বাধ সাধেন নীতীশ কুমার। তাঁর হঠাৎ দিল্লির বাতাস গরম, মমতার বিকল্প তৈরি করেছে বলে বলা হয়। রাজনৈতিক মহলের ওই অংশের যুক্তি, আর এই পরিস্থিতিতে ফের বিতর্ক বাড়াতে চাইছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস 'ভারত জোড়ো যাত্রা'-র আবহে রাজনৈতিক অক্সিজেন পাওয়ার চেষ্টা করলেও নীতীশ-অস্ত্রেই বিরোধী ঐক্যে শান দিতে আপত্তি নেই তৃণমূলের! যেখানে মোদিবিরোধী মুখ হিসেবে যদি মমতা না-ও থাকেন, সেই পরিস্থিতিতে নীতীশ কুমারের উঠে আসাকে সমর্থন জানাতে পারে তৃণমূল। অর্থাৎ, নীতীশ অথবা মমতা, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যেই-ই কেন্দ্রের বিরোধী প্রধান বা মোদিকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী হোন, আপত্তি না করতে পারে তৃণমূল। রাজ্যের পরিস্থিতি, কেন্দ্রীয় এজেন্সি এবং বঙ্গের বিরোধীদের 'মোদির সঙ্গে সেটিং' তত্ত্বের অভিযোগের আবহে আপাতত এই রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারেন মমতা। কারণ, এই মুহূর্তে দেশজুড়ে ক্রমশ কমছে কংগ্রেস। রাজস্থান এবং ছত্তিশগড় ছাড়া আর কোনও রাজ্যে নেই কংগ্রেস সরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষত দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক রাজ্য; যেমন- বিহার, ওড়িষা, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গনায় আঞ্চলিক দলের সরকার। এছাড়া উত্তর-পূর্বের একাধিক রাজ্য এবং মহারাষ্ট্র, গুজরাত, জম্মু-কাশ্মীরের মতো রাজ্যেও শক্ত বিরোধী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক দল।সেখানে দাঁড়িয়ে মাত্র দু'টি রাজ্যে শাসন এবং দেশজুড়ে ক্রমশ খারাপ পরিস্থিতি হওয়া কংগ্রেসকে বেশি প্রাধান্য দিতে চাইছে না একাধিক আঞ্চলিক দল। আর এই পরিস্থিতিকে পাখির চোখ করেই এগোচ্ছে তৃণমূল। যেখানে বঙ্গের কংগ্রেস বিরোধিতাকে সঙ্গী করে দেশজুড়ে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধিতার চেষ্টায় ত্রুটি রাখছে না তৃণমূল। যেখানে নীতিশ কুমার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি একলাইনেও থাকেন তাতেও তেমন একটা আপত্তি না থাকার সম্ভাবনা।

কিন্তু কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মমতা অথবা নীতীশরা কি বিজেপি বিরোধিতা সফল করতে পারবেন? না কি আঁতুড়েই শেষ হবে বিরোধী ঐক্যের কৌশল। বিরোধীদের অন্দরের কোন্দল সুবিধা দেবে বিজেপি-কে? এই প্রশ্নের আবহেই বলা হচ্ছে, কংগ্রেসকে ব্রাত্য রেখে বিরোধী জোট অলীক স্বপ্ন হতে পারে। কারণ, দেশের প্রায় সব রাজ্যেই কংগ্রেসের অস্তিত্ব বর্তমান। সেখানে দাঁড়িয়ে একাধিক রাজ্যে আঞ্চলিক দলের সরকারে ভূমিকা রয়েছে কংগ্রেসের। এই পরিস্থিতিতে তামিলনাড়ু অথবা ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যে কংগ্রেসের বন্ধু হিসেবে নিজেদের প্রায় প্রতিষ্ঠিত করেছে সেই রাজ্যের শাসক দল। এই অবস্থায় কংগ্রেসের দলীয় কোন্দল ছাড়িয়েও লোকসভা নির্বাচনে প্রাসঙ্গিক থাকা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। আর তাদের বাদ দিয়ে লোকসভা নির্বাচনের কৌশল ও অঙ্ক সাজানো ঠিক কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়েও সন্দিহান রাজনীতির কারবারিরা।

More Articles