টানা লোডশেডিংরাজ্য জুড়ে, কোন সত্য গোপন করছে বিদ্যুৎ দফতর?
Power Cut: কোথাও যান্ত্রিক ত্রুটি, কোথাও বা রক্ষনাবেক্ষণের কাজের মতো নানা অজুহাত দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ দফতরের তরফে। তবে অন্দরের খবর বলছে অন্য কথা। জানা গিয়েছে, রাজ্যে প্রায় ২৫০০ মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে।
মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে শরৎ। পুজো আসতে আর মাস দুয়েকও বাকি নেই। অথচ বঙ্গে গরমের কমতি নেই এক ফোঁটা। তার মধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়া লোডশেডিং। না কোনও একটি বা দুটি জায়গায় নয়, গোটা রাজ্য জুড়েই বেড়েছে লোডশেডিংয়ের প্রকোপ। গরমে নাজেহাল মানুষ, লোডশেডিংয়ের ফলে যেভাবে কাজকর্ম বিঘ্নিত হচ্ছে, তাতে বিরক্তি বেড়েছে আরও কয়েকগুণ।
কোথাও যান্ত্রিক ত্রুটি, কোথাও বা রক্ষনাবেক্ষণের কাজের মতো নানা অজুহাত দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ দফতরের তরফে। তবে অন্দরের খবর বলছে অন্য কথা। জানা গিয়েছে, রাজ্যে প্রায় ২৫০০ মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। আর সেই ঘাটতি কমাতেই জেলায় জেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখছে দফতর। তবে সেই তথ্যটা সাধারণ মানুষের কান অবধি পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না। যান্ত্রিক বিভ্রাটের মলাটে তাকে গোপন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগের কাঠগড়ায় নবান্নও।
আরও পড়ুন: বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিণাম কী? দেশ কি বড় বিপদের সম্মুখীন?
পাওয়ার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (পিডিসিএল) সূত্রের খবর, শুক্রবার বেলা তিনটে পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা পৌঁছেছিল প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াটে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে মাত্র ২৪০০ মেগাওয়াট। ফলে ব্যাপক ঘাটতি যে রয়েই গিয়েছে, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এই বিদ্যুতের ঘাটতি! উঠেছে প্রশ্ন।
তার অবশ্য সঙ্গত কারণ এবং যুক্তি, দুই-ই রয়েছে বিদ্যুৎ দফতরের কাছে। তাদের দাবি, দৈনিক ৪২৬৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় রাজ্যে। তবে সেই উৎপাদন সম্প্রতি বেশ খানিকটা কমেছে সাগরদিঘি, বক্রেশ্বর, কোলাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশ কয়েকটি করে ইউনিট বন্ধ থাকার জন্যে। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে সম্প্রতি রক্ষনাবেক্ষনের কাজ শুরু হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও ৩৭৫৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হাওয়ার কথা। কিন্তু শুক্রবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৪০৯ মেগাওয়াট।

আর এ সময়েই রাজ্য জুড়ে বেড়েছে ব্যাপক বিদ্যুতের চাহিদা। তার একটা কারণ ভ্যাপসা, দমবন্ধকর আবহাওয়া তো বটেই। শুক্রবার বিকেল তিনটে পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা পৌঁছে যায় ৫ হাজার মেগাওয়াটে। এদিকে রাজ্যে চাহিদার অর্ধেক পরিমাণও বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়নি ওই দিন। ফলে সেই ঘাটতি মেটাতে বাধ্য হয়েই সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ দফতর। যার জেরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকছে রাজ্যের বিভিন্ন অংশ। যদিও তা মানতে নারাজ বিদ্যুৎ দফতর। লোডশেডিং শব্দটাই মানতে চাইছে না তাঁরা। 'লোকাল ফল্ট' বলে দায় সারছেন তাঁরা।
আর এই কূটবুদ্ধির কারণেই গ্রামেগঞ্জে জনরোষের মুখোমুখি হতে হচ্ছে একাধিক বিদ্যুৎকর্মীদের। প্রায়শই গ্রাহকেরা নানারকম ভাবে নিশানা করছেন তাঁদের। উগরে দিচ্ছেন ক্ষোভ। বোলপুর ডিভিশনের হাতিয়া এলাকায় সাব-স্টেশনের বাইয়ে এসে ক্ষোভ দেখান গ্রামের মানুষ। হুমকি দেওয়া হয়। এমনকী চলে গুলিগালাও। যদিও কোনও হতাহতের খবর নেই। শুধু বীরভূম নয়, দিন কয়েক ঘরেই মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, ডোমকল-সহ একাধিক জায়গা থেকে বারবার লোডশেডিংয়ের খবর এসেছে। এক ঘণ্টা থেকে দু-ঘণ্টা, কোথাও আবার আরও বেশিসময় ধরে বন্ধ থাকছে বিদ্যুৎ পরিষেবা।

এই বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য প্রকৃতিকেও দুষছে বিদ্যুত দফতর। একে তো কয়লার জোগান অপ্রতুল, তার উপর বর্ষার কারণে কয়লা ভিজে থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাগনে সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিদ্যুৎকর্মীদের। ঝাড়খণ্ড, রানীগঞ্জ ও তার সংগলগ্ন এলাকা থেকেই কয়লা আসে বাংলায়। এদিকে ঝাড়খণ্ডের পাঁচওয়ারার কয়লাখনি থেকে কয়লা আসার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকদিন ধরেই গোলযোগ হচ্ছে। আপাতত ইসিএল থেকে কয়লা নিয়েই পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে বিদ্যুৎমন্ত্রক।
আরও পড়ুন: পেট্রোল-ডিজেলে নাভিশ্বাস, ভারতে বিদ্যুৎচালিত গাড়িই কি ভবিষ্যতের পরশপাথর?
যদিও অভিজ্ঞদের বক্তব্য, এ কোনও নতুন ব্যাপার নয়। প্রতিবছরই বর্ষার জন্য এমন সঙ্কটের মুখে পড়তে হয় দেশকে। তবে এবার সেই সঙ্কট এত ভয়াল আকার ধারণের পিছনে রয়েছে রাজ্যসরকার ও বিদ্যুৎদফতরের দুরদর্শিতার অভাব। আরও আগে থেকে পরিকল্পনা নেওয়া উচিত ছিল এ ক্ষেত্রে। অন্যান্য বছর এ সময় রাজ্যে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল, তা বিচার করেই পরিকল্পনা করা উচিত ছিল বলে মত অভিজ্ঞদের। তবে এই যে ঘাটতি, তার পিছনে মানুষেরও অবদান কম নয়। দীর্ঘকাল ধরে যেভাবে আমরা বিদ্যুতের অপচয় চালিয়ে এসেছি, তাতে এ দিন যে দূরে নয়, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। প্রতিমুহর্তে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সমস্ত শক্তিকে ফুরিয়ে ফেলছি। নিঃশেষিত করে দিচ্ছি পৃথিবীকে। ক্রমশ আরও বড় কোনও সঙ্কটের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। তারই আরও একটি শুরুয়াৎ এই দুর্বিসহ লোডশেডিং, বিদ্যুতের ঘাটতি।

Whatsapp
