দিল্লির দূষিত শ্বাস; সমাধান কি বেইজিংয়ের মডেল?
Delhi Air Pollution: চিনের রাজধানী বেইজিং একসময় দিল্লির থেকেও ভয়াবহ অবস্থায় ছিল। ২০১০ সালের দিকে সেখানে দূষণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, শহর প্রায় অন্ধকারে ঢেকে থাকত।
শীত এলেই দিল্লির সকাল যেন ধোঁয়া-ঢাকা এক দমবন্ধ দৃশ্যের জন্ম দেয়। ঘন কুয়াশার মতো দেখতে যে স্তরটি শহরকে ঢেকে রাখে, তা আসলে ধোঁয়া ও ধূলোর মিশ্রণ। এই ধোঁয়া-জ্বালা পরিস্থিতি আজ শুধু দিল্লির নয়, সমগ্র উত্তর ভারতের। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে দিল্লির আকাশে, দূষণের ঘন স্তর জমে ওঠে। বাতাসের গতি কম থাকে, ফলে বাতাসে থাকা দূষণকারী কণাগুলো ছড়িয়ে যেতে পারে না, বরং মাটির কাছাকাছি আটকে থাকে। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, চোখ জ্বালা, হাঁপানি ও হৃদরোগের মতো সমস্যা বেড়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধোঁয়া কি শুধু শস্য পোড়ানোর কারণে? নাকি শহরের শিল্প, যানবাহন, নির্মাণ ও ধুলোও এর জন্য সমানভাবে দায়ী? দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে, এর উৎস একটি নয় বরং একাধিক। কৃষিক্ষেত্রে ধান-পাট পোড়ানো, শহরের যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া, নির্মাণকাজ থেকে ধুলো, শিল্পাঞ্চল থেকে ধোঁয়া ও গ্যাস সবকটাই।
প্রতিবছর পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা ধান কাটার পর ধানপাট বা খড় জ্বালিয়ে জমি পরিষ্কার করেন। এতে বিশাল পরিমাণে ধোঁয়া ও বিভিন্ন ক্ষতিকর কণা বাতাসে মিশে যায়। এই ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে দিল্লি ও তার আশপাশের অঞ্চলে জমে। যেহেতু, এই সময় বাতাসের গতি কম থাকে, তাই দূষণ ছড়িয়ে না পড়ে রাজধানীর উপরে ঘন স্তর তৈরি করে। এছাড়াও, দিল্লি নিজেই এক বিশাল দূষণকেন্দ্র।
প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন যানবাহন রাস্তায় চলে, ডিজেল ও পেট্রোলচালিত গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া সরাসরি AQI বাড়ায়, নির্মাণকাজ থেকে নির্গত ধূলিকণা বাতাসে মেশে, এবং শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের মতো গ্যাস বায়ুমণ্ডলকে আরও ভারী করে তোলে। অর্থাৎ, কৃষির পাশাপাশি শহরের যানবাহন ও শিল্প উভয়েই দূষণের মূল উৎস। দিল্লির এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে, এর আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতি।
আরও পড়ুন- দিল্লিতে কৃত্রিম বৃষ্টি! ক্লাউড সিডিং কি পারবে রাজধানীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে?
শীতকালে বাতাসের গতি এবং তাপমাত্রা কম থাকায়, বাতাসের উপরের স্তর ঠান্ডা হয়ে নেমে আসে এবং নিচের স্তরের গরম বাতাস আটকে পড়ে। একে বলে, 'টেম্পারেচার ইনভার্শন'। ফলে বাতাসে থাকা দূষণ উপরের দিকে উঠতে না পেরে শহরের উপরেই ঘন স্তর তৈরি করে। এমতাবস্থায়, দূষণ ছড়িয়ে না গিয়ে জমতে থাকে, আর AQI সূচক ‘বিপজ্জনক’ মাত্রায় পৌঁছয়। অনেক সময় স্কুল বন্ধ রাখতে হয়, নির্মাণকাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয় এবং নাগরিকদের মাস্ক পরতে বাধ্য করা হয়।
চিনের রাজধানী বেইজিং একসময় দিল্লির থেকেও ভয়াবহ অবস্থায় ছিল। ২০১০ সালের দিকে সেখানে দূষণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, শহর প্রায় অন্ধকারে ঢেকে থাকত। শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার— সবই বেড়ে যাচ্ছিল। তখন ২০১৩ সালে, চিন সরকার ঘোষণা করে 'দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'। শুরু হয় এক বিশেষ পরিকল্পনা, যার মূল লক্ষ্য ছিল বাতাসের মান উন্নয়ন করা। এই পদক্ষেপগুলি ছিল বহুস্তরীয় ও সুসংগঠিত। যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয়েছে, সেগুলি হল কয়লাভিত্তিক শক্তি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ। বেইজিংয়ে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গৃহস্থলি জ্বালানি ব্যবহারে কড়া নজরদারি চালানো হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করে গ্যাস বা নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। শুরু হয় শিল্প ও যানবাহনে কঠোর নিয়ম। শিল্পাঞ্চলগুলিতে নির্গমন মানদণ্ড কঠোর করা হয়। পুরনো কারখানা ও যানবাহন ধাপে ধাপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিটি গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট নির্গমন সীমা নির্ধারণ করা হয়। গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের পরিমাণ সীমিত করা হয় এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হয়।

বেইজিংয়ে ছোটা ইলেকট্রিক বাস
গণপরিবহন ও প্রযুক্তি উন্নয়নে মেট্রো রেল, ইলেকট্রিক বাস, সাইকেল নেটওয়ার্কের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমে। একইসঙ্গে, দূষণ পর্যবেক্ষণের জন্য উন্নত সেন্সর ও স্যাটেলাইট ব্যবহারের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম মনিটরিং চালু হয়। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিকেও এই উদ্যোগগুলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও বেইজিং বুঝেছিল, শুধু শহরের ভেতরে কাজ করলে চলবে না। কারণ, দূষণ আসে আশপাশের অঞ্চল থেকেও। তাই একে ঘিরে থাকা হেবেই, তিয়ানজিন প্রভৃতি অঞ্চলেও সমানভাবে নীতি প্রয়োগ করা হয়। এই সব ব্যবস্থার ফলে মাত্র এক দশকে বেইজিংয়ের PM2.5 দূষণ প্রায় ৫০% হ্রাস পায়। শহরের আকাশে আবার নীল রং ফিরে আসে।তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, দিল্লিও কি বেইজিংয়ের মতো দূষণমুক্ত হতে পারবে? উত্তর- সহজ নয়। কারণ দিল্লি ও বেইজিংয়ের পরিবেশ, প্রশাসন ও সামাজিক বাস্তবতা এক নয়। বেইজিংয়ের আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা ও উপকূলীয় বায়ুপ্রবাহে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় থাকে, যেখানে বাতাস দূষণ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। কিন্তু দিল্লির শীতকালে বাতাস প্রায় স্থবির, তাই দূষণ আটকে থাকে। এছাড়া, বেইজিংয়ের আশেপাশে শস্য পোড়ানোর প্রচলন ততটা নেই। কিন্তু দিল্লির চারপাশে ধানপাট পোড়ানো বায়ুদূষণের বিশাল এক উৎস, যা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। চিনে সিদ্ধান্ত নেয় এককভাবে কেন্দ্রীয় সরকার, তাই দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। কিন্তু দিল্লিতে রয়েছে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা, কেন্দ্র ও দিল্লি সরকারের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি ও রাজনৈতিক মতভেদ, তাই এই সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়ে। বেইজিংয়ে নাগরিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও দূষণ রোধে ভূমিকাচোখে পড়ার মতো। দিল্লিতে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার, আবর্জনা পোড়ানো, নির্মাণে অনিয়ম এখনও অব্যাহত। দিল্লির এই সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি, তাই সমাধানও একদিনে হবে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দূষণ রোধে এখনই দশ থেকে পনেরো বছরের পরিকল্পনা নিতে হবে— যা হবে বাস্তবসম্মত, টেকসই। কৃষিক্ষেত্রে ধানপাট পোড়ানো বন্ধে বিকল্প প্রযুক্তি যেমন- হ্যাপি সিডার বা বায়োডিকম্পোজার ব্যবহার করতে উৎসাহ দিতে হবে। পাশাপাশি শিল্পাঞ্চলে নির্গমন পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক, পুরনো গাড়ি বাতিল-নীতি কার্যকর, বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহার, শক্তিশালী দূষণ মনিটরিং নেটওয়ার্ক, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে গণপরিবহন বেশি ব্যবহার, খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ, স্কুল ও কলেজে পরিবেশ শিক্ষা জোরদার করতে হবে। দিল্লির এই ধোঁয়া-জ্বালা পরিস্থিতি কেবল একটি মরশুমের সমস্যা নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশ সংকট। কৃষি, শিল্প, যানবাহন, আবহাওয়া সব মিলে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই চিনের বেইজিং আমাদের শেখায়, শুদ্ধ বাতাস পাওয়া সম্ভব, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। তবে দিল্লির প্রেক্ষাপট আলাদা কারণ, এখানে সাফল্য আসবে তখনই, যখন শহর ও গ্রামের সংযোগ, সরকার ও জনগণের সমন্বয় একই উদ্দেশ্যে কাজ করবে। দিল্লির আকাশে আবার নীল রং ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে প্রতি শীতেই আমাদের বলতে হবে ধোঁয়া-জ্বালার দমবন্ধ শহর, যেখানে শ্বাস নেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে।
Whatsapp
