এবছর কেন এত ঠাণ্ডা? আবহাওয়া পরিবর্তনের নেপথ্যে কী?

La Nina Effect: উত্তর ভারতে নভেম্বর থেকেই শীতল প্রবাহ শুরু হয়েছে। এর পিছনের কারণ হলো ‘পোলার ভর্টেক্স’। মেরু অঞ্চলে ঘূর্ণায়মান অত্যন্ত শীতল বাতাসের যে বলয় থাকে, তাকেই পোলার ভর্টেক্স বলা হয়।

আবহাওয়ারও বোধহয় মুড সুইংস হচ্ছে বুঝলি তো।

হ্যাঁ, এবছর সবকিছুই যেন বেশি বেশি। যেমন মাথা খারাপ করা গরম, তেমন বৃষ্টি হলো। এবার শীতটাও দেখ, বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।

শীতের সকালে কথা হচ্ছিল দুই বান্ধবী অঙ্কিতা ও রিয়ার। ভুল কিছু বলেনি ওরা, তবে মুড সুইংস নয়। আবহাওয়ার এই গোলমালের পিছনে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু কারণ। ভারতের আবহাওয়া দফতর (IMD) ১ ডিসেম্বর জানিয়েছে, এই শীতকালে স্বাভাবিকের তুলনায় ‘শীতল প্রবাহ’ (Cold Wave) দিনের সংখ্যা বেশি হবে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে দিল্লি, হরিয়ানা, পঞ্জাব, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, উত্তর মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিম মহারাষ্ট্র এবং অরুণাচল প্রদেশে।

IMD-র দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, সমতল অঞ্চলে কোনও স্থানের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০° সেন্টিগ্রেড বা তার কম হলে এবং পার্বত্য অঞ্চলে ০° সেন্টিগ্রেড বা তার কম তাপমাত্রার থাকলে ওই দিনটিকে ‘শীতল প্রবাহ’ (Cold Wave) দিন বলা হবে। আবার কোনও অঞ্চলের স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রার তুলনায় ৪.৫° থেকে ৬.৪° সেন্টিগ্রেড কমে গেলে, ভৌগোলিক অবস্থান যাই হোক না কেন, সেটিকেও ‘শীতল প্রবাহ’ হিসেবে ধরা হয়।

এই শীতের মাসগুলোতে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মধ্যভারত, উপদ্বীপীয় অঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে স্বাভাবিকের থেকে কম বা স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের বাকি অংশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের উপরে থাকার সম্ভাবনা। IMD আরও জানিয়েছে যে, এ’বছর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ‘শীতল প্রবাহ’ দেখা যাবে কেন্দ্রীয়, উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলে। 

আরও পড়ুন- সিসমোগ্রাফ থেকে রিখটার স্কেলের ইতিহাস | ভূকম্পন কীভাবে মাপা হয়?

আবহাওয়ার কেন এই পরিবর্তন? আইএমডি-র ডিরেক্টর জেনারেল এম. মহাপাত্র জানিয়েছেন, “এ’বছর লা নিনার প্রভাব রয়েছে। সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও অতীতে দেখা গেছে লা নিনার বছরে শীতল প্রবাহের প্রবণতা বেশি থাকে।” তিনি আরও জানান, উত্তর ভারতে নভেম্বর থেকেই শীতল প্রবাহ শুরু হয়েছে। এর পিছনের কারণ হলো ‘পোলার ভর্টেক্স’। মেরু অঞ্চলে ঘূর্ণায়মান অত্যন্ত শীতল বাতাসের যে বলয় থাকে, তাকেই পোলার ভর্টেক্স বলা হয়। এটি সাধারণত আর্কটিক অঞ্চলের উপরে অবস্থান করে, কিন্তু কখনও কখনও দক্ষিণদিকে সরে গিয়ে ইউরোপ, উত্তর এশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে। হিমালয় ভারতে পোলার ভর্টেক্সের সরাসরি প্রভাব আটকায়, তবে তার আংশিক প্রভাব আমরা অনুভব করতে পারি।

আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনায় আরও একটি প্রশ্ন প্রকট হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও কি এর উপর পড়ছে? জলবায়ু ও আবহাওয়া বিষয়ক সুন্দরবনের স্বাধীন গবেষক দীপাঞ্জন মিশ্র ইনস্ক্রিপটকে জানিয়েছেন, ভারতের বিগত কয়েক বছরের আবহাওয়ার চিত্র দেখলে বোঝা যায় যে ২০২০ থেকে ২০২৩-এ ভারত লা নিনা-র প্রকোপে পড়েছিল। এই বিরল ঘটনা এর আগে প্রায় ১৯৭৩-এর পর আর দেখা যায়নি। তার ফল স্বরূপ ভারত প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি ও শৈত প্রবাহের সম্মুখীন হয়। ঠিক সেরকমই একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে ডিসেম্বর আগামী দিনগুলোতে।

তিনি আরও জানান, এই অদ্ভুত পরিবর্তন অনেকটাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘটছে। স্বাভাবিক লা নিনা সাধারণত ১-১.৫ বছরের হয়ে থাকে। ২০২৪ সালের শেষের দিকে ভারতে এই লা নিনার প্রভাব শুরু হয়েছে। যার প্রভাব অনেকটা ক্ষীন হয়েছে মনে করলেও দেখা যায় যে লা নিনার প্রভাব এখনও কমেনি। আসলে লা নিনার প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে— যার প্রভাবে ভারতে প্রচুর বৃষ্টি হয়, প্রি মনসুন বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যায়। এই বছর তার প্রমাণ আমরা দেখেছি।

আরও পড়ুন- জলপানেই কমবে মানসিক চাপ! নতুন গবেষণায় উঠে এল চমকে দেওয়া তথ্য

তাছাড়া, “আমাদের দেশে শীতের প্রকোপ নির্ভর করে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার ওপরে, পশ্চিম দিকে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস উচ্চ ট্রাপোস্পিয়ারে অবস্থিত জেট স্ট্রিমের সহায়তায় ভারতে এসে পৌঁছায় এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় বৃষ্টিপাত, তুষারপাত ঘটায়। এ’বছর অক্টোবর মাসে তার প্রমাণ আমরা দেখেছি উত্তর ভারতে ব্যাপক তুষারপাত এবং তার সাথে শীতের আগমন” বলেন দীপাঞ্জন মিশ্র।

ভারতের শীত আর একটা ঘটনার ওপরেও নির্ভর করে, তা হলো উত্তর মেরুর ঘূর্ণাবর্ত। সাধারণত এই ঘূর্ণাবর্ত নীচে নেমে আসে তবে কখনও কখনও এটা নিজের গতিপথ থেকে নিচের দিকে স্লিপ করে আসে যা এ’বছর ঘটছে। এছাড়াও যে ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য তা হলো মধ্য এশিয়ার ঠাণ্ডা শীতল হাওয়া যা ভারতের উত্তর পশ্চিম এলাকায় উপত্যকা বা খাত গুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতে পৌঁছে উত্তর ভারতকে ঠাণ্ডা করে তার প্রভাব এ বছর বেশি থাকবে কারণ আগামী ৫ ডিসেম্বরের পরে ভারতের ওপরে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার কোনো প্রভাবের পূর্বাভাস নেই। আর পশ্চিমী ঝঞ্ঝা না থাকলে বাতাস হয়ে উঠে প্রচণ্ড শুষ্ক আর তার ফলে বৃষ্টি বা তুষারপাত ঘটেনা কেবল ঠাণ্ডা বাতাস প্রভাবিত হয়। জলকণা বা জলীয়বাষ্প থাকলে বাতাসের তাপমাত্রা একটু হলেও স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়, কিন্তু তা না থাকলে ঠাণ্ডার পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। তবে, এই সব পূর্বাভাস, পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে লড়তে গেলে তাকে বুঝতে হবে, তার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে, সচেতন থাকতে হবে, এছাড়া বিশেষ উপায় কিছুই নেই বলে জানান দীপাঞ্জন মিশ্র।

More Articles