২৫০০ বছর ধরে দুর্ভেদ্য! যেভাবে জটিল সংস্কৃত ধাঁধার সমাধান করলেন ভারতীয় এই গবেষক...

Sanskrit Puzzle: কম্পিউটারকেও শেখানো যাবে পাণিনির ব্যাকরণ! প্রত্যেক মুহূর্তেই নাকি প্রযুক্তি এবং কয়েক হাজার বছর আগের পাণিনি একাকার হতে পারেন মিলেমিশে।

এক-দুই অথবা দশ-কুড়ি নাকি একশো! বছরের বেড়ে ওঠার সমস্ত ইতিহাস অতিক্রম করে প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসই এবার ওলটপালট করে দিলেন ভারতের এক যুবক! এক নিমেষেই সমাধান করে ফেললেন হাজার হাজার বছর আগের সংস্কৃত ব্যাকরণের এক সমস্যা। অধরা সূত্র মুহূর্তেই করলেন সমাধান! পঞ্চম শতক থেকে যে জটিল ধাঁধার সমাধান করতে পারেননি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরাও, বৈয়াকরণদের কাছেও যা ছিল বেজায় কঠিন- সেই পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী-ক্ষেত্রের জটিল ধাঁধারই সমাধান করে ফেললেন ভারতের ঋষি রাজপোপাত (Rishi Rajpopat Sanskrit)। গত বৃহস্পতিবার তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশের পরই শোরগোল ফেলেছে বিশ্বজুড়ে।

বর্তমানে মাত্র কয়েক হাজার মানুষের ভাষা, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই ভাষা নিয়েই অবাধ যাতায়াত ২৭ বছর বয়সী ঋষির। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি। সেখানেই পাণিনির ব্যাকরণ এবং সংস্কৃত ভাষাতত্ত্ব-ব্যাকরণগত বিষয়ের অজানা-ক্ষেত্রে নিয়েই গবেষণা করছিলেন তিনি। ওই গবেষণার জন্য দিনের পর দিন পাণিনিকে ধ্যানজ্ঞান করেছিলেন মেধাবী এই ছাত্র। সেখানেই উঠে আসে একটি সমস্যার কথা। তাঁর গবেষণা-ক্ষেত্রের সমস্ত দিক উঠে আসলেও ওই একটি জায়গা নিয়েই তৈরি হয় ঘোর অনিশ্চয়তা।

এরপরেই সমস্যায় পড়েন ঋষি। তাঁর গবেষণার নির্দেশক-পরামর্শদাতা অধ্যাপক ভিনসেঞ্জো ভার্গিয়ানির সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসেন গবেষক। কিন্তু কোথায় কী! সমাধানের দেখা নেই। ভার্গিয়ানি তাঁকে বলেন, "পদ্ধতি এবং ভাবনায় কোথাও ভুল রয়েছে তাই সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।" এরপরেই পড়াশোনা এবং গবেষণা থেকে সাময়িক বিরতি নেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষক। সাঁতার থেকে শুরু করে সাইক্লিং, মেডিটেশনে সময় কাটান ঋষি। প্রায় এক মাস বই বন্ধ করে ভাবনার অন্য পর্যায়ে পৌঁছন ঋষি।

আরও পড়ুন- গ্রিক না সংস্কৃত? ‘কেন্দ্র’ শব্দের উৎস নিয়ে যে ঝগড়া লেগেই আছে

কিন্তু কপালে তাঁর ছিলই এই ইতিহাস সৃষ্টির তকমা! হঠাৎ বই খুলতেই খানিকটা যেন আশার আলো দেখতে পান গবেষক। ইউরেকা! দিনের পর দিন গ্রন্থাগারে পড়ে থাকা থেকে শুরু করে গভীর অধ্যয়ন; একাধিক তথ্য ফের খুঁটিয়ে দেখা শুরু করেন তিনি। অবশেষে আসে সাফল্য। অধরা জটিল ধাঁধার প্যাঁচ ছাড়িয়ে ফেলেন ঋষি। যার ফলে কম্পিউটারকেও শেখানো যাবে পাণিনির ব্যাকরণ! প্রত্যেক মুহূর্তেই নাকি প্রযুক্তি এবং কয়েক হাজার বছর আগের পাণিনি একাকার হতে পারেন মিলেমিশে। তাঁর কাজ নিয়ে, গবেষকের পরামর্শদাতা-অধ্যাপক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অধ্যাপকরা বলছেন, "সত্যিই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ঋষি। তাঁর এই কাজ আন্তর্জাতিক মহলে সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।" আর ঋষি বলছেন, "আমি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই ইউরেকা-মুহূর্তের স্বাদ পেয়েছি।"

একটি ভারতীয় ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে, এই ইতিহাস সৃষ্টির নেপথ্যে থাকা ভারতীয় ঋষির দাবি, "আমি অন্যান্য সবকিছুর সঙ্গেই প্রায় ৯ মাস ধরে শুধুমাত্র এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছি। তারপর না পেরে বিষয়টি ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। মাসখানেকের জন্য বইও বন্ধ করে দিই। গ্রীষ্ম উপভোগ করা শুরু করি। রান্না, সাঁতার, সাইক্লিং, মেডিটেশন, প্রার্থনা। সমস্ত কাজ করি। এরপর কাজে ফিরি। বই খুলেই ওই অংশের মধ্যে খানিকটা সুখবর খুঁজে পাই। আশা জাগে। চেষ্টা করতে শুরু করি ওই ধাঁধার সমাধানের লক্ষ্যে।"

অবশেষে প্রায় আড়াই বছরের সাধনার ফল পেয়েছেন ঋষি। দিনের পর দিন, রাত জেগে চেষ্টা করেছেন গবেষণার কাজ করতে। সংস্কৃত বরাবর প্রিয় বিষয় ছিল ঋষির। সেই বিষয়ের গভীর নিয়ে চর্চায় শখও তৈরি হয় এই যুবকের। ঋষি ওই ইংরেজি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, "পাণিনি অনন্য। মৌলিক। তাঁর চিন্তাধারা ছিল ভিন্ন, যা প্রযুক্তির যুগে কাজে লাগানো গুরুত্বপূর্ণ। নজির সৃষ্টি হতে পারে সেটা করলে।" আড়াই হাজার বছরের পুরনো 'অ্যালগোরিদম' এবং ভাষার মানবযন্ত্রের ক্ষেত্রেও নজির স্থাপন করছেন এই ব্যক্তি। তাঁর গবেষণাপত্রের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, 'উই ট্রাস্ট: ডিসকভারিং দ্য অ্যালগোরিদম
ফর রুল কনফ্লিক্ট রিজোলিউশন ইন দ্য অষ্টাধ্যয়ী।'

গবেষক ঋষির এই কাজ বিশ্বের ভাষা-ইতিহাসে ভাষাগত-ব্যাকরণগত বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। পাণিনির 'অষ্টাধ্যয়ী' লেখা হয় আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। সেখানে কমপক্ষে চার হাজার নীতির কথা বলা হয়েছে। যে নীতি, সংস্কৃত ভাষার সম্পূর্ণকরণে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে, যা ভাষার ব্যবহার, লিখিত রূপের ক্ষেত্রেও অন্যতম। এই রীতির বশেই রচিত হয় সাহিত্য। ব্যাকরণগত সৌন্দর্য্যের ক্ষেত্রেও পাণিনির এই নীতি অন্যতম কার্যকরি বলেই দাবি করা হয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে এই নীতিগত সাদৃশ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। একই নীতিতে দুই ক্ষেত্রের বিচ্ছুরণ নিয়েও রয়েছে স্ববিরোধ, যার অন্যতম হলো গুরু এবং মন্ত্র শব্দের ব্যবহার, প্রয়োগের রীতি।

আরও পড়ুন- সংস্কৃত শিখে গঙ্গার পুজো করেছিলেন বাংলায় প্রথম মসজিদের নির্মাতা এই তুর্কি সেনাপতি!

ঋষির গবেষণা এই বৈপরীত্য কাটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম। ভাষাযন্ত্র হিসেবে পাণিনির নীতিকে উপজীব্য করেই এগিয়েছে ঋষির গবেষণা। অধ্যাপক ভিনসেঞ্জো ভার্গিয়ানি 'দ্য ওয়ার'কে বলেন, "আমার ছাত্র ঋষি এক অবিশ্বাস্য সমস্যার সমাধান করেছে, যা ঐতিহাসিক। এই কাজ আগামী সময়ে সংস্কৃত ভাষায় আগ্রহ এবং গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে।"

কীভাবে কম্পিউটার এবং পাণিনির ভাষা যন্ত্রের সাদৃশ্য রচিত হবে? ওই ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে ঋষি জানিয়েছেন, "প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণে কাজ করা কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা ৫০ বছরেরও বেশি আগে নিয়ম-ভিত্তিক এই পন্থা বাছেন। তাই কম্পিউটারকে শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কীভাবে বক্তার অভিপ্রায়কে পাণিনির নিয়ম-ভিত্তিক ব্যাকরণের সঙ্গে একত্রিত করে মানুষের বক্তৃতা তৈরি করা যায়। যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের ভাষার মিথস্ক্রিয়া, সেইসঙ্গে ভারতের বৌদ্ধিক ইতিহাসেও এই চেষ্টা একটি বড় মাইলফলক হবে।" ঋষির আরও দাবি, "ভারতের কিছু প্রাচীন জ্ঞান সংস্কৃতে উৎপাদিত হয়েছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা কী অর্জন করেছিলেন তা আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। আমরা প্রায়শই বিশ্বাস করি যে, আমরা গুরুত্বপূর্ণ নই। আমি আশা করি এই আবিষ্কারটি ভারতের শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস, গর্ব এবং আশায় উদ্বুদ্ধ করবে যে তাঁরাও মহান কিছু অর্জন করতে পারে!"

 

More Articles